
সাতক্ষীরা প্রতিনিধি : বৈশ্বিক ঊষ্ণায়ণ ও জলবায়ুর পরিবর্তন জণিত প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং ডেমোগ্রাফির জন্য যে সব চ্যালেঞ্জের কথা বলা হচ্ছে সে সবের প্রতিটা ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ সবচে ক্ষতিগ্রস্ত হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে। ফসিল জ্বালানীর মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার, শিল্প ও নগরায়ণের প্রয়োজনে বনভ’মি হ্রাস এবং যান্ত্রিক ও রাসায়নিক নির্ভর কৃষি ব্যবস্থাই হচ্ছে গ্লোবাল ওয়ার্মিং, ওজোন স্তরের ক্ষয়সহ নানাবিধ বিপত্তির মূল অনুঘটক। তৃতীয় বিশ্বের একটি দরিদ্র-উন্নয়নশীল দেশ হওয়া সত্বেও বাংলাদেশ কেন জলবায়ু পরিবর্তন এবং পরিবেশগত বিপর্যয়ের সম্মুখীন হচ্ছে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে বাংলাদেশের চলমান সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতা ও ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জগুলোও বেরিয়ে আসতে পারে। পরিবেশ বিজ্ঞানীরা গতানুগতিক বৈশ্বিক জলবায়ু সমস্যার বাইরে বাংলাদেশের জন্য আরো কঠিন ও অস্বাভাবিক পরিবেশগত বিপর্যয়ের আশঙ্কা করেছিলেন আরো দেড় দশক আগেই। গত এক দশকে বাংলাদেশের উপর সিডর ও আইলার মত একাধিক দানবীয় সামুদ্রিক ঘুর্ণীঝড় আঘাত হানার মধ্য দিয়ে জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশের বিপদ ইতিমধ্যেই প্রমানিত হয়েছে। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের বৈশ্বিক এজেন্ডাগুলোর বাইরে বাংলাদেশে যে সব জাতীয় ও আঞ্চলিক ভ‚-প্রাকৃতিক ও অপতৎরতার সম্মুখীন হচ্ছে সে সব তৎপরতাই বাংলাদেশকে বড় ধরনের পরিবেশগত বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। আন্তর্জাতিক নদী আইন এবং কনভেনশন লঙ্ঘন করে যৌথনদীগুলোর উপর উজানে ভারতের একতরফা নিয়ন্ত্রণ ও পানি প্রত্যাহারের অব্যাহত তৎপরতা এই মুহূর্তে বাংলাদেশের জন্য সবচে বড় বহুমাত্রিক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইতিমধ্যে দেশের শত শত নদ নদীর অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গেছে। প্রধন প্রধান নদীগুলোর বিশাল অংশ নাব্য হারিয়েছে। যে সব নদী প্রবহমান আছে, তার সবগুলোই উজানের এবং বাংলাদেশের আভ্যন্তরীন দূষণ ও অপদখলের শিকার হয়ে মারাত্মক পরিবেশগত বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছে। পদ্মা, যমুনা, তিস্তা থেকে থেকে শুরু করে বিশেষ গুরুত্বপূর্ন নৌ-অঞ্চল হালদা এবং সুন্দরবন এখন বড় ধরনের বিপর্যয়ের মুখোমুখী। এমন কি অনেক প্রত্যাশা জাগানিয়া বঙ্গোপসাগরেও এখন পরিবেশগত দূষণের ছোবল ক্রমে স্পষ্ট হয়ে উঠতে শুরু করেছে। বেশ কয়েক বছর আগে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানা গিয়েছিল, বঙ্গোপসাগরে সামুদ্রিক চিংড়ির পোনার পরিমান অস্বাভাবিক হারে হ্রাস পেয়েছে। পত্রিকায় প্রকাশিত সেই রিপোর্টে বঙ্গোপসাগরের বাংলাদেশের অংশে মাছের বিচরণক্ষেত্র থেকে মাছ সরিয়ে নিতে প্রতিবেশী দু’একটি দেশের নানা ধরনের সাবোটাজমূলক কর্মকান্ডের বিবরণ উঠে এসেছিল। বাংলাদেশের সাথে ভারত ও মিয়ানমারের সমুদ্রসীমা বিরোধ অমিমাংসিত ইস্যুটি যখন আন্তর্জাতিক আদালতের মাধ্যমে মিমাংসিত হতে যাচ্ছিল, ঠিক সে সময় বঙ্গোপসাগরের বাংলাদেশ অংশে সাবোটাজ এবং মাছের বিচরণক্ষেত্র বাংলাদেশ থেকে সরিয়ে দেয়ার উদ্দেশ্যমূলক তৎপরতা উপকুলীয় মৎস্যজীবী ও সমুদ্রসম্পদ বিশেষজ্ঞদের মধ্যে চিন্তার ভাঁজ ফেললেও এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা ও নজরদারির কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। এ সুযোগে বঙ্গোপসাগরে বিদেশী জেলে ও নৌদস্যুদের অনুপ্রবেশ বৃদ্ধি, অবাধে মৎস্য শিকার ছাড়াও বাংলাদেশী জেলেদের ধরা মাছ লুটে নেয়ার অসংখ্য ঘটনা ঘটেছে। তারা শুধু মাছ ও ফিশিংবোট ছিনতাই করেই ক্ষান্ত হয়নি। জেলেদের জিম্মি করে লাখ লাখ টাকা মুক্তিপণ আদায়েরও অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে।
সমুদ্রসীমা বিরোধ মিটে যাওয়ার পর আমরা জাতির সামনে বঙ্গোপসাগরের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের নানাবিধ সম্পদ আহরণ তথা ব্লু ইকোনমির বিশাল সম্ভাবনাময় স্বপ্নের ডালা মেলে ধরেছিলাম। বঙ্গোপসাগরের তলদেশে গ্যাস, পেট্টোলিয়ামসহ মূল্যবান খনিজ সম্পদের বিশাল অর্থনৈতিক সম্ভাবনা ছাড়াও নগদ লাভ হিসেবে বঙ্গোপসাগর প্রতি বছর আমাদের জন্য লাখ লাখ টন মাছের যোগান দিয়ে আমাদের খাদ্য, পুষ্টির চাহিদা পুরণের প্রধান উৎস্য হয়ে আছে। বঙ্গোপসাগরের মোহনা থেকে আমাদের পদ্মা-মেঘনার মিঠা পানিতে ডিম ছাড়তে আসা ইলিশ মাছ বিরল বৈশিষ্ট্যমন্ডিত মৎস্য প্রজাতি হিসেবে বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। প্রতিবেশী বড় দেশ ভারত তিন দিক দিয়ে সমুদ্রবেষ্টিত হলেও বাংলাদেশের ইলিশের মত সুস্বাদু ইলিশ বা অন্য কোন মাছের এমন আধার সেখানে নেই। এ কারণে বাংলাদেশের ইলিশ ভারতীয়দের রসনার তৃপ্তির অন্যতম অভীষ্ঠ। বাংলাদেশের ইলিশ ভারতের সাথে বিনিময়, বাণিজ্যিক ও ক‚টনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ন ভ‚মিকা পালন করতে দেখা গেছে। দুই দেশের শীর্ষ পর্যায়ের সফরে উপহার ও মেন্যুতেও পদ্মার সুস্বাদু ইলিশের অবস্থান লক্ষ্য করা যায়। বঙ্গোপসাগর বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপসহ দক্ষিন এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশে বিস্তৃত হলেও সুগন্ধ ও সুস্বাদু ইলিশের বিচরণ শুধুমাত্র বাংলাদেশের নদী মোহনায়ই দেখা যায়। বলা যায়, বাংলাদেশের জন্য এটি প্রকৃতির এক পরম দান। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ভারতের ফারাক্কা বাঁধের কারণে পদ্মানদীর প্রবাহে বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা তৈরী হওয়ায় পদ্মার নাব্য সংকটের পাশাপাশি ইলিশের বিচরণ ক্ষেত্র ক্রমে সঙ্কুচিত হতে শুরু করে। পদ্মার শত শত শাখানদী শুকিয়ে বিলীন হয়ে গেছে। অপেক্ষাকৃত সংকীর্ণ, চরপরা পদ্মায় যখন ইলিশের আকাল দেখা দিয়েছিল তখন বাংলাদেশ সরকারের কিছু সময়োপযোগী সিদ্ধান্তের কারণে মাত্র দুই দশকের মধ্যে ইলিশের উৎপাদন দ্বিগুনের বেশী বেড়েছে। গত বছর জাটকা সংরক্ষণ সপ্তাহ উপলক্ষ্যে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে মৎস্য ও প্রাণীসম্পদ মন্ত্রী উপস্থাপিত তথ্য অনুসারে, ২০০৮-৯ অর্থবছরে যেখানে দেশে ইলিশ উৎপাদিত হয়েছিল ৩ লাখ মেট্টিক টনের কম সেখানে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ইলিশ আহরিত হয়েছিল প্রায় লাখ টন। গত বছর ইলিশ ধরা পড়েছিল প্রায় ৫ লাখ টন। ইলিশ আহরণ ও বিপণনের সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় ২৫ লাখ লোক জড়িত এবং জিডিপিতে শুধুমাত্র ইলিশের অবদান এক শতাংশের বেশী। ইলিশ ছাড়া দেশের রফতানীমুখী চিংড়ি খাত, হিমায়িত মৎস্য রফতানীর মূল উৎস্যই হচ্ছে বঙ্গোপসাগর। সাময়িকভাবে জিডিপিতে মৎস্যখাতের অবদান প্রায় ৪ ভাগ এই সাগর এবং সুন্দরবনের নিরাপত্তার উপর বাংলাদেশের অর্থনৈতিক, পরিবেশগত ও সার্বভৌম নিরাপত্তার অনেক কিছুই নির্ভরশীল। এ কারণেই বাংলাদেশের নিরাপত্তার পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যবস্তু হিসেবে বঙ্গোপসাগর এবং সুন্দরবন সবচেয়ে বেশী গুরুত্ব পাওয়ার দাবী রাখে। আধুনিক বিশ্বের কোন সমর প্রযুক্তি, কোন প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাই আইলা, সিডর বা ক্যাটরিনার মত সামদ্রিক ঘূর্ণীঝড় প্রতিরোধের ক্ষমতা রাখে না। আমাদের সুন্দরবন বার বার দেশকে এমন সব প্রাকৃতিক দুযোর্গ থেকে রক্ষা করেছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বঙ্গোপসাগরে জেলেরা যে হারে বিদেশি নৌদস্যুদের ডাকাতি, লুণ্ঠনসহ সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের শিকার হয়েছে, তাতে আমাদের কোস্টগার্ডের টহল ও নজরদারির ব্যর্থতা ও অপ্রতুলতা বার বার প্রমানিত হয়েছে। আর সুন্দরবনের নিরাপত্তা ও ভবিষ্যত নিয়ে যে সব আশঙ্কা দেখা দিয়েছে তা নতুন করে বর্ননার প্রয়োজন নেই। তবে এটুকু আবারো বলা যায়, রামপাল বিদ্যুতকেন্দ্র নির্মানের আত্মঘাতি সিদ্ধান্ত গ্রহনের সাথে সাথে সুন্দরবনের আশপাশে শত শত ভারী শিল্পকারখানার অনুমোদন দিয়ে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বনের ভবিষ্যত নিয়ে আমাদের সরকারের নীতি নির্ধারকরা অনেক বড় ঝুঁকি নিয়েছেন। ভারত ও বাংলাদেশ সরকারের যৌথ প্রযোজনায় সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশ আগামী কয়েক দশকের মধ্যে নিশ্চতভাবেই অস্তিত্বের সংকটে পড়তে যাচ্ছে। সুন্দরবন বিশ্বের প্রধান ম্যানগ্রোভ বন এবং ইউনেস্কো ও রামসার কনভেনশনের তালিকাভুক্ত অন্যতম বিশ্বঐতিহ্য। সুন্দরবনের বেশীরভাগ অংশ বাংলাদেশে পড়লেও এর প্রায় ৪০ শতাংশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গে পড়েছে। যে কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পটি বাগেরহাটের রামপালে নির্মিত হতে যাচ্ছে সেটি সুন্দরবনের ভারতীয় অংশে বা বিকল্প স্থানে অনুমোদন পায়নি। তাদের আইন ববভ’মির আশপাশে এ ধরণের বৃহদাকার কয়লা বিদ্যুত প্রকল্প অনুমোদন দেয়না। ভারতীয়দের আগ্রহে সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে রামপাল বিদ্যুতকেন্দ্র নির্মানের আয়োজন শুরুর পাশাপাশি সে অঞ্চলে ভারী শিল্প কারখানা গড়ে তোলার অবাধ কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর থেকেই সুন্দরবন ও বঙ্গোপসাগরে নানাবিধ দুর্ঘটনা, দূষণ ও বিপর্যয় চরম আকার ধারণ করে। একের পর এক তেল ও ফার্নেস অয়েলবাহী জাহাজ ডুবি, সিমেন্ট ও ক্লিংকারবাহী জাহাজ, সার, ফ্লাইঅ্যাশ সহ শিল্পকারখানার নানা ধরনের রাসায়নিক পন্যবাহী জাহাজ ডুবির ঘটনাকে অনেকেই সাধারণ নৌদুর্ঘটনা বলে মানতে নারাজ। সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে বড় ধরনের পরিবেশগত বিপর্যয় সৃষ্টির লক্ষ্যে কোন পক্ষ সাবোটাজ করছে বলে যে সব অনুযোগ-অভিযোগ বিভিন্ন সময়ে উঠে এসেছে তা পুরোপুরি অগ্রাহ্য করা যায়না। ইতিমধ্যেই সুন্দরবনের দুই অংশের মধ্যে কিছু সুস্পষ্ট পার্থক্য দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশ অংশে সুন্দরী গাছ, রয়েলবেঙ্গল টাইগার যখন আশঙ্কাজনকভাবে কমছে, তখন ভারতীয় অংশে লক্ষ্যনীয় উন্নতি ঘটতে দেখা যাচ্ছে। বনের অভ্যন্তরে বার বার অগ্নিকান্ড, শব্দ দূষণকারী যাত্রীবাহী লঞ্চ ট্রলার, বনের নৌচ্যানেলে বাণিজ্যিক জাহাজ চলাচলের অনুমোদন এবং পণ্যবাহী জাহাজ দুর্ঘটনার কারণে বনজ ও জলজ প্রাণীরা অপেক্ষাকৃত নিরাপদ তথা অভয়ারণ্য হিসেবে ভারতীয় অংশে আশ্রয় গ্রহণ করবে, এটাই স্বাভাবিক। অতএব এটা মানতেই হবে সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশ যে সব বিপর্যয়-বিপত্তির সম্মুখীন হচ্ছে তাতে পরোক্ষভাবে লাভবান হচ্ছে ভারত। ২০১৩ সালে সুন্দরবনের শেলা নদীতে ফার্নেস অয়েলবাহী জাহাজ ডুবির পর সেখানকার পানি, মাটির গুনাগুণ ও উদ্ভিদের খাদ্যচক্রে যে দূষণ দেখা গেছে এবং তাৎক্ষনিকভাবেই মাছসহ নানা প্রজাতির অসংখ্য জলজ প্রানী, পাখির মৃত্যু ঘটেছে। এ ধরনের দুর্ঘটনায় বনের ইকো সিস্টেমের দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতি অনিবার্য। সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে শিল্পায়ণ, অগ্নিকান্ড, বাণিজ্যিক জাহাজে বর্জ্য ও নৌদুর্ঘটনার ফলে বনের ভারতীয় অংশের সাথে সুস্পষ্ট পার্থক্য তৈরী করতে সহায়ক হচ্ছে। সুন্দরবনের প্রাণ-প্রকৃতি নিয়ে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের একটি গবেষণা জরিপের আলোকে একটি রিপোর্ট সম্প্রতি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। সেখানে সুন্দরবন এলাকায় রামপাল বিদ্যুতকেন্দ্রসহ ভারীশিল্প নির্মানের আগে ও পরের এবং ভারীশিল্প বর্হিভ’ত অঞ্চলের অবস্থার বড় ধরনের ব্যবধান ধরা পড়েছে। পানির ফাইটোপ্লাঙ্কটন, জুপল্যাঙ্কটন ও বেনথোসের উপস্থিতি হ্রাস উদ্বেগজনক বলে চিহ্নিত হয়েছে। মাত্র দুই বছরে(২০১৫-২০১৬) এই ব্যবধান এবং অন্তত ১০ প্রজাতির মাছের অনুপস্থিতি এবং প্রতি লিটার পানিতে মাছের ডিমের হার চারভাগের একভাগে নেমে আসার চিত্র খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্র বিজ্ঞান বিভাগের ৭ সদস্যের গবেষনা দলের রিপোর্টে প্রকাশিত হয়েছে।
বিশ্বের বেশ কিছু রাষ্ট্রের জাতীয় অর্থনীতির প্রধান খাত সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদ। বিশ্বের অন্তত ৩৫ কোটি মানুষের জীবিকা সরাসরি সমুদ্রের উপর নির্ভরশীল। সাত মহাসমুদ্র ছাড়াও বিশ্বে অনেক সাগর, উপসাগর ও শত শত হ্রদ রয়েছে। এসব সাগর মহাসাগরের মধ্যে অর্থনৈতিক ও ভ’রাজনৈতিক গুরুত্বের দিক থেকে বঙ্গোপসাগরের একটি আলাদা বৈশিষ্ট্য ও অবস্থান আছে। বিশ্বের সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদের অন্তত ১৬ ভাগের যোগান দেয় বঙ্গোপসাগর। বাংলাদেশের মৎস্য সম্পদ আহরণের প্রায় একচতুর্থাংশের উৎস বঙ্গোপসাগর ও সুন্দরবন। বঙ্গোপসাগর ৪৭৫ প্রজাতির মাছের বিচরণক্ষেত্র, এখান থেকে বছরে ৬৬ লাখ টন মৎস্য আহরণের সুযোগ রয়েছে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন। মাছের পাশাপাশি বøু ইকোনমির যে বিশাল সম্ভাবনার কথা বলা হচ্ছে তা যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা গেলে বাংলাদেশের অর্থনীতি উন্নয়নশীলতার গন্ডি ডিঙিয়ে মধ্য আয়ের কাতারে পদার্পণ করতে পারে। আবাদযোগ্য উর্ব্বর ভ‚মির পাশাপাশি আভ্যন্তরীণ ও সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদ বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তা ও রফতানী বাণিজ্যের জন্য প্রকৃতির অকৃত্রিম দান। তবে বাংলাদেশের সমুদ্রসম্পদ নিয়ে প্রতিবেশী কয়েকটি দেশের ষড়যন্ত্রমূলক কর্মকান্ডের অভিযোগও কোন নতুন বিষয় নয়। বিভিন্ন সময়ে এ বিষয়টি সংশ্লিষ্টদের কাছে স্পষ্ট হলেও সরকারের তরফ থেকে প্রতিকার ও প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা না নেয়ার কারণে বঙ্গোপসাগরের নিরাপত্তা এখন বড় ধরনের হুমকির সম্মুখীন। যখন আমরা আমাদের বøু ইকোনমি নিয়ে অতিমাত্রায় আশাবাদি হয়ে উঠেছি, তখন আমরা দেখতে পাচ্ছি- বঙ্গোপসাগরের উপুলে এবং বাংলাদেশের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল বড় ধরনের পরিবেশগত দূষণের শিকার হয়ে পড়ছে। গত রবিবার ইনকিলাবে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বঙ্গোপসাগর মৎস্যশূণ্য হয়ে পড়ার আশঙ্কার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। সামদ্রিক জাহাজ থেকে ফেলা বর্জ্যে বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের সীমান্তে অস্বাভাবিক দূষণের ফলে পানির অক্সিজেন প্রায় শূণ্যের কোঠায় নেমে গেছে বলে সাম্প্রতিক এক গকেষনা জরিপ থেকে জানা যায়। এ ধরনের অক্সিজেন শূণ্য জোন বা অঞ্চলে সামুদ্রিক মৎস্য ও উদ্ভিদ জন্মাতে বা বেঁচে থাকতে পারেনা। বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় এ ধরনের অক্সিজেনশূণ্য অঞ্চল সৃষ্টির ঘটনা আগে কখনো শোনা যায়নি। ঘটনা যদি সত্য হয়, তবে অচিরেই সাগরের এ অঞ্চল মৎস্যশূন্য হয়ে পড়তে পারে বলে সমুদ্র বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন। বঙ্গোপসাগরে মাত্রাতিরিক্ত দূষণ এবং পরিবেশগত বিপর্যয় সৃষ্টির আশঙ্কা অনেক আগে থেকেই সমুদ্র বিজ্ঞানীরা প্রকাশ করলেও এ ক্ষেত্রে কার্যকর নজরদারি ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তোলার তেমন কোন পদক্ষেপ দেখা যায়নি। বাইরের দেশ থেকে আমাদের সমুদ্রসীমায় বর্জ্য ফেলার পাশাপাশি নাশকতামূলক কর্মকান্ডের কারণে = যেমন এ ধরনের জোন সৃষ্টি হতে পারে সেই সাথে দেশের অভ্যন্তরে শিল্পবর্জ্য, কৃষিব্যবস্থায় ব্যবহৃত লাখ লাখ টন রাসায়নিক সার, কীটনাশকসহ নানাবিধ রাসায়নিকের ব্যবহার নদী নালাগুলোতে মারাত্মকভাবে দূষিত করেছে। নদীনালার সব দূষিত পানির চ‚ড়ান্ত গন্তব্যস্থল হচ্ছে সমুদ্র। আভ্যন্তরীণ রাসায়নিক দূষণের পাশাপাশি আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক প্রতিবেশী কোন পক্ষের অন্তর্ঘাৎমূলক তৎপরতার কারণে বঙ্গোপসাগর অচিরেই মৎস্যশূণ্য হয়ে পড়ার আশঙ্কা বাংলাদেশের জন্য এক ভয়াবহ উদ্বেগের বিষয়। তবে আমাদের সমুদ্রবিজ্ঞানীরা এখনি মুখ খুলতে চাইছেননা। তারা আরো গবেষণার কথা বলছেন। চলতি বছর নাগাদ আরো গবেষনার অংশ হিসেবে আগস্টের মধ্যে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি সমৃদ্ধ নরওয়েজীয় গবেষনা জাহাজ আর ভি ড. ফ্রিটজফ নেনসেন-৩ শ্রীলঙ্কা থেকে বাংলাদেশে আসবে বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মেরিন সায়েন্সেস অ্যান্ড ফিশারিজ বিভাগের এক গবেষক। এ ধরনের গবেষণা জরিপ আরো বহু আগেই হওয়া উচিত ছিল। তবে দেশের সমুদ্রসীমা ও সমুদ্র সম্পদের নিরাপত্তা কোন জরিপ বা গবেষণা রিপোর্টের ভিত্তিতে নির্ধারিত হতে পারেনা। এটি দেশের নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর প্রধান দায়িত্ব। এ দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার কোন সুযোগ নেই। নদনদীর দূষণ ও অস্তিত্ব সংকট, হাওরে বিপর্যয়, সুন্দরবনের নিরাপত্তা এবং বøু ইকোনমির বিশাল সম্ভাবনাময় বঙ্গোপসাগরে দূষণ ও বিপর্যয়ের কারণ উৎঘাটনের পাশাপাশি সতর্ক নজরদারি ও উন্নত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা জরুরী। তা নাহলে আমাদের সব স্বপ্ন ও সম্ভাবনা প্রতিবেশী দেশগুলোর ভ‚-রাজনৈতিক স্বার্থের শেকলে বন্দি হয়ে পড়বে। মারাত্মক জলবায়ু বিবর্তনে দেশের অস্তিত্ব বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তনজণিত বিপর্যয় বর্তমানে তা অন্যতম বৈশ্বিক সংকট হিসেবে দেখা দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অন্যতম ভালনারেবল কান্ট্রি হিসেবে চিহ্নিত। জলবায়ু ও পরিবেশগত নিরাপত্তাহীনতার কারণে বিশ্ব নতুন নতুন প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্মুখীন হচ্ছে। আমাদের মত ঘনবসতিপূর্ণ দেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগের পাশাপাশি নদী ও পরিবেশ দূষণে জনস্বাস্থ্য ও খাদ্য নিরাপত্তা চরম হুমকির মুখে পড়েছে। একদিকে উজানে আন্তর্জাতিক নদীর উপর ভারতের বাঁধ নির্মান ও পানি প্রত্যাহারের কারণে আমাদের নদ-নদীগুলো অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে, অন্যদিকে নদীব্যবস্থাপনা, শিল্পকারখানা ও নাগরিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সীমাহীন ব্যর্থতা এবং নদনদী, খালবিল ও জলাভূমির উপর প্রভাবশালী মহলের অব্যাহত দখলবাজি, ভরাট ও দূষণের কারণে নদনদীগুলো বায়োলজিক্যালি মৃত্যুর মুখে পড়েছে। ঢাকার বুড়িগঙ্গাসহ চারপাশের নদনদী, চট্টগ্রামের কর্ণফুলী, চাকতাই খালসহ গুরুত্বপূর্ণ শহরের লাইফলাইন হিসেবে খ্যাত নদনদীগুলো এখন চরমমাত্রার দূষণ ও নাব্যতা হারিয়ে অস্তিত্বের হুমকিতে পড়েছে। এসব নদনদীর নাব্যতা রক্ষা, দূষণ ও দখল প্রতিরোধ করে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে না পারলে শহরের বাসযোগ্যতা ও পরিবেশগত নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।
বুড়িগঙ্গাসহ ঢাকার চারপাশে ঘিরে থাকা তুরাগ, বালু, শীতলক্ষ্যা নদীর দূষণ, দখল-ভরাট ও উচ্ছেদ অভিযান সম্পর্কে অনেক লেখালেখি হয়েছে। গতকাল ইনকিলাবে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বাণিজ্যিক রাজধানী ও বন্দরনগরী চট্টগ্রামের লাইফলাইন কর্ণফুলী নদীর ভয়াবহ দূষণের চিত্র প্রকাশিত হয়েছে। দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের প্রধান আন্ত:সীমান্ত নদী কর্ণফুলী শত শত বছর ধরে এ অঞ্চলের কৃষি, বাণিজ্যিক যোগাযোগ ও লৌকিক জীবনের অন্যতম অনুষঙ্গ হয়ে আছে। স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে অপরিকল্পিত ও ক্রমবর্ধমান হারে অনিয়ন্ত্রিত শিল্পায়ণ, নগরায়ণ ও বাণিজ্যবৃদ্ধির প্রতিযোগিতায় কর্ণফূলী এখন মারাত্মক দূষণের শিকার। বুড়িগঙ্গা ও কর্ণফুলীর দূষণ এমন স্তরে পৌছেছে যে, এদেরকে এখন নদী না বলে তরল বর্জ্যরে ভাগাড় বললেও অত্যুক্তি হয়না। লুসাই পাহাড়ের অজস্র ঝরনা ও ছরার পানির সম্মিলিত প্রশ্রবণ থেকে উৎপন্ন মিঠা পানির বিশাল ভান্ডার কর্ণফুলী প্রায় ৩২০ কিলোমিটার সর্পিল পথ পাড়ি দিয়ে চট্টগ্রামে বঙ্গোপসাগরে এসে মিশেছে। হাজার বছর ধরে এ নদী কোটি মানুষের সুপেয় পানি, কৃষি ও মৎস্যের অন্যতম ভান্ডার হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক ভূমিকা পালন করে এসেছে। আমাদের রাষ্ট্রীয় প্রশাসন ও নাগরিক সমাজের অপরিনামদর্শী অপতৎপরতা ও ব্যর্থতার কারণে কর্ণফুলী ও বুড়িগঙ্গার মত গুরুত্বপূর্ণ নদী এখন বিষাক্ত ও দুর্গন্ধযুক্ত নহরে পরিনত হয়েছে। ছোট-বড় হাজার হাজার কলকারখানার অপরিশোধিত রাসায়নিক বর্জ্য ও প্রতিদিনের নাগরিক বর্জ্যে কর্ণফুলী, বুড়িগঙ্গা ও শীতলক্ষ্যার পানির গুনাগুণ অনেক আগেই নষ্ট হয়ে গেছে। নষ্ট হয়েছে নদীর প্রাকৃতিক পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য এবং মৎস্য, জলজপ্রাণীর বেঁচে থাকার ন্যুনতম যোগ্যতাও।
আন্ত:সীমান্ত নদীসহ দেশের বেশিরভাগ নদীতে এখন বড় বড় চর জেগে পানির স্রােত একেবারে তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। গ্রীষ্মের আগেই দূষণ ও নাব্য সংকট এসব নদীর অস্তিত্ব সংকটের আশঙ্কাকেই জানান দিচ্ছে। অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও শিল্পায়নের হাত ধরে গত কয়েক দশকে দেশ অর্থনৈতিকভাবে অনেক এগিয়েছে। স্বল্প আয়ের দেশ থেকে মধ্য আয়ের দেশে উত্তরণের স্বপ্ন দেখছি আমরা। পক্ষান্তরে আমরা দেখছি আমাদের রাজধানী শহর বিশ্বের বসবাসের অযোগ্য মেগাসিটিগুলোর মধ্যে শীর্ষে অবস্থান করছে। দেশ অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যাচ্ছে আর দেশের রাজধানী, বন্দরনগরীসহ প্রধান শহর ও জনপদগুলো বসাবাসের অযোগ্য হয়ে পড়া, কলকারখানার তরল বর্জ্যে নদ-নদীর পানিতে মারাত্মক রাসায়নিক দূষণ, কারখানা ও ইটভাটার কালোধোঁয়ায় বাতাস ও পরিবেশগত দূষণে জনস্বাস্থ্য ও জনজীবনকে দুর্বিসহ অবস্থার মধ্যে ঠেলে দেয়ার এহেন বাস্তবতাকে কোনোভাবেই উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ বলা চলে না। আমাদের রাষ্ট্র ও সরকারকে অবশ্যই নদনদী ও পরিবেশ দূষণ ও ভূমির অপরিণামদর্শী ব্যবহারের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। বিশেষত নদী দখল ও দূষণ বন্ধের পাশাপাশি অবৈধ ইটভাটা উচ্ছেদ ও কয়লাভিত্তিক বিদ্যুতকেন্দ্র ও শিল্পকারখানার বিকল্প ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
বাংলাদেশের দক্ষিণে অবস্থিত বঙ্গোপসাগর অফুরন্ত সম্পদের ভান্ডার। বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে বঙ্গোপসাগরে ১৭ থেকে ১০৩ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস হাইড্রেটের সন্ধান পাওয়ার কথা জানায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এছাড়া কয়েকশ’ প্রজাতির সি-উইড আবিষ্কারের কথা বলা হয়েছে, যার ফলে আশার প্রদীপ জ্বলে উঠেছে বাংলাদেশের সামনে। এ গ্যাস হাইড্রেটে রয়েছে বিপুল পরিমাণ মিথেন। এটি মূলত উচ্চচাপ ও নিম্ন তাপমাত্রায় গঠিত জমাট বরফ আকৃতির এক ধরনের কঠিন পদার্থ। এটি স্তূপীকৃত বালুর ছিদ্রের ভেতরে ছড়ানো স্ফটিক আকারে অথবা কাদার তলানিতে ক্ষুদ্র পি-, শিট বা রেখা আকারে বিদ্যমান থাকে। এদিকে নেদারল্যান্ডের সঙ্গে মেরিটাইম অ্যাফেয়ার্স ইউনিটের পরিচালিত আরেকটি জরিপে বঙ্গোপসাগরে বিপুল পরিমাণ সি-উইডের সন্ধানও পাওয়া গেছে। এ সি-উইডের বিশাল বাণিজ্যিক সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়া দেশে এর ব্যবহার বাড়িয়ে আমদানিনির্র্ভরতা তো কমানো যাবেই, বিদেশে রপ্তানিও করা যাবে। গবেষণার ফলাফলে দেখা যায়, বাংলাদেশে পাওয়া বহু প্রজাতির সামুদ্রিক শৈবালের মধ্যে কয়েকটির বিপুল বাণিজ্যিক সম্ভাবনা রয়েছে, যা বাংলাদেশের সুনীল অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
বঙ্গোপসাগরের নীলজলের অতলে অফুরন্ত সম্পদের বিষয়টি এরই মধ্যে ধারণার মধ্যেই সীমিত ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক জরিপ ও গবেষণায় সম্পদের যেটুকু উন্মোচিত করা সম্ভব হয়ে তা সোনার হরিণের হাতছানি তৈরি করেছে। মেরিটাইম অ্যাফেয়ার্স ইউনিট বাংলাদেশের সমুদ্র এলাকায় মেরিন জেনেটিক রিসোর্স (এমজিআর) অর্থাৎ সমুদ্রের প্রাণিজ ও উদ্ভিদ-সংক্রান্ত সবধরনের সম্পদের উপস্থিতি, সার্বিক অবস্থান, অর্থনৈতিক সম্ভাবনা নিয়ে যে কার্যক্রম চালায় সেখানে দেখা যায়, বাংলাদেশের নিজস্ব অর্থনৈতিক অঞ্চলে ২২০ প্রজাতির সি-উইড, ৩৪৭ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ, ৪৯৮ প্রজাতির ঝিনুক, ৫২ প্রজাতির চিংড়ি, ৫ প্রজাতির লবস্টার, ৬ প্রজাতির কাঁকড়া, ৬১ প্রজাতির সি-গ্রাস চিহ্নিত করা হয়েছে। আর বঙ্গোপসাগরে যে বিপুল তেল ও গ্যাসের মজুদ থাকার সম্ভাবনা আছে, তা গত দুই দশক ধরে ভারত ও মিয়ানমারের সমুদ্র সম্পদ ব্যবহার থেকেই স্পষ্ট। সূত্রমতে, ভারত এখন পর্যন্ত অনেকগুলো কূপ খনন করে মোট ৪০ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস আবিষ্কার করেছে। অন্যদিকে মিয়ানমার ২০০৩ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বঙ্গোপসাগরে মোট ৬ ট্রিলিয়ন ঘনফুট থেকে ১০ ট্রিলিয়ন ঘনফুটের তিনটি গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করেছে।
বলা যায়, বঙ্গোপসাগরের সম্পদ আহরণ ও ব্যবহার এখনও আমরা প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছি। তবে আশার কথা বিভিন্ন জরিপ ও গবেষণা চলমান থাকায় সম্ভাবনাগুলো কাজে লাগানোর সুযোগ তৈরি হয়েছে। উল্লেখ্য, কপ-২৬-এ ধীরে ধীরে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে সবুজ জ্বালানির ব্যবহার বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বাংলাদেশ। সেই রূপান্তরকে মসৃণ করার জন্য আরও দুই দশক প্রাকৃতিক গ্যাসের মতো জীবাশ্ম জ্বালানির প্রয়োজন দেশের। এ পরিস্থিতিতে গ্যাস হাইড্রেট আবিষ্কার বাংলাদেশের জন্য আশীর্বাদ হয়ে এসেছে। আবার গ্যাস সরবরাহের ঘাটতি পূরণে শিল্প ও বিদ্যুৎ উৎপাদন চলমান রাখতে বাংলাদেশ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে তরলিকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি করছে। এ কারণে গভীর সমুদ্রে তেল ও গ্যাস খোঁজা বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এদিকে শিল্পক্ষেত্রে বাংলাদেশে পাওয়া নির্দিষ্ট প্রজাতির কিছু সি-উইডের পাঁচটি প্রয়োগ চিহ্নিত করা হয়েছেÑ এগুলো হলো মাছের খাদ্য, পশুখাদ্য, ফুড অ্যাডিটিভ, প্রসাধনী উপাদান এবং হাই ভ্যালু প্রসাধনী উপাদান। অর্র্থাৎ আগামীতে টিকে থাকার জন্য সামুদ্রিক অর্থনীতিই হবে মূল কেন্দ্র। সঙ্গত কারণেই বিনিয়োগ ও উন্নত প্রযুক্তির ওপর জোর দিতে হবে।
দেশের দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের কোলঘেঁষে এখানে-সেখানে সৃষ্টি হচ্ছে ছোট ছোট চর ও দ্বীপাঞ্চল। উপকূলভাগে বাংলাদেশের ভূখ-ের প্রায় ১০ ভাগের এক ভাগ সমান জেগে উঠছে প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর সম্ভাবনাময় আরেক নতুন বাংলাদেশ। কক্সবাজারের কুতুবদিয়া দ্বীপ, চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ থেকে নোয়াখালীর হাতিয়া দ্বীপ, ভোলা হয়ে খুলনার সুন্দরবন পর্যন্ত বিশাল উপকূলীয় অঞ্চলের কাছে ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছে উত্তাল বঙ্গোপসাগরের ঢেউ। জেগে উঠছে দিগন্ত বিস্তৃত নতুন নতুন চর। খনিজসম্পদ বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এসব দীপাঞ্চল প্রাকৃতিক খনিজসম্পদে ভরপুর। তারা বলছেন, দীপের প্রাকৃতিক সম্পদের এই সম্ভাবনাকে পরিকল্পিতভাবে কাজে লাগানো গেলে বদলে যাবে দেশের অর্থনীতি।
জানতে চাইলে খনিজসম্পদ-বিষয়ক গবেষক প্রফেসর ড. ফোরকান আলী বলেন, বাংলাদেশ খনিজসম্পদে সমৃদ্ধ। প্রয়োজনের তুলনায় এ দেশে খনিজসম্পদের আহরণের পরিমাণ খুবই কম। উপকূলীয় অঞ্চলে জেগে ওঠা চরগুলো প্রাকৃতিক খনিজসম্পদের ভা-ার। এগুলো থেকে প্রাকৃতিক খনিজসম্পদ আহরণ করে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে বদলে দেয়া সম্ভব।
দেশের অর্থনীতিবিদ ও খনিজসম্পদ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উপকূলের প্রাকৃতিক খনিজসম্পদকে কাজে লাগাতে চাইলে প্রযুক্তি-জ্ঞানসম্পন্ন প্রকৌশলী ও প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞানসম্পন্ন জনশক্তি গড়ে তুলতে হবে। পাশাপাশি, খনিজসম্পদ অনুসন্ধান, আহরণে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে। যত দ্রুত সম্ভব এসব করা হলে আমাদের মাটি, পাহাড় ও পানির নিচে লুকিয়ে থাকা বিপুল খণিজসম্পদ বিশেষ করে তেল, গ্যাস, ।
প্রধান সম্পাদক: লে. কমান্ডার (অব.) রাশেদ ইকবাল, প্রকাশক আসিফ কবীর কর্তৃক জন্মভূমি প্রকাশনী লি: ১১০/২,সাংবাদিক হুমায়ুন কবীর বালু সড়ক, খুলনা থেকে মূদ্রিত ও প্রকাশিত