
রপ্তানীকৃত পণ্য থেকে আয় বেড়েছে প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা
চিংড়ি, কাঁচা পাটসহ রপ্তানী আয় বৃদ্ধির পরিমাণ ১৫.৭৮ শতাংশ
চলমান প্রকল্প ও নতুন ছয় লেনের প্রকল্পের ব্যয় হবে ৪২ হাজার কোটি টাকা
জন্মভূমি ডেস্ক : গত এক বছরে পদ্ম সেতু দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের ২১ জেলার তিন কোটি মানুষের জীবনমান পাল্টে দিয়েছে। খুলনা রপ্তানী উন্নয়ন ব্যুরোর হিসেব অনুযায়ী ২০২২-২৩ অর্থ বছেরে এ অঞ্চল থেকে বিদেশে রপ্তানীকৃত পণ্য থেকে আয় বেড়েছে প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা। পদ্মা সেতু চালুর পর থেকে এই পর্যন্ত খুলনা, বাগেরহাট, বরিশাল, সাতক্ষীরা, যশোর, মাগুরা, ফরিদপুর, ঝিনাইদাহ, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা অঞ্চলের রপ্তানী আয় বৃদ্ধির পরিমাণ প্রায় ১৬ শতাংশ। এ দিকে পদ্মা বহুমুখী সেতুর কারনে এ অঞ্চলে যেমন যোগাযোগ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন হয়েছে, তেমনি অর্থনীতিকে ব্যাপক চাঙ্গাও করে তুলছে। সেই সাথে প্রায় মৃত মোংলা বন্দর এখন কর্মচাঞ্চলে উদজ্বিবিত হয়ে উঠেছে। এ ছাড়া পদ্মা সেতু ঘিরে মোংলা বন্দরের সাথে সরাসরি সংযোগ ও উত্তরাঞ্চলের সাথে যোগাযোগ ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে ১৮টি প্রকল্পের আওতায় আনা হয়েছে। যশোর-খুলনা-মোংলা মহাসড়ক ছয় লেনে উন্নীতসহ আরও সাতটি প্রকল্পের কাজের প্রস্তুতিও চলছে। চলমান প্রকল্প ও নতুন ছয় লেনের প্রকল্পের সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৪২ হাজার কোটি টাকা।
জানযায়, ২০০৪ সলে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার পাটুরীয়ায় পদ্মা সেতু নির্মানের সিদ্ধান্ত নেয়। সেই সময়কার যোগাযোগ মন্ত্রী ব্যারিষ্টার নাজমুল হুদা পাটুরীয়া পদ্মা সেতুর বিষয়টি ঘোষনাও দেন। এই সিদ্ধান্তের পর পর মাওয়ায় পদ্মা সেতুর দাবিতে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার মানুষ আন্দোলনে রাজপথে নামে। স্মারকলিপি প্রদান, বিক্ষোভ, মানববন্ধন, অনশন সহ নানা কর্মসূচী পালন করেন পদ্মার এপারার মানুষ। দাবি বাস্তবায়নের জন্য সর্ব শেষ পদ্মার মাওয়া ঘাটে এই অঞ্চলের পেশাজীবিদের ডাকে লক্ষাধীক মানুষের সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। ওই বছরই তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেতা ও আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা খুলনা সফরে আসলে আন্দোলনরত নেতারা সাক্ষাৎ করেন। বৃহত্তর খুলনা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির নেতৃবৃন্দ সার্কিট হাউজে শেখ হানিার কাছে একটি স্মারক লিপি প্রদান করেন। এ সময় শেখ হাসিনা নেতৃবৃন্দদের প্রতিশ্রুতি দেন যে, আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় আসলে মাওয়ায়ই পদ্মা বহুমূখী সেতু নির্মাণ করা হবে। খুলনাসহ পদ্মার এপারের মানুষের দীর্ঘদিনের লালিত সেই স্বপ্ন অবশেষে পূরন হয়। ২০২২ সালে ২৫ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্ধোধনের মধ্যে দিয়ে শেষ পর্যন্ত সেই স্বপ্ন বাস্তবে রুপ নেয়। এরপর থেকে এ অঞ্চলের মানুষের আশা, আকাঙ্খা ও প্রত্যাশা পূরণ হতে শুরু করে। একের পর এক গড়ে উঠতে থাকে ছোট বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান। খুলনা রপ্তানী উন্নয়ন ব্যুরোর হিসেব অনুযায়ী গত এক বছরে চলতি অর্থ বছরে চলতি অর্থ বছরে ৬৪ কোটি ৭৯ লাখ ৪০ হাজার ৪৫৬ ডলারের কাচা পাট, চিংড়ি, কাঁকড়া সহ বিভিন্ন সামগ্রী রপ্তানী করা হয়েছে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ২০২১-২২ অর্থ বছরে রপ্তানী আয় ছিলো ৬ হাজার ৪৭ কোটি ৩৮ লাখ ২৫ হাজার ৮১৫ টাকা। পদ্মা বহুমুখী সেতু চালু হওয়ার পরে ২০২২-২৩ অর্থ বছরে রপ্তানী আয় হয়েছে ৭ হাজার ১ কেটি ৬৪ লাখ ৪৫ হাজার ৬৭৫ টাকা। ১ বছরে রপ্তানী আয় বৃদ্ধি হয়েছে ৯৫৪ কোটি ২৬ লাখ ১৯ হাজার ৮৬০ টাকা। অর্থাৎ রপ্তানী আয় বৃদ্ধির হার ১৫.৭৮ শতাংশ।
খুলনা রপ্তানী উন্নয়ন ব্যুরোর পরিচালক জিন্নাত আরা আহমেদ বলেন, যোগাযোগ হচ্ছে একটি দেশের সব কিছুর মাফকাঠি। পদ্মা সেতু বানিজ্যিক ক্ষেত্রে নতুন দিগন্ত সৃষ্টি করেছে। গত এক বছরে এ অঞ্চলে প্রচুর ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। বাণিজ্যের ক্ষেত্রে নতুন দিগন্তের সৃষ্টি হচ্ছে। বর্তমানে ব্যবসায়ীরা খুলনা, মোংলা, ভোমরা ও বেনাপোলকে রপ্তানীর রুট হিসাবে বেছে নিয়েছে। জিন্নাত আরা আরো বলেন, দক্ষিন-পশ্চিমাঞ্চল এলাকা থেকে ২০২১-২২ অর্থ বছরে ৫৫ কোটি ৯৬ লাখ ৯১ হাজার ৯২৫ ডলারের পণ্য বিদেশে রপ্তানী করা হয়েছিল। চলতি অর্থ বছরে ৬৪ কোটি ৭৯ লাখ ৪০ হাজার ৪৫৬ ডলারের পণ্য বিদেশে রপ্তানী করা হয়েছে। পদ্মা বহুমূখী সেতুর কারনে এখন ঝুঁকিমুক্ত পরিবেশে ও নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ব্যবসায়ীর পণ্য রপ্তানী করতে পারছেন বলেও জানান এই রপ্তানী উন্নয়ন ব্যুরোর পরিচালক। এদিকে পদ্মা সেতু ঘিরে মোংলা বন্দরের সাথে সরাসরি সংযোগ ও উত্তরাঞ্চলের সাথে যোগাযোগ ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে ১৮টি প্রকল্পের আওতায় আনা হয়েছে। যশোর-খুলনা-মোংলা মহাসড়ক ছয় লেনে উন্নীতসহ আরও সাতটি প্রকল্পের কাজের প্রস্তুতিও চলছে। চলমান প্রকল্প ও নতুন ছয় লেনের প্রকল্পের সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৪২ হাজার কোটি টাকা।
চলমান ১৪টি প্রকল্পে ১৪টি মহাসড়কে প্রশস্তকরণ কাজ রয়েছে । এ সব প্রকল্পের মধ্যে যশোর-খুলনা মহাসড়কের যশোর অংশ (পালবাড়ী হতে রাজঘাট অংশ), খুলনা জেলার সড়ক প্রশস্তকরণ, খুলনা-চুকনগর-সাতক্ষীরা মহাসড়কের খুলনা শহরাংশ চার লেনে উন্নীতকরণ, মাগুরা-শ্রীপুর মহাসড়ক বাঁক সরলীকরণসহ সম্প্রসারণ প্রকল্প, দর্শনা-মুজিবনগর আঞ্চলিক মহাসড়ক উন্নয়ন প্রকল্প, যশোর-মনিরামপুর-কেশবপুর-চুকনগর সড়ক উন্নয়ন প্রকল্পসহ আরও কয়েকটি প্রকল্পের কাজ শেষ পর্যায়ে। বাকি চারটি প্রকল্পে খুলনা ভৈরব সেতু, নড়াইলে কালিয়া সেতু, খুলনা সড়ক জোনে ত্রুটিপূর্ণ বেইলি সেতুর স্থলে কংক্রিট সেতু ও কুষ্টিয়ায় রেলওয়ে ওভারপাস নির্মাণ প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে। এ ছাড়া নতুন প্রকল্পে যশোর-খুলনা-মোংলা মহাসড়কে ১০০ কি.মি., ভোমরা থেকে নাভারন ৬০ কি.মি., যশোর থেকে ঝিনাইদহ ৫০ কি.মি., দর্শনা থেকে মুজিবনগর ৩০ কি.মি., কুষ্টিয়া থেকে মেহেরপুর ৫১ কি.মি., আঠারমাইল-পাইকগাছা-কয়রা সড়ক ৬২ কি.মি., ভাঙ্গা-ভাটিয়াপাড়া-নড়াইল-যশোর হয়ে বেনাপোল পর্যন্ত ১৩০ কিলেমিটার, ভাটিয়াপাড়া-গোপালগঞ্জ-বাগেরহাট-নওয়াপাড়া পর্যন্ত ৮০ কিলোমিটার সড়ক ছয় লেনে উন্নীত করার প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে।
সড়ক বিভাগ খুলনা সার্কেলর অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী সৈয়দ আসলাম আলী বলেন, চলমান প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের পাশাপাশি অর্থনীতি সমৃদ্ধ ও গতিশীল হবে। তিনি বলেন, ২০৪১ সালের মধ্যে আধুনিক সড়ক নেটওয়ার্ক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সড়কের ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি, প্রয়োজন অনুসারে সড়কে ফোর লেন, সিক্স লেন, ব্রিজ-কালভার্ট-ফ্লাইওভার তৈরিসহ বিভিন্ন পরিকল্পনা নেয়া হচ্ছে।
স্থানীয় সুধীজনরা বলছেন, এই সেতু শুধু যাতায়াত আর পরিবহনের সমাধান করেনি, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটিয়েছে। মৃত মোংলা বন্দরকে সচল করে সারা বিশ্বের কাছে মাথা উচু করে দাড় করিয়েছে পদ্মা সেতু।
খুলনা ২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও খুলনা মহানগর আওয়ামীলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক, আলহাজ্ব মিজানুর রহমান মিজান বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দায়িত্ব নেয়ার পরে এ দেশকে উন্নয়নের ক্ষেত্রে বিশ্বের কাছে সন্মানের স্থানে নিয়ে গেছেন। প্রধানমন্ত্রী যে কয়টি প্রকল্প হাতে নিয়ে ছিলেন তার মধ্যে বড় চ্যালেন্স ছিলো পদ্মা সেতু। মিজান, বলেন নিজেদের অর্থায়নে স্বপ্নের সেতু নির্মাণ করে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন শেখ হাসিনা। চ্যালেঞ্জের মুখে এই পদ্মা সেতু নির্মাণ একমাত্র বঙ্গবন্ধুর কন্যার পক্ষেই সম্ভ্যব হয়েছে। তিনি বলেন, পদ্মা সেতু চালু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মোংলা বন্দরের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ ব্যবস্থায় একটা আমূল পরিবর্তন হয়েছে। দেশের বিভিন্ন এলাকার ব্যবসায়ীরা বিদেশ থেকে গাড়ী আমদানী করছে। তারা কম খরচের জন্য চট্রগ্রাম পোর্ট ব্যবহার না করে এখন মোংলা পোর্ট থেকে তাদের গাড়ী ছাড়িয়ে নিচ্ছে। যে কারনে ২০২২ সালের ২৫ জুন এর পর থেকে চট্রগ্রাম পোর্ট থেকে মোংলা পোর্টে বেশী গাড়ী আমদানী হযেছে। তিনি বলেন বেনাপোল, এমনকি পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের সঙ্গে আমাদের বাণিজ্য বেড়ে গেছে। দেশের অন্যতম বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী খাত হিমায়িত মৎস্য ও পাট শিল্পে থেকে এ সময় রফতানির মাধ্যমে আয় অধিকাংশ খুলনা থেকে হতো। পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর সেই শিল্প আবারও তার ঐতিহ্য ফিরে পাচ্ছে, আয়ও বাড়েছে। এর পাশাপাশি কমে গেছে পণ্য পরিবহণেরও খরচ। পদ্মা সেতু কেবল দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নয়, পুরো বাংলাদেশের অর্থনীতির চেহারা বদলে দিয়েছে বলেও জানান আলহাজ্ব মিজান।
এদিকে পদ্মা সেতু হওয়ায় সবচেয়ে বেশি লাভবান হচ্ছেন এই অঞ্চলের হিমায়িত পণ্য রপ্তানীকারকরা। বাংলাদেশ ফোজেন ফুডস এক্সপোর্টার্স এ্যাসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি শেখ আব্দুল বাকী বলেন, পদ্মা সেতুর কারণে আবারও ঘুড়ে দাড়াতে যাচ্ছে বাংলাদেশের হিমায়িত মৎস্য শিল্প। সেতু দিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে যথা সময়ে হিমায়িত চিংড়ি ও অন্যান্য মাছ বিদেশে রপ্তানী করতে পারছে ব্যবসায়ীরা। এই কারনে রপ্তানীকারকরা অনেক সুফল ভোগ করছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
খুলনা সাংবাদিক ইউনিয়ন সাবেক সভাপতি এস এম জাহিদ হোসেন বলেন, খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, বরগুনা ও পটুয়াখালীর অংশবিশেষ নিয়ে বিশ্বের অন্যতম সুন্দরবন। ৬,৫১৭ বর্গ কিলোমিটার বিস্তৃর্ন এই বনের এলাকা। দীর্ঘ সময় নষ্ট হওয়ার কারনে ও যাতায়াত ব্যবস্থা ভালো না থাকায় এক সময় সুন্দরবনে আসতে দেশী-বিদেশী পর্যটকরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিলো। পদ্মা সেতু হওয়ার পরে সেই দৃশ্য পাল্টে গিয়েছে। গত এক বছরে দেশের অন্যপ্রান্ত থেকে দেশী ও বিদেশী পর্যটকদের ব্যাপক সমাগম ঘটছে। একদিকে স্থানীয়রা যেমন সুফল ভোগ করছে, তেমনি সরকার রাজস্ব পাচ্ছে বলেও জানান এই সাংবাদিক নেতা ।
বৃহত্তর খুলনা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সভাপতি শেখ আশরাফ উজ জামান বলেন, পদ্মা সেতু দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করে তুলছে। এ ছাড়া কৃষি ভিত্তিক শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠে মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। এক বছরে সড়ক পথে যোগাযোগ ব্যবস্থার আমল পরির্বতন সহ পণ্য পরিবহনের ব্যাপক সুযোগ হয়েছে। আশরাফ বলেন,পদ্মা সেতুর জন্য খুলনা থেকে ঢাকা যাওয়া আসার সময় সাশ্রয় হয়েছে। আগে ঢাকায় যেতে ফেরি পারাপারের ওপর নির্ভর করে ৬-৭ ঘণ্টা সময় লাগতো। এখন পদ্মা সেতু দিয়ে মাত্র সাড়ে ৩ ঘন্টায় এই অঞ্চলের মানুষ যাচ্ছে। তিনি বলেন, প্রধাণমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাওয়ায় পদ্মা সেতু নির্মাণ করে এ অঞ্চলের মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়েছেন।