হুমায়ুন কবীর রিন্টু , নড়াইল : নড়াইলের লোহাগড়া পৌরসভায় চলছে তোঘলকি কারবার। দুর্নীতি অনিয়ম যেখানে নিয়মে পরিণত হয়েছে। মেয়র ও গুরুত্বপূর্ণ পদের অধিকাংশের বিরূদ্ধে ঘুষ দুর্নীতির অন্তহীন অভিযোগ।
জানা গেছে, লোহাগড়া পৌরসভায় কোন নিয়ম শৃংখলা নেই। উদ্দেশ্যমুলক ভাবে সহকারি প্রকৌশলী’র পদ ফাঁকা রাখা হয়েছে। দীর্ঘ প্রায় ৫ মাস এ পদ শূণ্য। নেই কোন উপ-সহকারি প্রকৌশলী। তবে প্রকৌশলীর অভাবে কোন কাজ থেমে নেই। দুর্নীতিবাজ কার্য সহকারী কবির হোসেনকে দিয়ে প্রকৌশলী’র কাজ করানো হচ্ছে। এহেন ঘটনায় লোহাগড়া পৌরসভার দুর্নীতি অনিয়মের চিত্র ফুটে উঠেছে সর্বমহলে।
স্থানীয় সরকার,পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় এর স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-সচিব ফারজানা মান্নান কর্তৃক গত ২৫ জানুয়ারি স্বাক্ষরিত এক পত্রে লোহাগড়া পৌরসভার সহকারি প্রকৌশলী (সিভিল) শেখ সাইয়াদুল হককে মুন্সিগঞ্জের মিরকাদিম পৌরসভায় বদলি করা হয়। বদলির আদেশ পেয়ে তিনি মিরকাদিম পৌরসভায় যোগদান করেছেন। আর এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে দুর্নীতিতে মেতে উঠেছেন মেয়র সৈয়দ মসিয়ূর রহমান। তিনি এ পৌরসভার ৩য় শ্রেণির কর্মচারী মহা-দুর্নীতিবাজ কার্য সহকারি কবির হোসেনকে নিয়ে টেন্ডার কার্যক্রম সহ নানাবিধ গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। কবির হাসেন একজন কার্য সহকারি হয়ে সহকারি প্রকৌশলী ও উপ-সহকারি প্রকৌশলীর কাজ করে চলেছেন। সহকারি প্রকৌশলীর স্বাক্ষরের জায়গায় তিনি টিক চিহৃ দিয়ে স্বাক্ষর করছেন। সাবেক সহকারি প্রকৌশলী শেখ সাইয়াদুল হক’র আইডি ব্যবহার করে টেন্ডার কার্জক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন এ ধূর্ত কার্য সহকারি কবির হোসেন। তিনি শহীদুল নামে একজন প্রকৌশলীর আইডি ব্যবহার করে পৌরসভার বাড়ী,দোকান ও ভবন’র নক্সা অনুমোদন দিচ্ছেন। একজন কার্য সহকারি হয়ে সহকারি প্রকৌশলী সেজে সকল কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছেন দুর্দান্ত দাপটে। তার ঘুষ দুর্নীতির কাছে অসহায় হয়ে পড়েছেন পৌরসভার সাধারণ মানুষ। মেয়র সৈয়দ মসিয়ূর রহমানের আশীর্বাদ পুষ্ট লোক হওয়ায় ভয়ে তার বিরূদ্ধে কেউ মুখ খুলতে চান না। চরম দুর্নীতি অনিয়মের আশ্রয় নিয়ে অসৎ উদ্দেশ্যে কার্য সহকারি কবির হোসেনকে দিয়ে টেন্ডার আহবান করায় সর্ব মহলে সমালোচনার ঝড় বইছে। অতি সম্প্রতি ২০২২-২৩ অর্থ বছরে এলজিসিআরআরপি প্রকল্পের আওতায় এ পৌরসভার অধিনে ৬৭ লাখ ৭৪ হাজার ৬শ ২১ টাকার “ইমপ্রুভমেন্ট অফ লোহাগড়া মিউনিসিপাল কিচেন মার্কেট উইথ ইনভায়রনমেন্টাল ওয়ার্ক” শিরোনামে একটি টেন্ডার আহবান করা হয়েছে। এ টেন্ডারে সাবেক সহকারি প্রকৌশলী শেখ সাইয়াদুল হক এর আইডি ব্যবহার করে তার নামের পাশে টিক চিহৃ দিয়ে সেখানে স্বাক্ষর করেছেন কার্য সহকারি কবির হোসেন। এমন দু:সাধ্য সাধনের অপচেষ্টা স্পষ্টত: দুর্নীতির ইঙ্গিত দিয়েছে পৌরবাসিকে।
এদিকে অনুসন্ধানে আরোও জানা গেছে, গত ২০২০-২১ অর্থ বছরে লোহাগড়া পৌরসভার অধিনে করোনা ও মশক নিধন সামগ্রী কেনার জন্য ৯ লাখ ৮৮ হাজার ৯শ ৯৮ টাকা বরাদ্দ দেয়। বরাদ্দকৃত অর্থের ব্যয় দেখাতে অর্থ বছরের শেষ দিন ৩১ জুন কাগজ কলমে দু’টি প্যাকেজে কোটেশন দরপত্র আহবান করা হয়। একটি প্যাকেজের প্রাক্কলিত মূল্য ৪ লাখ ৭১ হাজার ৯শ ৯৯ টাকা। আরেকটি প্যাকেজের প্রাক্কলিত মূল্য ৫লাখ ১৬ হাজার ৯শ ৯৯ টাকা। উভয় প্যাকেজে মেসার্স তালুকদার ফোর্ট নামের ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে সর্বনিম্ন দরদাতা দেখিয়ে কার্যাদেশ দেয়া হয়। এরপর সাবেক সহকারি প্রকৌশলী সাইয়াদুল হক তার সাবেক কর্মস্থল মনিরামপুর হতে মাত্র ২০ হাজার টাকার সামান্য মালামাল কিনে সমুদয় টাকা ভাগাভাগি করে নেন বলে গুঞ্জণ রয়েছে। মেসার্স তলুকদার ফোর্টের ঠিকাদার টিএম শফিউল আলম পৌরসভার কর আদায়কারি সোনিয়া আফরোজের ভাই। অধিকাংশ প্রকল্পের কাজ এ প্রতিষ্ঠানের নামে দিয়ে লুটপাট করা হয়েছে বলে ব্যাপক গুঞ্জণ রয়েছে।
একই ভাবে ২০২১-২২ অর্থ বছরে লোহাগড়া উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন (পিআইও) কার্যালয় থেকে গ্রামীণ অবকাঠামো রক্ষনাবেক্ষণ (টিআর) ৩ লাখ ১০ হাজার ৮শ ৮৩ টাকা লোহাগড়া পৌরসভার অনুকুলে দু’টি প্রকল্পের রিপরীতে বরাদ্দ দেয়া হয়। বরাদ্দকৃত অর্থ পৌরসভার দু’জন কাউন্সিলর ২০২২ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি ও ১৫ জুন পিআইও অফিস হতে ছাড় করান। লোহাগড়া বাজার সেতুর উপর নাম মাত্র রং ও আলোকসজ্জা করে এ অর্থ খরচ দেখানো হয়। অপর একটি প্রকল্পে ১ লাখ ৮ হাজার ৯ শ ৫৪ টাকায় পৌরসভা কার্যালয়ে ১১টি সিসি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়। সূত্র আরোও জানায়, ইতোপূর্বে লোহাগড়া পৌরসভার বিভিন্ন রাস্তায় ইটের গুড়া দিয়ে সংস্কারের নামে ৬ লাখ ৩৫ হাজার টাকা আত্নসাৎ করা হয়। অদৃশ্য টেন্ডার বা কোটেশনের মাধ্যমে নিজস্ব ঠিকাদারের নাম ব্যবহার করে নাম মাত্র কাজ দেখিয়ে অর্থ আত্নসাতের অভিযোগ উঠায় ওই সময়ে সচেতন মহলে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়।
অপর একটি সূত্র জানায়, অতি সম্প্রতি টেন্ডার দুর্নীতির গন্ধ ছড়িয়ে পড়ায় ক্ষুব্ধ হয়েছেন সচেতন পৌরবাসি। বদলি হয়ে অন্যত্র চলে যাওয়া সহকারি প্রকৌশলী শেখ সাইয়াদুল হক এর আইডি ব্যবহার করে টেন্ডার আহবান করা এবং সেই টেন্ডার কমিটিতে সামান্য একজন কার্য সহকারীর স্বাক্ষর করানোর ঘটনা রীতিমত দুর্নীতির ইঙ্গিত বহন করে। সহকারি প্রকৌশলী এবং উপ-সহকারি প্রকৌশলী ছাড়াই চলছে লোহাগড়া পৌরসভা। অসৎ উদ্দেশ্যে এ পৌরসভায় কোন প্রকৌশলী রাখা হয়নি। প্রকৌশলীর কাজ করছেন একজন কার্য সহকারী। সহকারি প্রকৌশলীর জায়গায় তাকে দিয়ে স্বাক্ষর করানো হয়। বিষয়টি কোন ভাবেই মেনে নিতে পারেননি লোহাগড়া পৌরসভার সচেতন মহল। বিভিন্ন মহল থেকে দাবি উঠেছে পৌরসভার সার্বিক কার্যক্রম বিশেষ করে টেন্ডার ও আর্থিক অনিয়মের বিষয়টি খতিয়ে দেখা খুবই জরুরী।
স্থানীয় একাধিক ব্যক্তি জানান, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে মেয়র নির্বাচিত হন সৈয়দ মসিয়ূর রহমান। দলীয় নেতা-কর্মীরা তাকে শুধু ভোট দেননি। তার জন্য মাঠে নেমে কাজ করেছেন। এমনকি জীবনের ঝঁকি নিয়ে তাঁর বিজয় নিশ্চিত করেছেন। অথচ বিজয়ী হওয়ার পর দলীয় নেতা-কর্মীর কথা ও পৌর নাগরিকদের স্বার্থ সুবিধার কথা বেমালুম ভুলে গেছেন। নিজের আখের গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। আর সে কাজটি সুষ্ঠু সুন্দর ভাবে সফল করতে শুরু থেকেই ছক এঁেক কাজ শুরু করেছেন। লোহাগাড়া পৌরসভার অধিকাংশ উন্নয়ন কাজ ও অর্থ ব্যয়িত কাজে দুর্নীতির চিহৃ বিদ্যমান থেকে যাচ্ছে। পরিস্থিতি দৃষ্টে অভিজ্ঞ মহলের মন্তব্য দুদক’র হস্তক্ষেপ ছাড়া এ পৌরসভার কার্যক্রমে স্বাভাবিক গতি ফিরবে না।
টেন্ডার কার্যক্রমে সহকারি প্রকৌশলী’র জায়গায় স্বাক্ষর ও অন্যান্য দুর্নীতির ব্যাপারে কার্য় সহকারি কবির হোসেন’র সাথে যোগাযোগ করলে তিনি প্রকৌশলী না হয়েও প্রকৌশলী হিসেবে বিভিন্ন কার্যক্রমের কথা স্বিকার করে বলেন, মেয়রের নির্দেশে করেছেন। সহকারি প্রকৌশলীর স্বাক্ষরের জায়গায় টিক চিহৃ দিয়ে স্বাক্ষর করা এবং সহকারি প্রকৌশলী হিসেবে এসব কার্যক্রম পরিচালনা করা দুর্নীতি অনিয়ম কি-না ? এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি ফোন কেটে দেন।
এ ব্যাপারে লোহাগড়া পৌরসভার মেয়র সৈয়দ মসিযূর রহমানের নিকট জানতে চাইলে তিনি পাল্টা প্রশ্ন করে বলেন, এসব কারা জানিয়েছে? এরপর কোন কথা না বলেই ফোন কেটে দেন।
নড়াইলের লোহাগড়া পৌরসভায় চলছে সীমাহীন অনিয়ম দুর্নীতি
Leave a comment