
জন্মভূমি ডেস্ক : করোনাকালে নমুনা পরীক্ষার ২ কোটি ৬১ লাখ টাকা আত্মসাতের ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর নিজেই তদন্ত কমিটি গঠন করেন খুলনার তৎকালীন সিভিল সার্জন ও গোপালগঞ্জ থেকে সদ্য ওএসডি হওয়া সিভিল সার্জন ডা. নিয়াজ মোহাম্মদ। পাঁচ সদস্যের ওই তদন্ত কমিটির প্রধান হন ডা. নিয়াজ মোহাম্মদ নিজেই।
পরে দায়সারা তদন্ত করে শুধুমাত্র মেডিকেল টেকনোলজিস্টের (ল্যাব) ওপর দায় চাপিয়ে তদন্ত প্রতিবেদন দেন। তদন্ত প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে ল্যাব টেকনিশিয়ানের বিরুদ্ধে থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন ডা. নিয়াজ মোহাম্মদ। এরপর সেই তদন্ত প্রতিবেদন ও জিডির কপি নিজেই জমা দেন খুলনার দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) বিভাগীয় কার্যালয়ে। পরবর্তীতে দুদক বিষয়টি আমলে নিয়ে ২০২১ সালের নভেম্বরে শুধুমাত্র ল্যাব টেকনিশিয়ানের বিরুদ্ধে মামলা করে। এরপর দুদকের দীর্ঘ তদন্তে বেরিয়ে আসে আসল রহস্য। নিজের পাতা ফাঁদেই আটকা পড়েন সিভিল সার্জন ডা. নিয়াজ মোহাম্মদ। হয়ে যান অভিযোগকারী থেকে মামলার আসামি।
গত ২৭ জুলাই গোপালগঞ্জ থেকে সদ্য ওএসডি হওয়া সিভিল সার্জন ডা. নিয়াজ মোহাম্মদ ও খুলনার সাবেক সিভিল সার্জন সুজাত আহমেদসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে করোনা পরীক্ষার ফির ২ কোটি ৬১ লাখ টাকা আত্মসাতের মামলায় আদালতে চার্জশিট দাখিল করেছে দুদক।
অভিযোগপত্রে বলা হয়, ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে ২০২০ সালের জুলাই থেকে ২০২১ সালের জুলাই পর্যন্ত করোনা পরীক্ষার ফি ২ কোটি ৬১ লাখ টাকা আত্মসাৎ করা হয়। এর মধ্যে ২০২০ সালের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত তৎকালীন সিভিল সার্জন সুজাত আহমেদের যোগসাজশে ৭৯ লাখ ও ২০২০ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২১ সালের ৩১ জুলাই পর্যন্ত ডা. নিয়াজ মোহাম্মদের যোগসাজশে ১ কোটি ৮২ টাকাসহ মোট ২ কোটি ৬১ লাখ টাকা আত্মসাৎ করা হয়।
অভিযোগপত্রে আরও বলা হয়, তৎকালীন সিভিল সার্জন ডা. নিয়াজ মোহাম্মদ ও ডা. সুজাত আহমেদ পরস্পরের যোগসাজশে ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট খুলনা জেনারেল হাসপাতালের সরকারি রসিদ বইয়ের বাইরে ডুপ্লিকেট রসিদ বই ব্যবহার করে বিদেশগামী যাত্রী ও সাধারণ করোনা রোগীদের নমুনা সংগ্রহ করে তা পরীক্ষার জন্য খুলনা মেডিকেল কলেজের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের ল্যাবে পাঠানো হতো। তবে ল্যাবে যে পরিমাণ নমুনা পাঠানো হতো তার থেকে রোগীর সংখ্যা কম দেখিয়ে করোনা পরীক্ষার ফি আত্মসাৎ করা হয়। ২০২০ সালের জুলাই থেকে ২০২১ সালের জুলাই পর্যন্ত মোট ফি আদায় করা হয়েছিল ৪ কোটি ২৯ লাখ ৯১ হাজার ১০০ টাকা। তবে সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়া হয়েছিল ১ কোটি ৬৮ লাখ ৪৬ হাজার ৭০০ টাকা। বাকি ২ কোটি ৬১ লাখ ৪৪ হাজার ৪০০ টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে।
এ মামলার বাকি আসামিরা হলেন- ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট খুলনা জেনারেল হাসপাতালের মেডিকেল টেকনোলজিস্ট (ল্যাব) প্রকাশ কুমার দাস, মেডিকেল টেকনোলজিস্ট (ল্যাব) মো. রওশন আলী, ক্যাশিয়ার তপতী সরকার ও আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. এস এম মুরাদ হোসেন।
রোববার (১০ সেপ্টেম্বর) মামলার বাদী ও তদন্তকারী কর্মকর্তা দুদকের খুলনা বিভাগীয় কার্যালয়ের উপ-পরিচালক খন্দকার কামরুজ্জামানের সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। দীর্ঘ আলাপে জানা যায় কীভাবে এ মামলার অভিযোগকারী থেকে আসামি হলেন সিভিল সার্জন ডা. নিয়াজ মোহাম্মদ।
দুদকের তদন্তকারী কর্মকর্তা বলেন, ২০২০ সালের জুলাই থেকে ২০২১ সালের জুলাই পর্যন্ত প্রায় ১৩ মাস ধরে আসামিদের পরস্পরের যোগসাজশে এই টাকা আত্মসাৎ করা হয়। ২০২০ সালের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ৫ মাসে তৎকালীন সিভিল সার্জন সুজাত আহমদ প্রায় ৮২ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেন। পরে সুজাত আহমদের বদলি হলে তার জায়গায় আসেন তৎকালীন সিভিল সার্জন ও মামলার অপর প্রধান আসামি ডা. নিয়াজ মোহাম্মদ।
ডা. নিয়াজ মোহাম্মদ সিভিল সার্জন হয়ে যোগদানের পরও চলতে থাকে করোনা পরীক্ষার ফি আত্মসাৎ। তিনি জেনেশুনে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ না করে উক্ত আত্মসাতে সহায়তা শুরু করেন। বিদেশগামী যাত্রীদের নমুনা পরীক্ষার জন্য খুলনা মেডিকেল কলেজের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগে নমুনা প্রেরণের ফরওয়ার্ডিংয়ে নমুনার সংখ্যা লেখার জায়গা ফাঁকা রেখে তারিখবিহীন স্বাক্ষর করে অন্যান্য আসামিদেরকে উক্ত ফাঁকা জায়গায় ইচ্ছামতো নমুনার সংখ্যা ও তারিখ বসিয়ে ডুপ্লিকেট রশিদ বইয়ের মাধ্যমে সংগৃহীত নমুনা খুলনা মেডিকেল কলেজের আরটি পিসিআর ল্যাবে পাঠানোর সুযোগ করে দিয়েছেন। পরবর্তীতে রোগীর সংখ্যা কম দেখিয়ে সেই অনুযায়ী ইউজার ফির টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দেন। অর্থাৎ প্রকৃত ইউজার ফির টাকা জমা প্রদান না করে এবং প্রেরিত নমুনার ফলাফল তিনি প্রতিদিন ই-মেইলের মাধ্যমে প্রাপ্ত হয়ে নমুনার সংখ্যা ও ফলাফলের সংখ্যা রেকর্ডভিত্তিক অবগত হয়ে অন্যান্য আসামিদের সঙ্গে যোগসাজশে ইউজার ফির আদায়কৃত টাকা প্রতিদিন সরকারি কোষাগারে জমা না দিয়ে দীর্ঘদিন পরপর (৩-৪ মাস) চালানে স্বাক্ষরপূর্বক জমা দিয়ে সরকারি টাকা আত্মসাৎ করেছেন।
এরপর বিষয়টি জানাজানি হওয়ায় তিনি তড়িঘড়ি করে তার অধীনস্থ হাসপাতালের ডাক্তারদের সমন্বয়ে ৫ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন। নিজে উক্ত কমিটির সভাপতি হয়ে প্রভাব বিস্তার করে তার ইচ্ছামতো তদন্ত সম্পন্ন করে এককভাবে ল্যাব ইনচার্জ প্রকাশ কুমার দাসের ঘাড়ে অপরাধের দায় চাপিয়ে তদন্ত প্রতিবেদন প্রস্তুতপূর্বক নিজে অভিযোগকারী হিসেবে দুর্নীতি দমন কমিশনের খুলনা বিভাগীয় কার্যালয়ে লিখিত অভিযোগ করেন।
এরপর দীর্ঘ তদন্তে বেরিয়ে আসে তার আসল কর্মকাণ্ড। তিনি বিদেশ গমনেচ্ছু করোনা রোগীদের গৃহীত নমুনার প্রকৃত সংখ্যা আড়াল করার অসৎ উদ্দেশ্যে খুলনা মেডিকেল কলেজে প্রেরিত নমুনার ফরওয়ার্ডিংয়ের অনুলিপি সংরক্ষণ করেননি। তিনি অন্যান্য আসামিদের সঙ্গে যোগসাজশে করোনা রোগীদের ইউজার ফির সরকারি মোট আত্মসাতকৃত দুই কোটি ৬১ লাখ ৪৪ হাজার টাকার মধ্যে তার কর্মকালীন সময়ে এক কোটি ৮২ লাখ ৪৭ হাজার টাকা আত্মসাৎ করেছেন বলেও চার্জশিটে উল্লেখ করেছি।
এদিকে আদালতে চার্জশিট দাখিলের পর অভিযুক্ত গোপালগঞ্জের সিভিল সার্জন ডা. নিয়াজ মোহাম্মদ উচ্চ আদালত থেকে দুই সপ্তাহের জামিন নেন। এরপর গত ৭ সেপ্টেম্বর খুলনার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের নিম্ন আদালত উপস্থিত হয়ে স্থায়ী জামিনের আবেদন করেন তিনি। এদিন জামিন পেতে ১ ঘণ্টা ২০ মিনিট আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে ছিলেন ডা. নিয়াজ মোহাম্মদ। পরে দুই পক্ষের আইনজীবীদের যুক্তিতর্ক ও দীর্ঘ শুনানি শেষে আদালত ডা. নিয়াজ মোহাম্মদের জামিন মঞ্জুর করেন। গত বৃহস্পতিবার (৭ সেপ্টেম্বর) খুলনা মহানগর জেলা ও দায়রা জজ আদালত বিচারক শরীফ হোসেন হায়দার সিভিল সার্জন ডা. নিয়াজ মোহাম্মাদের জামিন মঞ্জুর করেন।
ডা. নিয়াজ মোহাম্মদের জামিনের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আইনজীবী খন্দকার মুজিবর রহমান। তিনি বলেন, জামিন আদেশের কপি তুলে বিষয়টি দুদকের প্রধান কার্যালয়ে জানানো হয়েছে পাশাপাশি উচ্চ আদালতে আপিল করা হবে। আমার দীর্ঘ ক্যারিয়ারে এমন জামিন দেখিনি। যদিও আদালত চাইলে তাকে জামিন দিতে পারে। কিন্তু এ ধরনের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের জামিন দেওয়ার মানে দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেওয়া।
এদিকে করোনা পরীক্ষার ২ কোটি ৬১ লাখ টাকা আত্মসাতের ঘটনায় গোপালগঞ্জের সিভিল সার্জন ডা. নিয়াজ মোহাম্মদকে ওএসডি করা হয়েছে। তাকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর মহাখালীতে সংযুক্ত করা হয়েছে। তার জায়গায় স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী পরিচালক (প্রশাসন) ডা. মো. জিল্লুর রহমান। বৃহস্পতিবার (৭ সেপ্টেম্বর) বিকেলে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সিনিয়র সহকারী সচিব মো. আলমগীর কবীর স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে এ তথ্য জানানো হয়।
সরকারি চাকরি বিধিমালা অনুযায়ী ডা. নিয়াজ মোহাম্মদকে সাময়িক বরখাস্ত না করে শুধুমাত্র ওএসডি করে সাধারণ মানুষের আইওয়াশ করা হয়েছে বলে মনে করেন দুদকের আইনজীবী খন্দকার মুজিবর রহমান।
এ বিষয়ে তিনি বলেন, গভমেন্ট সার্ভিস রুলস অনুযায়ী আমরা যেটা দেখি সরকারি কর্মকর্তা অথবা কর্মচারী যদি কোনো ফৌজদারি অপরাধে চার্জশিটভুক্ত আসামি হন তিনি চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত হবেন। পরবর্তী মামলার রায়ে যদি তিনি নির্দোষ প্রমাণিত হন তাহলে তিনি চাকরিতে পুনর্বহাল হবেন। আর যদি তিনি দোষী প্রমাণিত হন তাহলে তিনি চাকরি থেকে স্থায়ী বরখাস্ত হবেন। কিন্তু এখানে ডা. নিয়াজ মোহাম্মদকে ওএসডি করা হয়েছে। এটা আসলে শাস্তি না, সাধারণ মানুষের আইওয়াশ করেছে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ।
ডা. নিয়াজ মোহাম্মদকে সাময়িক বরখাস্ত না করে ওএসডি কেন করা হলো জানতে চাইলে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সিনিয়র সহকারী সচিব মো. আলমগীর কবীর বলেন, আমি এ বিষয়ে কিছু বলতে পারবো না। আমাদের সিনিয়র সচিব স্যারের নির্দেশে তাকে ওএসডি করা হয়েছে। আমি নির্দেশিত প্রজ্ঞাপনে শুধুমাত্র স্বাক্ষর করেছি। এ বিষয়ে বলতে পারবেন আমাদের সিনিয়র সচিব স্যার ডা. আনোয়ার হোসেন হাওলাদার।
এ বিষয়ে জানতে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সিনিয়র সচিব ডা. আনোয়ার হোসেন হাওলাদারের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও সম্ভব হয়নি। মোবাইল ফোনে ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়েও কোনো সাড়া মেলেনি।