হুমায়ুন কবীর রিন্টু , নড়াইল : নড়াইল পৌরসভায় দুর্নীতি অনিয়মের শেষ নেই। এ পৌরসভার দুর্নীতির বরপুত্র সাইফুজ্জামান জামান। তিনি দীর্ঘকাল ধরে এ পৌরসভার হিসাব রক্ষক হিসেবে দ্বায়িত্ব পালন করছেন। পৌরসভায় লুটপাট করে নিজ নামে, স্ত্রী,শ্যালক এবং আত্নিয়দের নামে শতকোটি টাকার সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। অধিকাংশ সম্পদ সম্পত্তি অন্যের নামে। অপরদিকে পৌরসভা কেন্দ্রিক দুর্নীতিতে কাগজ কলমে তিনি অতি মাত্রায় সতর্ক। সে কারনে ধূর্ত জামান সবকিছুতেই যেন ধরা ছোয়ার বাইরে। তদুপরি অপরাধ করলে প্রমানতো থেকেই যায়। তথ্যানুসন্ধানে যার বাস্তব প্রমান মিলেছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, নড়াইল পৌরসভা পরিচালিত হয় হিসাব রক্ষক জামানের একক নেতৃত্বে। যখন যিনি মেয়র হন, তাকে সুকৌশলে বশ করে ও জিম্মি করে নির্বিঘ্নে দুর্নীতি অনিয়ম চালিয়ে যান। আঞ্জুমান আরা মেয়র নির্বাচিত হলে বরাবরের ন্যায় অল্পদিনের মধ্যে তাকে বশ করে নেন। দু‘জনের মধ্যে মা-ছেলে সম্পর্ক হয়ে যায়। এরপর চলতে থাকে হরিলুট।
গত ৫ আগস্টে বৈষম্য বিরোধি ছাত্র-জনতার সাথে সরকার দলীয় নেতা-কর্মীদের সংঘর্ষের সময় নড়াইল পৌরসভায় ভাংচুর চালানো হয়। এ সময় প্রায় ২৫টি জানালা, ১টি গ্লাস ডোর, সিসি ক্যামেরা সহ কিছু মালামাল ভাংচুর হয়। একটি পানির মোটর নিয়ে যায়। সংশ্লিষ্টদের ধারনা মতে যার সর্বোচ্চ ক্ষতির পরিমান হতে পারে ২০লাখ টাকা। অথচ ক্ষতির পরিমান দেখানো হয়েছে ৪০ লাখ ২১ হাজার ১০টাকা। ভাংচুরের মিথ্যা তথ্য বিবরন দিয়ে তার মধ্যে ৪টি এসি,৪টি কম্পিউটার,পেলুডার,এস্কেভেটার,২টা মোটরসাইকেল, সাবমারসেবল পাম্প, ট্রাক ইত্যাদির ক্ষতি দেখিয়ে ৪০ লাখ টাকার বেশি ক্ষয় ক্ষতি দেখানো হয়েছে। অস্বাভাবিক ক্ষয় ক্ষতির হিসেব দুর্নীতির অশনি সংকেত ছাড়া আর কিছুই না।
নড়াইল পৌরসভা ভবনের পাশের মৌসুমি সুপার মার্কেট (দ্বিতল ভবন) টি নিলাম কমিটির অনুমোদন ও কোন প্রকার টেন্ডার ছাড়াই ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। কোন প্রকার টেন্ডার বা অনুমোদন ছাড়াই সেখানে নতুন করে বহুতল ভবন নির্মান করা হচ্ছে। একই ভাবে রূপগঞ্জ বাজারের এবতেদায়ি মাদরাসা ভবন ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে কোন নিলাম কমিটির অনুমোদন ছাড়া।
পৌরসভার সমস্ত টেন্ডার কাজ পছন্দ মত নির্ধারিত ঠিকাদারদের ফার্মের নামে নির্বাচন করেন। অধিকাংশ লাভজনক কাজ তিনি অন্যের নামে নিজেই করেন। তার পক্ষে এসব কাজ দেখাশোনা করেন পৌরসভার কর্মচারি টিপু সুলতান ও নাসির উদ্দিন। আর এসব কাজের বালি,সিমেন্ট,মাটি, পাথর পরিবহন করা হয পৌরসভার গাড়ি দিয়ে। রাস্তার কার্পেটিং কাজ করা হয় পৌরসভার রুলার দিয়ে। ঠিকাদারী কাজ হলেও এসব যানবাহনের তেলের টাকা পরিশোধ করা হয় পৌরসভার তহবিল হতে। অন্যের নামে অধিকাংশ কাজের ঠিকাদার জামান নিজেই। নড়াইল শহর বাজারের জগদিশ ট্যাংক‘র জায়গার মালিক নড়াইল জেলা পরিষদ। হিসাব রক্ষক জামানের উর্বর মস্তিস্কের বুদ্ধিতে ওই জায়গা হাল জরিপে পৌরসভার নামে রেকর্ড করা হয় এবং পৌরসভার টাকায় ওই জায়গা বালু দিয়ে ভরাট করা হয়। সেখানে পশু ও প্রানি সম্পাদ মন্ত্রনালয়ের অধিনে শহর বাজার চান্দি সেড নির্মান কাজ হচ্ছে টেন্ডারের মাধ্যমে। জেলা পরিষদের জায়গা হওয়ায় এ কাজে বাধা দেন জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এ্যাডভোকেট সুবাস চন্দ্র বোস। হিসাব রক্ষক জামানের নেতৃত্বে এ্যাডভোকেট সুবাস চন্দ্র বোসকে অপমান সুচক কথা বলে এবং হুমকি দিয়ে হটিয়ে দেয়া হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। জোরপূর্বক সেখানে রাতের আধারে কাজ চালানো হয়। এ কাজের ঠিকাদারের বাড়ি ঝিনাইদহ। ঝিনাইদহের ওই ঠিকাদারকে ম্যানেজ করে কাজটি করছেন হিসাব রক্ষক জামান। কাজে খুবই নিম্নমানের নির্মান সামগ্রী ব্যবহার হচ্ছে। সবকিছু জামানের নিয়ন্ত্রনে থাকায় দেখার কেউ নেই।
বাজার চান্দির পশ্চিম পাশে দোকান ঘর বরাদ্দ দেয়া নিয়ে রয়েছে নানা অভিযোগ। বেশি টাকায় চুক্তি করে তাদের নিকট হতে নগদ টাকা নেয়া হয়েছে। এরপর ডিডি করে নাম মাত্র মূল্য জমা দেয়া হয়েছে। দোকান ঘর ডিড এর টাকা পে অর্ডার বা ব্যাংক ড্রাফট এর মাধ্যমে নেয়ার কথা। শুধুমাত্র ব্যক্তিগত ভাবে লাভবান হওয়ার জন্য নগদ টাকা নেয়া হয়। তবে সব দোকানীকে সুন্দর করে মন্ত্র পড়িয়ে দেয়া হয় যে, কেউ জানতে চাইলে বলবেন এতো টাকা ব্যাংকের মাধ্যমে দিয়েছেন। এর বাইরে কোন কথা বললে আপনার ডিড ক্যান্সেল করা হবে।
জামান নিজের অবস্থান পাকাপোক্ত করতে পৌরসভায় আধা ডজন আত্নিয়স্বজন চাকরি দিয়েছেন। বড় শ্যালক রাশেদুল ইসলামকে নলকুপ মিস্ত্রি পদে নিয়োগ দিয়েছেন। তাকে নড়াইল জেলা কারাগারের দক্ষিণ পাশে জমি কিনে একতলা বাড়ি করে দিয়েছেন। ছোট বোন জামাই মহিদুল ইসলাম ও চাচাতো ভাই আল আমিনকে বিদ্যুৎ লাইনম্যান পদে চাকুরী দিয়েছেন। বড় বোনের ছেলে ইমরুল হাসান লাবলু কে অফিস সহায়ক পদে চাকুরী দিয়েছেন। নড়াইল শহরে নামে বেনামে একাধিক বাড়ি রয়েছে। নড়াইল সদর উপজেলার আউড়িয়ায় তার নিজ গ্রামে রয়েছে অঢেল সম্পত্তি। এসব সম্পত্তি তিনি বোনের নামে, শালার নামে, ভাগ্নের নামে এবং অন্যান্য আত্নিয় স্বজনের নামে করেছেন। তার বড় ছেলে চায়না তে বে-সরকারি মেডিকেলে পড়তেছে।
পৌরসভার যাবতীয় কর্মকান্ড জামানের একক নেতৃত্বে চলে। তার একান্ত অনুগত পৌরসভার কর্মচারী টিপু ও নাছির রুলার ভাড়া, এস্কেভেটর ভাড়া, ট্রাক ভাড়া, পেলুডার ভাড়া সহ যাবতীয় যানবাহন এর দায়িত্ব পালন করে। এরা দু‘জন জ্বালানি তেল নিয়ন্ত্রণ করে। ভাড়ার টাকা ঠিক মত জমা না দিয়ে সুকৌশলে আত্নসাৎ করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।
পৌরসভার নির্ধারিত বেতনে ঝাড়ুদার পোষ্টে প্রায় ৯৬ জনের নাম তালিকায় দেয়া রয়েছে। তাদেরকে ব্যাংকের মাধ্যমে ভাতা প্রদান করা হয়। বাস্তবে তাদের মধ্যে কাজ করেন ৬০ জনের কম। অতিরিক্ত ব্যক্তিদের নামের টাকা তাদেরকে ম্যানেজ করে সুকৌশলে আত্নসাৎ করা হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
নড়াইল শহরের আলাদাতপুরের বাসিন্দা প্রকৌশলি মোঃ নাজমুল হাসানকে নির্ধারিত বেতনে চাকুরী দিয়েছেন অসৎ উদ্দেশ্যে। তাকে দিয়ে পৌরসভার প্রকৌশল শাখা’র প্লান সেকশনের যাবতীয় কাজ করানো হয়। নির্ধারিত রেটের অতিরিক্ত টাকা প্লান অনুমোদনের জন্য নেয়া হয়। তবে অতিরিক্ত টাকা নেয়ার কোন রশিদ দেয়া হয় না। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে প্লান অনুমোদনের কপি সরবরাহ করা হয় না। এসব কিছুর নাটের গুরু হিসাব রক্ষক জামান।
এলজিইডি’র আইইউআইডিপি প্রকল্পের অর্থায়নে প্রায় ৬ কোটি টাকায় নড়াইল পৌরসভা ভবনের পিছনের পুকুর সৌন্দর্য্য বর্ধনের কাজের ঠিকাদার মেসার্স ইডেন প্রাইজ। কিন্তু ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে হিসাব রক্ষক জামান কাজটি নিজেই করেন বলে গুঞ্জণ রয়েছে। ওই কাজে নিম্নমানের নির্মান সামগ্রী ব্যবহার করা হয়েছে। এ কাজ তদারকি করেন জামানের একান্ত অনুগত প্রকৌশলি নাজমুল হাসান। ব্যাপক দুর্নীতি অনিয়মের মাধ্যমে নড়াইল পৌরসভায় প্রায় ১০জন কর্মচারী নিয়োগ দেয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন হিসাব রক্ষক জামান।
হিসাব রক্ষক জামান নিজেকে নির্দোষ দাবি করে বলেন, তিনি কেবলমাত্র চাকুরী করেন। তার নামে কোন ঠিকাদারী লাইসেন্স নেই। তাই তিনি পৌরসভার কোন কাজ করেননি। কোন অবৈধ সম্পদ অর্জন করেননি। অহেতুক একটি দুষ্টু চক্র তার বিরূদ্ধে বিভিন্ন দফতরে মিথ্যা তথ্য দিয়ে তাকে হয়রানী করছেন। সদ্য সাবেক মেয়র আঞ্জুমান আরা এলাকায় না থাকায় এবং মেবাইল বন্ধ থাকায় এ ব্যাপারে তার কোন মন্তব্য পাওয়া যায়নি।