ঘটনার এক বছর অতিবাহিত হলেও অপরাধিরা ধরা ছোয়ার বাইরে
হুমায়ুন কবীর রিন্টু , নড়াইল : আজ ১৮ জুন। ২০২২ সালের আজকের এ দিনে নড়াইলের মির্জাপুর ইউনাইটেড ডিগ্রি কলেজ’র তৎকালিন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসকে চরম ভাবে লাঞ্ছিত করা হয়। এ ঘটনায় সারা বাংলাদেশ সহ বিভিন্ন দেশে তোলপাড় হয়। সারা দেশের সভ্য সমাজ,সচেতন মহল ও শিক্ষক সমাজ তীব্র নিন্দা জানান। বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ প্রতিবাদ জানিয়ে এমন ন্যাক্কারজনক ঘটনার সাথে জড়িতদের শাস্তির দাবি জানান। দোষিদের শাস্তির দাবিতে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ ও মানববন্ধন করা হয়। ঘটনার এক বছর অতিবাহিত হয়েছে। পূর্ব পরিকল্পিত ভাবে সাম্প্রদায়িক উস্কানি ও গুজব ছড়িয়ে তৎকালিন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাস (সহকারি অধ্যাপক) কে লাঞ্ছিত করে চাকুরিচ্যুত করার অপচেষ্টার সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে জড়িতদের বিরূদ্ধে কোন কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। পুলিশ প্রশাসন, জেলা প্রশাসন,জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর পৃথক পৃথক তদন্ত টিম গঠন করে তদন্ত করেছে। সকল দপ্তরের তদন্তের ফলাফল প্রায় একই। সকলের সন্দেহের তীর একই ব্যক্তির দিকে। উচ্চ মহলের তদবীরের কারনে তদন্ত পরবর্তী কার্যক্রম থমকে গেছে। মুল অপরাধী থেকে গেছে ধরা ছোয়ার বাইরে।
কেমন আছেন সাবেক ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাস : ভালো নেই স্বপন কুমার বিশ্বাস। তাকে লাঞ্ছিত করার সাথে জড়িতদের বিরূদ্ধে কোন ব্যবস্থা না নেয়ায় তারা আরোও বেপরোয়া। সারাক্ষণ আতংকে থাকেন স্বপন কুমার বিশ্বাস । কর্মস্থলে তিনি নিজেকে এক মুহুর্ত নিরাপদ মনে করেন না। ঘটনার সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে জড়িত সহকর্মীরা আবারও অনাকাংখিত কোন ঘটনা ঘটাতে পারেন,সারক্ষণ এমন আতংকে থাকেন। প্রয়োজন ছাড়া তিনি কারো সাথে কোন কথা বলেন না। বিশেষ করে যাদের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন, তাদেরকে তিনি এড়িয়ে চলেন। কিন্তু তারা অনেক সময় নানা অজুহাতে কথা বলেন বা বলার চেষ্টা করেন। এতে তিনি অস্বস্তি বোধ করেন। সবকিছু বুঝেও তারা নানা ভাবে তার অবস্থান ও পারিবারিক খোঁজ খবর নেয়ার চেষ্টা করেন। এতে তিনি আরোও শংকিত হন। একান্ত সাক্ষাতকারে তিনি আরোও বলেন, প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে তিনি এ কলেজে চাকুরী করছেন। দীর্ঘ চাকুরী জীবনে তিনি কারো সাথে কোন খারাপ ব্যবহার করেননি। অহেতুক তাকে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে গলায় জুতার মালা দিয়ে মারপিট করা হয়। চাকুরী হতে বরখাস্ত করার অপচেষ্টা করা হয়। সংশ্লিষ্ট প্রশাসন,মিডিয়া কর্মী ও সচেতন মহলের কারনে দুষ্টু চক্র সফল হয়নি। কিন্তু তারা হাল ছাড়েনি। তাদের অপচেষ্টা অব্যহত রয়েছে। তারা তাকে সব সময় ফলো করেন। স্বাধীনভাবে চলাচল করতে দেন না। তাদের দ্বারা আবারও আক্রমনের শিকার হতে পারেন, এমন শংকায় তিনি নিজ গ্রাম নড়াইল সদর উপজেলার বড়কুলা ছেড়ে নড়াইল শহরের রূপগঞ্জ এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকেন। সন্তানদের শহরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করেছেন।
গ্রামে তিনি ভালোই ছিলেন। খরচ অনেক কম ছিল। শহরে এসে বাসা ভাড়া,গ্যাস ও পানি কেনা সহ নানাবিধ খরচ বেড়েছে। গ্রামের বাড়িতে থাকা বাবা-মায়ের নিয়মিত বাজার খরচ সহ সকল খরচ দিতে হয়। এদিকে শহরের বড় অংকের খরচের সাথে তিন মেয়ের পড়াশুনার খরচ জোগাতে একার আয়ে হিমশিম খাচ্ছেন। তথাপিও নিজের ও স্ত্রী-সন্তানদের নিরাপত্তার জন্য গ্রামে থাকতে পারছেন না।
প্রসঙ্গত: ২০২২ সালের ১৮ জুন সাম্প্রদায়িক উস্কানির বিষবাস্প ছড়িয়ে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসকে পরিকল্পিতভাবে একটি চক্র শারীরিক ও মানসিক ভাবে লাঞ্ছিত করে এবং তার মোটরসাইকেল পুড়িয়ে দেয়। একই সাথে তিনি সম্মান ও মোটরসাইকেল হারান। এমনকি তাকে চাকুরীচ্যুত করার ঘোষনা দেয়া হয়। পরবর্তীতে কুচক্রী মহলের চক্রান্তের বিষয়টি সর্বমহলে জানাজানি হলে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধিদল তাকে ফুলের মালা দিয়ে বরণ করে কলেজে নিয়ে যান। সম্মান ও চাকুরী ফিরে পেলেও আর্থিক সংকট কাটেনি।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০২২ সালের ১৭ জুন মির্জাপুর ইউনাইটেড ডিগ্রি কলেজ’র একাদশ শ্রেণির প্রথম বর্ষের ছাত্র রাহুল দেব রায়’র ফেসবুকে ভারতের নুপুর শর্মা’র ছবি দিয়ে “প্রনাম নিও বস নুপুর শর্মা, জয় শ্রী রাম ” ক্যাপশন দেয়। পরদিন ১৮জুন সকালে বিষয়টি কলেজে জানাজানি হয়। শিক্ষকমন্ডলি ও জিবি’র সভাপতি অচিন চক্রবর্তীর পরামর্শে অত্র কলেজের অধ্যক্ষ (ভারপ্রাপ্ত) স্বপন কুমার বিশ্বাস ছাত্র রাহুলকে আটকে পুলিশে দেন।
এরপর ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ঘটনাটি জিবি’র অন্যান্য সদস্য, পুলিশ সুপার প্রবীর কুমার রায়, জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান,নড়াইল-১ আসনের সাংসদ মোঃ কবিরুল হক মুক্তি সহ সংশ্লিষ্ট সকলকে জানান।
মির্জাপুর পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ মুরসালিন কলেজ থেকে রাহুলকে নিয়ে যেতে গেলে কতিপয় শিক্ষার্থী বাঁধা দেয়। ইনচার্জ মুরসালিন আরোও পুলিশ এনে তাকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। কিছু সময়ের মধ্যে কলেজ চত্বরে বহিরাগতদের আগমন ঘটতে থাকে। একই ভাবে পর্যায়ক্রমে নড়াইল সদর থানার ওসি শওকত কবির ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রিয়াজুল ইসলাম ঘটনাস্থলে গিয়ে ছাত্র রাহুলকে উদ্ধারে ব্যর্থ হওয়ায় বেলা ২টার দিকে পুলিশ সুপার প্রবীর কুমার রায় ছুটে যান। রাহুলের উপযুক্ত বিচারের আশ্বাস দিয়ে উত্তেজিত জনতা শান্ত করার সর্বাত্নক চেষ্টা করেন। ঠিক এমন সময় বহিরাগতদের আক্রমনে পুলিশের সাথে জনগনের ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া হয়। পুলিশ লাঠিচার্জ করে। এমনকি ৬ রাউন্ড টিয়ার সেল নিক্ষেপ করে। কয়েকজন পুলিশ সদস্য আহত হন। পুলিশের উপস্থিতিতে ৩ জন হিন্দু শিক্ষক ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাস,সাবেক ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ অরুন কুমার মন্ডল ও সহকারি অধ্যাপক প্রশান্ত রায়ের মোটরসাইকেল পুড়িয়ে ভস্মিভুত করা হয় । শিক্ষক শ্যামল কুমার ঘোষকে বেদম মারপিট করে রক্তাক্ত জখম অবস্থায় বাথরুমে আটকে রাখা হয়।
পরিস্থিতি ঘোলাটে হলে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান,অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক জুবায়ের হোসেন সহ কয়েকজন ম্যাজিষ্ট্রেট ঘটনাস্থলে যান। তারা উপযুক্ত বিচার দেয়ার আশ্বাস দিয়ে ছাত্র রাহুল এবং ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসকে পুলিশ হেফাজতে নেন। পুলিশ সুপার ও জেলা প্রশাসক কলেজ চত্বরে থাকা অবস্থায় কতিপয় ব্যক্তি ঘটনার দিন বিকেলে ছাত্র রাহুলের সাথে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসকে জুতার মালা পরিয়ে মারতে মারতে এনে পুলিশের গাড়ীতে উঠিয়ে দেয়। শুধু তাই নয় ওই সময় এলাকার কতিপয় চিহিৃত দুস্কৃতকারি রীতিমিত মাইকিং করেন সামাজিক বিচারে অধ্যক্ষ স্বপন বিশ্বাসকে জুতার মালা পরানো হবে। উৎসুক জনতার সামনে জুতার মালা পরিয়ে তারা উল্লাস করে। কেন? কার স্বার্থে ? ওই লোকজন কলেজ চত্বরে এসে অধ্যক্ষকে লাঞ্ছিত করার কাজে নেতৃত্ব দেন, তার কোন সদুত্তর অদ্যবধি মেলেনি।
ঘটনার দিন সন্ধ্যায় জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে পুনরায় নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত কলেজ বন্ধ ঘোষনা করা হয়। এ বিষয়ে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর সরেজমিন তদন্তপূর্বক সুস্পষ্ট মতামতের জন্য তদন্ত কমিটি গঠন করে। তদন্ত কমিটির পর্যালোচনা এবং মতামত বিশ্লেষনপূর্বক তদন্ত কমিটির নিকট প্রতীয়মান হয়েছে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাস এর গলায় জুতার মালা পরানো হয়েছিল। কলেজের অধ্যক্ষ’র পদ শুণ্য থাকায় কলেজের কতিপয় শিক্ষকের মধ্যে ওই পদ দখলের প্রতিযোগিতা চলছিল। ছাত্র রাহুলের দেয়া পোষ্ট নিয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন পরবর্তিতে বহিরাগতদের আন্দোলনে পরিণত এবং অধ্যক্ষের গলায় জুতার মালা দেয়া এবং অধ্যক্ষকে শারীরিক ভাবে লাঞ্ছিত করার পিছনে শিক্ষকদের অভ্যন্তরীণ কোন্দল থাকতে পারে। সংশ্লিষ্টজনের বক্তব্য ও ঘটনার দিনের ভিডিও ফুটেজ পর্যালোচনা করে কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ের শিক্ষক ও সাবেক ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আকতার হোসেনের ভূমিকা রহস্যজনক ও প্রশ্নবিদ্ধ ছিল বলে প্রতীয়মান হয়।
ওই পত্রে একই সাথে ৩টি বিষয়ে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে, প্রথমত: পত্রজারী হতে ২ মাসের মধ্যে অধ্যক্ষ নিয়োগ দিয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরকে অবহিত করতে হবে। দ্বিতীয়ত: রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক আকতার হোসেনের বিরূদ্ধে ৭ কর্মদিবসের মধ্যে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহন করে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরকে অবহিত করতে হবে। তৃতীয়ত: রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক আকতার হোসেন (ইনডেক্স নং-৪৩৭৯১২) এর এমপিও কেন বন্ধ করা হবে না, সে বিষয়ে ৫ কর্মদিবসের মধ্যে অধ্যক্ষ কর্তৃক ব্যাখ্যা এবং সভাপতি কর্তৃক মতামত প্রদান করতে বলা হয়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর এর যথাযথ কর্তৃপক্ষের নিকট।
স্থানীয়রা জানান, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের এ পত্র পাওয়ার কলেজের জিবি’র অধিকাংশ সদস্যর সাথে যোগাযোগ করেন কলেজের জিবি’র সভাপতি অচিন কুমার চক্রবর্তী। তিনি সুকৌশলে জিবি’র অধিকাংশ সদস্যর উপর চাপ সৃষ্টি করেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক আকতার হোসেনের পক্ষে জিবি’র সভায় কথা বলতে এবং তার পক্ষে রেজুলেশন করে দিতে। আওয়ামী লীগ নেতা অচিন কুমার চক্রবর্তী কলেজের জিবি’র সভাপতি হওয়ার পর হতে কলেজে অশান্তি ও বিশৃংখলা শুরু হয়। তিনি জিবি’র সভাপতি হওয়ার পর রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক আকতার হোসেন বেপরোয়া হয়ে উঠেন। অধ্যক্ষকে জুতার মালা দেয়ার পরদিন কলেজে গিয়ে জিবি’র সভাপতি অচিন কুমার চক্রবর্তী প্রকাশ্যে জনসভায় বক্তব্যে বলেন স্বপন কুমার বিশ্বাস ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ থাকতে পারবেন না। আর তিনি কোন দিন এ কলেজে আসতে পারবেন না। কলেজের ৩জন হিন্দু শিক্ষকের মোটরসাইকেল পোড়ানো ও ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষকে জুতার মালা দেয়া ও মারপিট করা এবং শিক্ষক শ্যামলকে মারপিট করে রক্তাক্ত জখম করার ঘটনায় কোন মামলা করা হবে না। এলাকার শান্তিপ্রিয় লোকজন, কলেজ প্রতিষ্ঠার সাথে জড়িতরা এবং জিবি’র অন্যান্য সদস্যরা এ বক্তব্য শুনে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেন। জিবি’র সভাপতি অচিন চক্রবর্তীর লাগামহীন পক্ষপাতমুলক বক্তব্য ও অনিয়মের প্রতিবাদে বিক্ষুব্ধরা মিছিল দেয় “অচিনের দুই গালে, জুতা মারো তালে তালে”। তদুপরি প্রভাবশালী এ নেতার ভয়ে ক্ষতিগ্রস্থ কোন শিক্ষক মামলা করতে সাহস পাননি। এমনকি মোটরসাইকেল পোড়ানোর ঘটনায় কোন জিডি করতে পারেননি। তিনি জিবি’র সদস্য এবং শিক্ষকদের মধ্যে গ্রুপিং করে নিয়োগ বাণিজ্য করতে চেয়েছিলেন। তার কারনেই কলেজ অশান্ত হয়ে উঠে। ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসকে লাঞ্ছিত করার পর এলাকার জনগনের নিকট এবং প্রশাসনের নিকট সবকিছু পরিষ্কার হয়ে যায়। এরপরও হাল ছাড়েননি জিবি’র সভাপতি অচিন চক্রবর্তী। তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক আকতার হোসেনের পক্ষে অবস্থান নিয়ে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ সহ জিবি’র অনেক সদস্যকে চাপ সৃষ্টি করে জিবি’র সভায় আকতার হোসেনের পক্ষে রেজুলেশন করে দিয়েছেন,যাতে তার এমপিও বাতিল না হয়। তবে ঘটনার পর থেকে অদ্যবধি শিক্ষক আকতার হোসেনের সাথে সাধারণ শিক্ষকদের দুরত্ব কমানো ও কলেজের অভ্যন্তরীণ কোন্দল নিরসনে কোন পদক্ষেপ নেননি। বরং সুকৌশলে স্থানীয় শিক্ষকদের মধ্যে গ্রুপিং করে রেখেছেন। পরিস্থিতি খারাপ হওয়ায় বহিরাগত শিক্ষকরা সব সময় আতংকে থাকেন। ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষকে জুতার মালা দেয়ার ঘটনায় শিক্ষক আকতার হোসেনের রহস্যজনক ও প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকার জন্য তাকে আওয়ামী লীগ হতে বহিস্কার করা হয়। তবে শিক্ষক আকতার হোসেনের প্রতি জিবি’র সভাপতির উদারতা দেখে বিস্মিত নড়াইলবাসি।
স্থানীয়রা আরোও জানান, ঘটনার দিন সকাল ১১টা থেকে বিকাল পর্যন্ত শিক্ষক আকতার হোসেন এর ভূমিকা ছিল রহস্যজনক ও প্রশ্নবিদ্ধ। নিরব থাকা লোকজনদের গিয়ে তিনি যখনই বলছিলেন আপনারা উত্তেজিত হবেন না, থামেন। তখনই নিরব থাকা লোকগুলি উত্তেজিত হচ্ছিল। ঘটনার সময় কলেজের সকল শিক্ষক-কর্মচারী প্রাণ বাঁচাতে কলেজ চত্বর ছেড়ে যেতে বাধ্য হন। তবে ঘটনার শেষ পর্যন্ত কলেজ চত্বরে ছিলেন একমাত্র শিক্ষক আকতার হোসেন। তার উপস্থিতিতেই ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ’র গলায় জুতার মালা দেয়া হয় (যা ভিডিও তে দেখা যাচ্ছে)। তিনি দফায় দফায় বক্তব্য দিয়ে উত্তেজিত জনতা শান্ত করার চেষ্টা করছেন,এমন ভিডিও ফেসবুকে ব্যাপক প্রচার করা হয়েছে। অথচ তার মত প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতার কথা একজন লোকও শোনেনি। যা উপস্থিত সকলকে ভাবিয়ে তুলেছে। তার উপস্থিতিতে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষকে জুতার মালা দেয়ার সময় তার চলন বলন দেখে অনেকেই হতবাক হয়েছেন। তাছাড়া দিনভর শুধুমাত্র ছাত্র রাহুলের বিরূদ্ধেই অভিযোগ ছিল, বেলা ২টার পর হঠাৎ করে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ’র বিরূদ্ধেও আন্দোলন শুরু হয়। এক পর্যায়ে ছাত্র রাহুলকে বাদ দিয়ে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষর বিরূদ্ধেই আন্দোলন জোরদার করা হয়। শেষ পর্যন্ত পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী তাকে জুতার মালা দিয়ে লাঞ্ছিত করা হয়।
শিক্ষক আকতার হোসেন এর আগে জাতীয় দিবস (মহান ২১ শে ফেব্রুয়ারি) পালন হয়নি,এমন অভিযোগ এনে এলাকা অশান্ত করে তৎকালিন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ অরুন কুমার মন্ডলকে নামিয়ে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ’র চেয়ার দখল করেন। ২০২০ সালের শেষ দিকে নড়াইল সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জিবি’র সভাপতি হন। বিধি বহির্ভুত ভাবে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হওয়ায় তিনি আকতার হোসেনকে ওই পদ হতে অপসারন করে মোস্ট সিনিয়র স্বপন কুমার বিশ্বাসকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ’র দ্বায়িত্ব দেন। এতে চরমভাবে ক্ষুব্ধ হন শিক্ষক আকতার হোসেন। ২০২১ সালে কলেজ বিল্ডিংয়ে ঝুলানো জাতীয় শোক দিবস পালনের বড় ড্রপ ব্যানার রাতের আধারে উধাও হয়। জিবি’র সিদ্ধান্তে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাস এ ঘটনায় নড়াইল সদর থানায় জিডি করেন। অদৃশ্য কারনে ব্যানার চুরির রহস্য কেউ জানতে পারেনি। অভিযোগ রয়েছে এ্যাডভোকেট অচিন চক্রবর্তীর হস্তক্ষেপে জিডি’র তদন্ত হয়নি। এদিকে কলেজে ৫জন কর্মচারী নিয়োগ রয়েছে। আওয়ামী লীগ নেতা আকতার হোসেন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হতে নানা ভাবে চেষ্টা চালিয়ে আসছিলেন। এরই অংশ হিসেবে পূর্বে নিরীক্ষিত ও তদন্ত হয়ে জিবি’তে অনুমোদিত সময়ের হিসাবের নিরীক্ষা ও তদন্ত দেয়া হয়। শুধুমাত্র সিনিয়র দু’জন শিক্ষক স্বপন কুমার বিশ্বাস ও অরুন কুমার মন্ডলকে ফাঁসানোর জন্য এ তদন্ত করা হয়েছিল। এসব করার উদ্দেশ্য একটাই তাদের কেউ যাতে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ’র দ্বায়িত্ব না নেন। শিক্ষক আকতার হোসেন সব সময় কলেজে প্রভাব বিস্তার করে চলেন। স্থানীয় শিক্ষকরা সব সময় জিবি’তে শিক্ষক প্রতিনিধি হয়ে থাকেন। বিগত ১২ বছর একাধারে স্থানীয় শিক্ষকরা জিবি’তে শিক্ষক প্রতিনিধি হিসেবে রয়েছেন। এ্যাডভোকেট অচিন কুমার চক্রবর্তী জিবি’র সভাপতি হওয়ার পর শিক্ষক আকতার হোসেন আরোও বেপরোয়া হয়ে উঠেন। জিবি’র সদস্য না হয়েও তিনি প্রত্যেকটি জিবি’র সভায় উপস্থিত থেকে প্রভাব খাটান। স্থানীয় লোক হওয়ায় নানা ধরনের অঙ্গভঙ্গি করে আতংক সৃষ্টি করেন। কথায় কথায় বহিরাগত সন্ত্রাসী এনে শিক্ষকদের শাসান। সাধারণ শিক্ষকদের স্বাধীন মত প্রকাশের সুযোগ দেন না। শিক্ষক সুলভ কোন আচরন তার মধ্যে নাই। কলেজের সবকিছুতেই দলীয় প্রভাব খাটান। শিক্ষক আশুতোষ কুমার বিশ্বাস,কর্মচারী হাজ্জাজ এর নিকট হতে টাকা ধার নিয়ে পরিশোধ করছেন না। কথায় কথায় কলেজে বহিরাগত ডেকে আনেন। তার আচরনিক সংশোধন না হলে ওই কলেজে কোন শিক্ষক মর্যাদা নিয়ে চাকুরী করতে পারবেন না।
ইতোমধ্যে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর পৃথক দু’টি তদন্ত সম্পন্ন করেছে। তদন্ত শেষে কলেজের জিবি এবং কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক আকতার হোসেনকে কারণ দশার্নোর নোটিশ দিয়েছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। একই ভাবে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের তদন্তে কলেজে ১৮ জুনের ঘটনায় রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক আকতার হোসেন’র ভূমিকা রহস্যজনক ও প্রশ্নবিদ্ধ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। নড়াইল সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের যৌথ সাক্ষরে আকতার হোসেনকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ হতে বহিস্কার করা হয়েছে। আকতার হোসেন নড়াইল সদরের বিছালী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন। আকতার হোসেনকে বহিস্কার করে মশিয়ার রহমান ফকিরকে বিছালী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি করা হয়েছে। গত ১৮ জুনের ঘটনায় পুলিশের দায়ের করা ৪টি বিভাগীয় মামলার তদন্ত চলছে। কলেজে হামলা ও শিক্ষক হেনস্তার ঘটনার ৯ দিন পর ২০২২ সালের ২৭ জুন দুপুরে নড়াইল সদর থানায় পৃথক আরেকটি মামলা করেন পুলিশের উপ-পরিদর্শক ও মির্জাপুর ফাঁড়ির ইনচার্জ শেখ মোরছালিন। এ মামলায় অজ্ঞাত পরিচয় ১৭০ থেকে ১৮০ জনকে আসামি করা হয়। কয়েকজন আসামী গ্রেফতার হলেও তারা অল্পদিনের মধ্যে জামিন পান। তবে ঘটনার শুরু থেকেই জিবি’র সভাপতি এ্যাডভোকেট অচিন চক্রবর্তী সতর্ক ছিলেন যাতে কোন ভাবেই তার পছন্দের শিক্ষক আকতার হোসেনের কোন কিছু না হয়। তাই তিনি ঘটনার কয়েক দিন পরেই জিবি’র সভা ডেকে ১৮ জুনের ঘটনায় স্থানীয় শিক্ষকদের ভূমিকার প্রশংসা করে তাদের ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে রেজুরেশন করেন। এ কাজ করে তিনি একদিকে শিক্ষক আকতার হোসেনকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছেন,অপরদিকে শিক্ষকদের মধ্যে গ্রুপিং বাড়িয়ে দিয়েছেন। এরপর আবারও শিক্ষক আকতার হোসেনের পক্ষে সরাসরি অবস্থান নিয়ে অত্যন্ত নোংরা ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে তার পক্ষে আবার রেজুলেশন করে দিয়েছেন যাতে মাউশি’র ডিজি তার এমপিও বন্ধ না করেন। ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসকে মারধর ও জুতার মালা দিয়ে লাঞ্ছিত করার ঘটনায় বাংলাদেশ সহ সারা বিশ্বে তোলপাড় হয়েছে। গোটা দেশের শিক্ষক সমাজের হৃদয়ে রক্ত ক্ষরণ হয়েছে। অপরাধীদের ন্যুনতম শাস্তি বা তিরস্কারের মত কোন কিছু না হওয়ায় শিক্ষক সমাজে চাপাক্ষোভ বিরাজ করছে। সচেতন শিক্ষক সমাজ শিক্ষক স্বপন কুমার বিশ্বাসের নিরাপত্তা জোরদার করার পাশাপাশি এ ঘটনার তদন্ত সাপেক্ষে প্রকৃত অপরাধীদের দৃষ্টান্তমুলক শাস্তির প্রত্যাশা করেন।