
সাতক্ষীরা প্রতিনিধি : ঘন্নিঝড় জলোচ্ছ্বাসের সংকেত দিলেই নারীরা ছোটে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে ।বাংলাদেশ একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ দেশ। তাই এ দেশে প্রতি বছর বৃষ্টি, বন্যা, ঝড়, সাইক্লোন, জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড় হবেই। এসব থেকে বাংলাদেশের মানুষকে পৃথক করা যাবে না। বছরের পর বছর দেশের মানুষকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করে বেঁচে থাকতে হয় এ দেশের মানুষকে। এর ব্যতিক্রম হবে—এমনটা আশা করা বোধহয় ঠিক হবে না। দুর্যোগের সময়টায় নিরাপদে থাকা অন্য সবার নজর দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় থাকলেও দুর্যোগের পর সে চোখ সরে যায়। কিন্তু এ সময়েই প্রয়োজন আরও বেশি মনোযোগ। দুর্যোগ–পরবর্তী স্বাস্থ্যসেবায় বিশেষত নারীদের অঙ্গীভূত করা জরুরি। কারণ, প্রাকৃতিক দুর্যোগে নারীই থাকে সবচেয়ে বেশি স্বাস্থ্যঝুঁকিতে।
তবে আমরা যারা শহরের উঁচু উঁচু ভবনে বসবাস করি, তাদের পক্ষে উপকূলের মানুষের দুঃখ–দুর্দশা উপলব্ধি করা সম্ভব না। বিশেষ করে বন্যা, সাইক্লোন, জলোচ্ছ্বাসের সময়কার মানুষের অসহায়ত্বের অনুভূতি। বন্যা, ঘুর্ণিঝড়ে ঘরবাড়িতে থাকা খাট, বিছানাপত্র, আলমারি সবকিছু ভেসে চলে যায়। জামা কাপড়ের কথা বাদ দিলাম, এক টুকরো সুতোও অবশিষ্ট থাকে না। ঘরের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়ে উপকূলের মানুষ।
ঘূর্ণিঝড় রিমাল, আবহাওয়া পূর্বাভাস ও মানুষের সচেতনতা
অবস্থানগত কারণে শহরের মানুষেরা তাদের কষ্টের ভাগীদার হতে পারে না। আমরা হয়তো শহরে বসে হা হুতাশ করতে পারি কিন্তু বন্যা, সাইক্লোন, জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড়ে মানুষের ঘরবাড়ি ভেসে যাওয়ার কষ্টটা তাদের মতো করে অনুভব করতে পারি না।
নিজের ভিটেমাটি ছেড়ে আশ্রয়কেন্দ্র যাননি অনেকে। এর মধ্যে এক নারীও রয়েছেন। তিনি বসে আছেন ঘরের দরজায়। রোববার সাতক্ষীরার শ্যামনগরে। ছবি: রয়টার্স
প্রতি বছরের নিয়ম অনুযায়ী এ বছরও মে মাসে ঘুর্ণিঝড়ের তাণ্ডব দেখেছে বাংলাদেশ। চলতি সপ্তাহের শুরু থেকে আভাস পাওয়া যায় ঘূর্ণিঝড় রিমালের। বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট এই ঘূর্ণিঝড় দেশের উপকূলবর্তী এলাকায় গত রোববার আঘাত হানার পরও মঙ্গলবার পর্যন্ত স্থলভাগে অবস্থান করে তাণ্ডব চালায়। দীর্ঘ ৪৮ থেকে ৫০ ঘণ্টা স্থলভাগে অবস্থান করে এই ঘূর্ণিঝড়, যা এর আগে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড়ের নিয়ম মানেনি।
প্রাকৃতিক দুর্যোগে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকে নারী, শিশু, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি ও প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষেরা। বাংলাদেশে মোট দরিদ্র জনগোষ্ঠীর বেশির ভাগ নারী। ফলে প্রাকৃতিক দুর্যোগে নারী ও শিশুরা সবচেয়ে বেশি ভোগান্তির শিকার হয়। এ সময় লবণাক্ত পানির পরিমাণ বেড়ে যায়। নোংরা, লবণাক্ত পানির কারণে নারীরা বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়েন। অতিরিক্ত লবণাক্ত পানির কারণে নারীদের গর্ভকালীন উচ্চ রক্তচাপ, জরায়ুর প্রদাহসহ বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকির আশঙ্কা থাকে। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে খুব স্বাভাবিকভাবে গর্ভবতী নারীদের জন্য বিশেষ কোনো ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। তাই এই সময় গর্ভবতী ও স্তন্যদাত্রী নারীরা অনেক বেশি কষ্টের সম্মুখীন হন। স্যানিটারি ন্যাপকিন, গর্ভবতী মায়ের উপকরণ সহজলভ্য হয় না। আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে থাকে না ঋতুকালীন নারীদের উপযুক্ত পরিবেশ। নোংরা পানি বিভিন্ন ধরনের ইনফেকশনের কারণও হতে পারে। তাই আশ্রয়কেন্দ্রের অনিরাপদ পরিবেশে নারীদের প্রজনন স্বাস্থ্য মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়ে।
নারীর প্রজনন স্বাস্থ্যের ওপর নতুন প্রজন্মের সুস্বাস্থ্য নির্ভর করে। মা সুস্থ থাকলে, সুস্থ থাকবে সন্তান। মাতৃত্ব মানে মা ও শিশুর নিরাপদ জীবন। তাই প্রাকৃতিক দুর্যোগে আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে নারীদের প্রজনন স্বাস্থ্যের দিকে বিশেষ নজর দেওয়া উচিত। তা না হলে প্রাকৃতিক দুর্যোগের আগে বা পরে যেসব শিশু পৃথিবীর আলোয় আসবে, তারা পুষ্টিহীনতায় ভুগবে।
ঘূর্ণিঝড় রিমাল আঘাত হানার আগে অনেকেই আশ্রয় নেন আশ্রয়কেন্দ্রে। রোববার সাতক্ষীরার শ্যামনগরে।
রয়েছে অন্য সমস্যাও। অন্যদিকে আশ্রয়কেন্দ্রে বখাটেরা থাকবে না তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। বখাটে ছেলেরা এ দেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে আছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগে তারা নারীদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করবে, তা আশা করা যায় না। বখাটের কারণে আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে নারীরা থাকে অনিরাপদ। অনেকে এ কারণেও আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে চায় না। এই বিষয়ে কর্তৃপক্ষের সজাগ দৃষ্টি থাকা প্রয়োজন।
প্রাকৃতিক দুর্যোগে ঘরবাড়ির ক্ষতির কারণে মানুষের মাথার উপর ছাদ থাকে না। এতে নারী–পুরুষ সকলেই ভোগান্তিতে পড়েন। অনেকে সহায়–সম্বল হারিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করেন। বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দেয়। এতে মানুষ নানার রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। তবে, এসব ক্ষেত্রে নারীরা বেশি ভোগান্তিতে পড়ে।
শুরু হয়নি বাঁধ সংস্কারকাজ, নিঃস্ব বাগেরহাটের অর্ধ লক্ষাধিক মানুষ
সম্প্রতি প্রকাশিত ইউনিসেফের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ঘূর্ণিঝড় রিমালের আঘাতে উপকূলীয় ৬ জেলার প্রায় ১০ লাখ নারী ঝুঁকির মুখে রয়েছেন। গত ২৭ মে ইউনিসেফ প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানায়।
ইউনিসেফের এই প্রতিবেদনে বরগুনা, পটুয়াখালী, পিরোজপুর, বাগেরহাট, খুলনা ও সাতক্ষীরায় ঝুঁকিতে থাকা নারী–পুরুষের সংখ্যা উল্লেখ আছে। প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বরগুনা সদর ও পটুয়াখালীর কলাপড়ার নারীরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছে। এ ছাড়া পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া, বরগুনার আমতলী উপজেলা, সাতক্ষীরার শ্যামনগর, বরগুনার পাথরঘাটার উপজেলার নারীরাও ঝুঁকিতে আছে।
নারীর মাসিকের সময়, গর্ভকালীন ও প্রসব-পরবর্তী সময়ে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার গুরুত্ব অত্যধিক। এ সময়ে নিরাপদ পানি ও টয়লেটের অভাবে নারীর প্রজননতন্ত্রে সংক্রমণ ও প্রদাহ হতে পারে। পরবর্তী সময়ে তা থেকে অনেক জটিলতা যেমন- বন্ধ্যাত্ব থেকে শুরু করে জরায়ুমুখের ক্যান্সার পর্যন্ত হতে পারে। এমনটি মনে করেন চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের সহকারী অধ্যাপক (গাইনি) ডা. ফরিদা ইয়াসমিন সুমি।
ঘূর্ণিঝড় রিমালের ক্ষয়ক্ষতি থেকে বাঁচতে ভ্যানে করে আশ্রয়কেন্দ্রে যাচ্ছেন কয়েকজন। রোববার সাতক্ষীরার শ্যামনগরে।
ডা. ফরিদা ইয়াসমিন সুমি ইনডিপেনডেন্ট ডিজিটালকে বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস কিংবা বন্যা বাংলাদেশের জন্য নতুন কোনো ঘটনা নয়। এসব দুর্যোগে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তির শিকার হন নারীরা। উপকূলীয় এলাকায় ঝড় ও বন্যার সময়টাতে ভরসা যখন আশ্রয়কেন্দ্র, তখন সেখানে স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট আর নিরাপদ পানির খুব অভাব থাকে। দুর্যোগপ্রবণ অঞ্চলে নারীর জন্য থাকে না কোনো স্বাস্থ্যকর ব্যবস্থাপনা। এই অব্যবস্থাপনার কারণে হুমকির মুখে পড়ছে বহু কিশোরী আর নারীর প্রজনন স্বাস্থ্য। প্রয়োজনীয় খাদ্যের অভাবে কিশোরী ও গর্ভবতী নারীরা ভোগেন রক্তশূন্যতাসহ নানান অপুষ্টিজনিত জটিলতায়। তাই সময় এসেছে নারীদের জন্য দুর্যোগকালীন প্রয়োজনীয় জরুরি স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার।’
দুর্যোগে এখনও ভরসা রেডিও
আকাশে মেঘ কেটে গিয়ে যেমন সূর্যের দেখা মেলে, তেমনি মাথা গোঁজার ঠাঁই হারানো মানুষেরা বন্যার পানি নেমে গেলে আবার আশায় বুক বাঁধে। নতুন করে স্বপ্ন দেখে, তৈরি করে ঘরবাড়ি। এ সময়টাতে বিশেষভাবে নারীদের সুস্বাস্থ্য ও তাদের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাপনার দিকে নজর দেওয়া জরুরি। পাশাপাশি শুধু দুর্যোগ নয়, বছরজুড়েই ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলগুলোর নারীদের জন্য পরিকল্পিতভাবে কাজ করা প্রয়োজন। যে জলবায়ু পরিবর্তন বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে প্রাকৃতিক দুর্যোগের হার বাড়িয়ে দিয়েছে, সেই জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবও কিন্তু নারীর ওপরই সবচেয়ে বেশি পড়ে বলে বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে। তাই সার্বিকভাবেই বিশেষত উপকূলীয় এলাকার মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলের নারীরা বাড়তি মনোযোগ দাবি করে।
প্রধান সম্পাদক: লে. কমান্ডার (অব.) রাশেদ ইকবাল, প্রকাশক আসিফ কবীর কর্তৃক জন্মভূমি প্রকাশনী লি: ১১০/২,সাংবাদিক হুমায়ুন কবীর বালু সড়ক, খুলনা থেকে মূদ্রিত ও প্রকাশিত