হাড়-কঙ্কাল ছাড়া বাকি সব পুড়ে গেছে
আগুনের ঘটনায় নিখোঁজ ৫১ শ্রমিক
জন্মভূমি ডেস্ক
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলায় সজীব গ্রুপের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান সেজান জুস কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকা-ের ঘটনায় ১৯ ঘণ্টা পর কারখানার ভেতর থেকে এক এক করে ৪৯টি পোড়া মরদেহ বের করে আনা হয়েছে। মরদেহগুলো ফায়ার সার্ভিসের চারটি অ্যাম্বুলেন্সে করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল মর্গে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
এর আগে, এ ঘটনায় তিনজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়। এ নিয়ে অগ্নিকা-ের ঘটনায় মোট মৃতের সংখ্যা দাঁড়ালো ৫২ জন। এছাড়া আহত হন আরও অন্তত ৫০ জন।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জানান, ইতোমধ্যে ৪৯টি পোড়া মরদেহ ফায়ার সার্ভিসের চারটি অ্যাম্বুলেন্সের মাধ্যমে ঢামেক মর্গে পাঠানো হয়েছে।
বৃহস্পতিবার (৮ জুলাই) সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার উপজেলার কর্ণগোপ এলাকায় অবস্থিত ওই কারখানায় অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটে। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছে ডেমরা, কাঞ্চনসহ ফায়ার সার্ভিসের ১৮টি ইউনিট আগুন নেভানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আগুন লাগার পর অনেকেই ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে বাঁচার চেষ্টা করে গুরুত্বর আহত হন। তাদের স্থানীয় হাসপাতালের পাশাপাশি ঢাকা মেডিক্যালসহ ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
॥ হাড়-কঙ্কাল ছাড়া বাকি সব পুড়ে গেছে ॥
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলায় সজীব গ্রুপের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান সেজান জুস কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকা-ের ঘটনার ২২ ঘণ্টা পর আগুন নিয়ন্ত্রণে এসেছে।
মর্মান্তিক এ মৃত্যুতে দীর্ঘ সময়ে আগুনে পুড়ে নিহতদের দেহের শুধুমাত্র হাড় ও কঙ্কাল ছাড়া বাকি সব পুড়ে গেছে। লাশগুলো উদ্ধার করতে গিয়ে আঁতকে উঠেছেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। অনেকেও কেঁদেছেন এ লাশ দেখে। কারখানার ভেতর থেকেই লাশগুলো ব্যাগে করে বের করা হয়। বাইরেও কাউকে দেখতে দেয়া হয়নি লাশের এ চিত্র।
গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার উপজেলার কর্ণগোপ এলাকায় অবস্থিত ওই কারখানায় অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটে। এতে ডেমরা, কাঞ্চনসহ ফায়ার সার্ভিসের ১৮টি ইউনিট আগুন নেভানোর চেষ্টা চালিয়ে যায়। ২২ ঘণ্টা চেষ্টা চালানোর পর আগুন নিয়ন্ত্রণে আসলেও এখনও কোথাও আগুন আছে কিনা দেখা হচ্ছে। সেইসঙ্গে ডাম্পিংয়ের কাজ চলমান রয়েছে।
॥ পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি ॥
এই অগ্নিকা-ের ঘটনায় অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শামীম বেপারীকে আহ্বায়ক করে পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির অন্য সদস্যদের মধ্যে রয়েছেন রূপগঞ্জের ইউএনও শাহ নুসরাত জাহান, নারায়ণগঞ্জ জেলা ফায়ার সার্ভিসের উপ-সহকারী পরিচালক আবদুল্লাহ আল আরেফিন, পুলিশের একজন প্রতিনিধি এবং কলকারখানা অধিদপ্তরের জেলার একজন কর্মকর্তা।
॥ স্বজনদের ঢাকা মেডিকেলে যোগাযোগের অনুরোধ ॥
স্বজনদের ঢাকা মেডিকেলে যোগাযোগ করার অনুরোধ জানিয়ে ফায়ার সার্ভিসের ডিরেক্টর অব অপারেশন লে. কর্ণেল জিল্লুর রহমান বলেন, যাদের স্বজনদের খোঁজ পাচ্ছেন না তাদের কাছে অনুরোধ, আপনারা ঢাকা মেডিকেলে যোগাযোগ করবেন। জেলা প্রশাসন ও ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে এটি আমাদের অনুরোধ। সেখানে আমাদের জেলা প্রশাসন, ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ সকলের প্রতিনিধি থাকবে। সেখানে আমাদের আনুসাঙ্গিক নিয়মাবলী পালন শেষে লাশ স্বজনদের কাছে বুঝিয়ে দেয়া হবে।
জিল্লুর রহমান বলেন, ভেতরে অনেক জটলা থাকায় আটকে পড়ারা দ্রুত বের হতে পারেননি। এক্সিটের দিকে আগুন থাকায় কেউ বের হতে পারেনি। ২৫ জনকে আমরা জীবিত উদ্ধার করি এবং যারা মারা গেছে তাদের এক্সিটে আগুন থাকায় কেউ ছাদেও যেতে পারেনি, নামতেও পারেনি। ৫ তলা ৬ তলায় আমাদের তল্লাশি চলমান রয়েছে। সেখানে লাশ থাকতেও পারে।
॥ শ্রমিক ও প্রত্যক্ষদর্শীরা যা বলছেন ॥
শ্রমিক ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, কর্ণগোপ এলাকায় সেজান জুস কারখানায় প্রায় সাত হাজার শ্রমিক কাজ করেন। ৭ তলা ভবনে থাকা কারখানাটির নিচতলার একটি ফ্লোরের কার্টন থেকে হঠাৎ আগুনের সূত্রপাত ঘটে। এক পর্যায়ে আগুন পুরো ভবনে ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় কালো ধোয়ায় কারখানাটি অন্ধকার হয়ে যায়। এক পর্যায়ে শ্রমিকরা ছোটাছুটি করতে শুরু করে। কেউ কেউ ভবনের ছাদে অবস্থান নেন। আবার কেউ কেউ ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়তে শুরু করেন। অনেকেই ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে বাঁচার চেষ্টা করে গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
॥ শ্রমিকদের স্বজনদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ, আনসারদের অস্ত্র লুটের অভিযোগ ॥
অগ্নিকা-ের ঘটনায় নিখোঁজ শ্রমিকদের খোঁজ করতে এসে ভিড় করা স্বজনদের সরাতে পুলিশ ধাওয়া দিলে সংঘর্ষ বেধে যায়। দু’পক্ষের সংঘর্ষ ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়। পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে। স্বজনরাও ইট-পাটকেল ছোড়ে।
সংঘর্ষের সময় কারখানার আনসার ক্যাম্প থেকে আনসার সদস্যদের অস্ত্র লুটের অভিযোগ করেছেন তারা। যদিও এ ব্যাপারে কেউ সরাসরি বক্তব্য দিতে চাননি। তবে তারা আশেপাশের ডোবা ও বিভিন্ন স্থানে অস্ত্রের খোঁজে পুলিশের সহযোগিতায় তল্লাশি করছেন।
নাম না প্রকাশ করে এক আনসার সদস্য বলেন, আমাদের ক্যাম্প থেকে ৩টি শর্টগান লুট হয়। পরে পাশের পুকুর থেকে দুটি উদ্ধার করা হয়েছে। আরেকটির খোঁজে তল্লাশি চলছে।
॥ ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে আহত হয়েছেন যারা ॥
অগ্নিকা-ের ঘটনায় আগুনে দগ্ধ ও ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে আহত স্বপ্না, মানিক, আশরাফুল, সুমন, সজিব, মেহেদী, মুন্না, মাজেদা, রুমা, মনোয়ারা, নাদিয়া, আছমা, মারিয়া, রুজিনা, সুমা, শফিকুল, সুফিয়া, সুজিদা, পারুল, রওশন আরা, শ্যামলাকে রূপগঞ্জের কর্ণগোপ ইউএস-বাংলা হাসপাতালে পাঠানো হয়।
এছাড়া নাহিদ, মঞ্জুরুল ইসলাম, মহসীন হোসেন, আবু বকর সিদ্দিক, আমেনা বেগম ও ফাতেমা আক্তারকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন।
আহত আবু বকর জানান, কারখানায় আগুন লাগার পর বাঁচার জন্য ভবন থেকে লাফ দিয়েছিলেন তিনি। তখনই আহত হন।
॥ আগুনের ঘটনায় নিখোঁজ ৫১ শ্রমিক ॥
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে সজীব গ্রুপের সেজান জুস কারখানায় আগুনের ঘটনায় ৫১ শ্রমিককে তাদের পরিবারের সদস্যরা খুঁজছেন। তাদের খোঁজে বৃহস্পতিবার (৮ জুলাই) সন্ধ্যা থেকে শুক্রবার (৯ জুলাই) বিকাল পর্যন্ত কারখানার সামনে অপেক্ষা করছেন তারা।
নিখোঁজ শ্রমিকরা হলেন ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার গোলামের ছেলে মো. মহিউদ্দিন, একই উপজেলার ফখরুল ইসলামের ছেলে শামীম, ভোলা জেলার ইসমাইলের মেয়ে হাফেজা, নারায়ণগঞ্জের হাকিম আলীর মেয়ে ফিরোজা বেগম, কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ উপজেলার তাহের উদ্দিনের ছেলে নাঈম, একই জেলার নিতাই উপজেলার স্বপনের মেয়ে শাহিদা, মৌলভীবাজারের পরবা বরমনের ছেলে কমপা বরমন, ভোলার তাজুদ্দিনের ছেলে রাকিব, কিশোরগঞ্জের কাইয়ুমের মেয়ে খাদিজা, নেত্রকোনার জাকির হোসেনের মেয়ে শান্তা মনি, হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ উপজেলার সেলিমের স্ত্রী উর্মিতা বেগম, কিশোরগঞ্জের কাইয়ুমের মেয়ে আকিমা, নেত্রকোনার কবির হোসেনের মেয়ে হিমা, রংপুরের মানসের ছেলে স্বপন, কিশোরগঞ্জের মাহাতাব উদ্দিনের স্ত্রী শাহানা, একই জেলার গোলাকাইন্দাইল খালপাড়ের রাজিবের স্ত্রী আমেনা, কিশোরগঞ্জের আব্দুর রশিদের মেয়ে মিনা খাতুন, পাবনার হাঠখালির শাহাদত খানের ছেলে মোহাম্মদ আলী, ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার ফজলুর ছেলে হাসনাইন, জামালপুরের মো. শওকতের ছেলে জিহাদ রানা, কিশোরগঞ্জের মো. সেলিমের মেয়ে সেলিনা, নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার ফিরোজা, তার মেয়ে সুমাইয়া, নরসিংদীর শিবপুরের জসিম উদ্দীনের স্ত্রী রিমা, কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ উপজেলার সুজনের মেয়ে রিনা আক্তার, চাঁদপুরের হাইমচর উপজেলার হাছান উল্লাহর ছেলে পারভেজ, পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলার গোকুলের ছেলে মাহাবুব, গাজীপুরের সেলিম মিয়ার ছেলে রিপন মিয়া (ইয়াসিন), ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার মান্নান মাতাবরের ছেলে নোমান মিয়া, দোলাকান্দাইল উপজেলার আফজালের স্ত্রী নাজমা বেগম, নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার আবল কাশেমের ছেলে রাসেদ, নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার এনায়েতের ছেলে বাদশা, ভোলা জেলার চরফ্যাশন উপজেলার ইউসুফ, নোয়াখালী জেলার হাতিয়া উপজেলার আবুল বাসারের ছেলে জিহাদ, শাকিল, কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জের খোকনের স্ত্রী জাহানারা, ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার কবিরের ছেলে মো. রাকিব, কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ থানার সুরুজ আলীর মেয়ে ফারজানা, কিশোরগঞ্জের চানমিয়ার ছেলে নাজমুল, কিশোরগঞ্জের বাস্তু মিয়ার ছেলে তাছলিমা, ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার মো. রাকিব, নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার মো. বাহারের ছেলে মো. আকাশ, কিশোরগঞ্জের বাচ্চু মিয়ার মেয়ে তাছলিমা, কিশোরগঞ্জের আজিজুল হকের মেয়ে মোছা. রহিমা, গাইবান্ধার প্রফেসর কলনির হাসানুজ্জামানের মেয়ে নুসরাত জাহান টুকটুকি, কিশোরগঞ্জের কটিয়াদি থানার চান্দু মিয়ার মেয়ে রাবেয়া, কিশোরগঞ্জের মালেকের মেয়ে মাহমুদা, নেত্রকোনার খালিয়াঝুড়ি উপজেলার আজমত আলীর মেয়ে তাকিয়া আক্তার, হবিগঞ্জের আব্দুল মান্নানের মেয়ে তুলি, কিশোরগঞ্জের নিজামউদ্দিনের মেয়ে শাহানা, দিনাজপুরের পার্বতীপুর উপজেলার ফয়জুল ইসলামের ছেলে সাজ্জাদ হোসেন সজীব, গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ থানার লালচু মিয়ার ছেলে লার্বণ আক্তার।