গোটা দুনিয়ার মানুষের সাথে আমরাও করোনা মহামারী মোকাবেলা করে চলেছি, তবে এর পাশাপাশি এ বছর আমরা আরও একটি দুর্যোগ মোকাবেলা করছি। আমরা মৌসূমী বন্যার কবলে পড়েছি। এবারকার বন্যা অনেক বেশী ব্যাপক, ক্ষয়ক্ষতিও অনেক। সরকারের হিসাবেই বলা হচ্ছে, এবারের বন্যা দেশের ৩৩ জেলা গ্রাস করেছে। এতে সাধারণ মানুষের বিভিন্ন খাতে প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। গত ২৫ আগস্ট আন্তঃমন্ত্রণালয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সমন্বয় কমিটির সভা শেষে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান নিজেই সাংবাদিকদের এ কথা বলেছেন।
মাননীয় প্রতিমন্ত্রীর উদ্ধৃতি দিয়ে একাধিক পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে ক্ষয়ক্ষতির বিশদ বর্ণনা দিয়ে বলা হয়; অবস্থা বুঝে মন্ত্রণালয়গুলো পুনর্বাসন পরিকল্পনা নেবে। সরকারীভাবে বন্যা নিয়ন্ত্রণে অনেক পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। অবশ্য, ১৯৯৮এর বন্যার তুলনায় এবারে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কম। সেসময় প্রায় ৪০ জেলা ক্ষতিগ্রস্ত ও প্রায় ৫০ ভাগ এলাকা প্লাবিত হয়েছিল। এবার ৩৩ জেলা ক্ষতিগ্রস্ত ও প্লাবিত হয়েছে ৩০ ভাগ এলাকা। সেই সময় বন্যা স্থায়ী হয়েছিল ৬৯ দিন, এবার ৪৬ দিন। দীর্ঘমেয়াদী বন্যা থেকে পরিত্রাণ বিষয়ে প্রতিমন্ত্রী নদী শাসন, নদী ভাঙন রোধে নানা প্রকল্প হাতে নেওয়ার কথা উল্লেখ করে বলেছেন যে, সুরমা, মাতামুহুরি নদী শাসনের প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। ভবিষ্যতে পদ্মা, যমুনা নদী শাসনেরও পদক্ষেপ নেয়া হবে। এতে আগামী ১০ বছরের মধ্যে বাংলাদেশ একটি বন্যা সহনীয় রাষ্ট্রে পরিণত হবে।
তবে দু:খজনক হলেও সত্যি যে, এই ক্ষয়ক্ষতির হিসেবের মধ্যে উপকূলীয় জেলাগুলোয় অতি-জোয়ারে সৃষ্ট বন্যার বিষয়টি অন্তর্ভূক্ত করা হয়নি। আমরা জানি, ভাটির দেশ বাংলাদেশ, প্রাকৃতিক দুর্যোগের দেশও বটে। ঝড়-বন্যা এখানকার নিত্যসঙ্গী। ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলায় আমরা ইতিমধ্যে দুনিয়ার মধ্যে অনেক ভালো দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছি। ঘুর্ণিঝড়ে আর আগের মত প্রাণহানি বা সম্পদহানি হয় না। সেক্ষেত্রে বন্যা মোকাবেলায় আমরা বেশ পিছিয়ে আছি। বন্যায় প্রাণহানি কম হলেও সম্পদহানি ও দুর্ভোগের অন্ত নেই। বন্যার ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনতে আমাদের কার্যকর কোন পন্থা নেই। আর সহায়তার নামে যেসব ত্রাণসামগ্রী দুর্গতদের হাতে তুলে দেয়া হয়, তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। এবারেও যার ব্যতিক্রম ঘটেনি। পুনর্বাসন কার্যক্রমের মাধ্যমেও ক্ষতিগ্রস্তরা তাদের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারে না। ফলে মানুষ আরও নি:স্ব হয়। এছাড়া বন্যার পাশাপাশি নদীভাঙ্গনও বাড়ে। নদীভাঙ্গনে সবকিছু হারানো মানুষের সংখ্যাও অনেক বেশী; যদিও নদীভাঙ্গনকে দুর্যোগ হিসেবে আমরা বিবেচনা করিনা; এমনকি সবকিছু হারানো মানুষগুলোকে আমরা ক্ষতিপূরণও দিই না, উপরন্তু নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাওয়া তাদের জমা-জমি সরকারের হয়ে যায়।
একথাতো ঠিক যে, আমরা আমাদের ভৌগলিক এই অবস্থানকে পাল্টাতে পারবো না। বক্ষ্মপুত্র অববাহিকায় আগাম এবং বেশী বৃষ্টিপাত হলে আমাদের দেশে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়। যা এবারে ঘটেছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বঙ্গোপসাগরের ঘন ঘন নিম্নচাপজনিত কারণে উপকূলে ব্যাপক বৃষ্টিপাত। একদিকে উত্তরের বন্যার পানি নেমে আসা এবং সাগরের নিম্নচাপের সাথে অতিবৃষ্টির পানি যোগ হয়ে সৃষ্টি হওয়া প্রবল জোয়ারে উপকূলীয় অঞ্চলও ডুবে গেছে।
১৯৭০ হতে ২০০০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে সাতটি বড় বন্যা হয়েছে। এর মধ্যে ১৯৮৮ ও ১৯৯৮ সালের বন্যা প্রলয়ঙ্করী হিসেবে চিহ্নিত। ওই সময়ে ব্রহ্মপুত্র ও গঙ্গা-পদ্মা অববাহিকা একসাথে সক্রিয় হওয়ায় বড় বন্যা হয়। ১৯৮৮ সালে ৬০ শতাংশ এবং ১৯৯৮ সালে ৮০ শতাংশ এলাকা প্লাবিত হয়েছিল। প্রাপ্ত তথ্যমতে, প্রতি সাত বছরে বড় ধরণের বন্যা দেখা দেয়; আর ৩৩ থেকে ৫০ বছরে একবার প্রলয়ঙ্করী বন্যা দেখা দেয়।
মাননীয় প্রতিমন্ত্রী, বন্যা মোকাবেলায় বা বন্যা সহনশীল করতে নদী শাসনের কথা উল্লেখ করেছেন। আমরা বলতে চাই, নদী শাসন করে সবকিছুই মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। ১৯৮৮ সালের বন্যার পরেও বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রকল্প (ফ্লাড একশন প্লান)-এর আওতায় আমরা অনেকগুলো বাঁধ দিয়েছি। কিন্তু তাতে আমরা প্রত্যাশা অনুযায়ী ফলাফল পাইনি। বরং জায়গায় জায়গায় জলাবদ্ধতার প্রকোপ বেড়েছে। প্রসঙ্গত, আমাদের দেশের বড় শহরগুলোর নিষ্কাশন ব্যবস্থা একেবারে অচলপ্রায়। বৃষ্টি হলেই নগরগুলোয় জলাবদ্ধতা তৈরি হয়। কারণ, আমাদের নদীগুলোর পাড় উঁচু, আর নদী দূরবর্তী স্থান নীচু; আবার প্লাবনভূমি আরও নীচু। সাধারণভাবে নিষ্কাশণ নালাগুলো নদীমুখো করে সামান্য ঢালু রেখে তৈরি করা হয়, যা নদীপাড় উঁচুর তুলনায় সামঞ্জস্য নয়। একারণে নিষ্কাষণ খাল-নালাগুলোর কাঠামো কাজ করে না। তাছাড়া, কাঠামোকেন্দ্রিক উন্নয়ন-কৌশলের বড় সমস্যা হচ্ছে, প্রায়শ:ই ভৌগলিক বা প্রাকৃতিক অবস্থাকে অস্বীকার করে অতিসাধারণ হিসেব করে নকশা তৈরি করা। এতে নগর গড়ে তোলার স্বার্থে আমরা প্লাবনভূমির গুরুত্ব না বুঝে বিসর্জন দিয়েছি। এই প্লাবনভূমিতেই বর্ষার পানি জমা হতো, সংলগ্ন খাল-নালা দিয়ে তা বড় নদীতে নিষ্কাশিত হতো। ছোট-বড় নানান কাঠামো অবাধ পানি চলাচলে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অন্যদিকে উজানে, ভারতের তৈরি ফারাক্কাসহ অসংখ্য বাঁধ, এমনকি বক্ষ্মপুত্র অববাহিকায় চীন একাধিক বাঁধ তৈরি করে শুষ্ক মওসূমে সেই পানি তাদের ব্যবহার এবং বর্ষার সময় ছেড়ে দেওয়ায় আমরা দুর্ভোগে পড়ছি। আমরা নদী শাসনের নামে দুই তীরে বাঁধ দিয়ে নদীর প্রশস্ততা কমিয়েছি, অপ্রশস্ত স্লুইস গেইট নির্মাণ করেছি, যেখানে-সেখানে রাস্তা এবং ইচ্ছেমত কালভার্ট তৈরি করে মূলত: পানি নিষ্কাশনের প্রাকৃতিক পথগুলোকেই বাধাগ্রস্ত করেছি। যে কারণে বৃষ্টি বা বন্যার পানি সহজে নামতে পারে না। দিনের পর দিন পানি আটকে থাকে।
আমাদের মনে হয়, সময় এসেছে পূণ:মূল্যায়ন করার। নদীকে নিয়ন্ত্রণ-শাসন করার নামে নদীর মৃত্যু ঘটানোর পথ হতে সরে হবে। উদাহরণ হিসাবে, ভূমিগঠনের দিক দিয়ে সক্রিয় (একটিভ ডেল্টা) দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল; যেখানে ১৯৬০এর দশকে বাস্তবায়িত কোস্টাল ইমব্যাঙ্কমেন্ট প্রজেক্ট -সিইপি’র প্রতিক্রিয়ায় প্রায় সব নদীগুলো মরতে বসেছে। যে বিপুল পরিমাণ পলি জোয়ারে উঠে এসে এখানকার নদী-খাল দিয়ে প্লাবনভূমিতে অবক্ষেপিত হতো, তা বাঁধ-স্লইস গেইটে বাধা পেয়ে নদীবক্ষে জমা হয়ে নদী মরছে; প্লাবনভূমি জলাবদ্ধ হচ্ছে। বিল ডাকাতিয়া, ভবদহ এলাকার জলাবদ্ধতার কথা আমরা জানি। আর নদীগুলো পলি জমায় জোয়ারের পানির উচ্চতা প্লাবনভূমির তুলনায় অনেক উঁচুতে উঠেছে। এখানকার অন্যতম বড় এবং গভীর দুটো নদী -শিবসা এবং পশুরেরও গভীরতা অনেক কমেছে। বলাইবাহুল্য, বিদেশী জ্ঞানে-দানে-ঋণে আমাদের পানি ব্যবস্থাপনায় এই পলি’র গুরুত্বটি একেবারেই উপেক্ষা করেছি। গাঙ্গেয় এই ব-দ্বীপ, আয়তনে বেশ ছোট; কিন্তু ভৌগলিক বৈশিষ্ট্যে অনন্য এবং অঞ্চলগতভাবে স্বতন্ত্র। এর উপকূলভাগেই পূর্ব উপকূল, মধ্য উপকূলভাগ ও পশ্চিম উপকূলভাগ তিনটি বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল। আমাদের পানি ব্যবস্থাপনায় এই ভৌগলিক বৈশিষ্ট্য বিবেচনায় আনিনি। ভবিষ্যতে যদি আমরা এই বিষয়গুলো বিবেচনায় না আনি, তাহলে দুর্ভোগ বাড়বে বৈ কমবে না। একথাতো সকলেই মানবেন যে, ব্রক্ষ্মপুত্র, সাঙ্গু আর সুরমা এক ধরণের নদী নয়, আবার এই নদীগুলোর সাথে সুন্দরবনের কপোতাক্ষ বা শিবসা নদীর কোন মিল নেই। একারণেই নিয়ন্ত্রণ-শাসনের পরিবর্তে মানিয়ে চলাই অধিক যুক্তিযুক্ত। ভুলে গেলে চলবে না, বন্যা এবং পলি আমাদের জন্য আশির্বাদ; যা প্লাবন ভূমিতে আসতে না দিয়ে নদীর মৃত্যুকে ত্বরান্বিত করছি। মনে রাখতে হবে, শুধুমাত্র কাঠামোকেন্দ্রিক সমাধানের ভাবনা আমাদেরকে আরও বিপদে ফেলবে। তাই, পানি ব্যবস্থাপনায় অঞ্চলগত বৈশিষ্ট্যের পাশাপাশি, নদী ও মাসভিত্তিক পানি-পলি প্রবাহ, নদীগুলোর ভিন্নতাও বিবেচনায় আনতে হবে। সর্বপরি, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থদের উদ্ধার, ক্ষতিপূরণ ও পূনর্বাসন নিশ্চিত করতে হবে। #
– লেখকবৃন্দ সকলেই নাগরিক সংগঠন – প্রাণ ও প্রকৃতি সুরক্ষা মঞ্চের সদস্য।