এম এন আলী শিপলু : পদ্মা সেতু চালুর দুই বছরেও খুলনা অঞ্চলে প্রত্যাশিতভাবে গড়ে ওঠেনি শিল্পপ্রতিষ্ঠান। সেতু নির্মাণের সময়কাল থেকেই এ অঞ্চলে জমি কিনে শিল্প উদ্যোক্তারা বিনিয়োগ শুরু করেন। কিন্তু জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত না হওয়া এবং ইকোনমিক জোন না থাকায় এ অঞ্চলে বড় আকারে ডানা মেলেনি অর্থনৈতিক সম্ভাবনা। পদ্মা সেতুর পুরোপুরি সুফল পেতে দ্রুত দক্ষিণাঞ্চলে পাইপলাইনের মাধ্যমে গ্যাস সরবরাহের দাবি এ অঞ্চলের শিল্প উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ী নেতাদের।
পদ্মা সেতু নির্মাণকাল থেকেই খুলনা-বাগেরহাটসহ দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোর মহাসড়কের আশপাশের জমির দাম বাড়তে থাকে। মহাসড়কের দু’পাশে চোখে পড়বে অসংখ্য শিল্পপ্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড। খালি জমিতে সাইনবোর্ড থাকলেও এসব এলাকায় এখনও গড়ে ওঠেনি অবকাঠামো।
বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের তথ্য বলছে, পদ্মা সেতু নির্মাণকালীন ২০২০-২১ এবং ২০২১-২২ অর্থবছরে খুলনা অঞ্চলে ৭৪টি প্রতিষ্ঠান নিবন্ধিত হয়। এ সময়ে প্রতিষ্ঠানগুলো এ অঞ্চলে প্রায় ২ হাজার ৮শ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে। আর সেতু চালুর পরের দুই বছরে ৩৯টি প্রতিষ্ঠান ১ হাজার ৯শ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে। কিছু-কিছু শিল্পপ্রতিষ্ঠান কাজ শুরু করেছে অবকাঠামো নির্মাণে, কিছু প্রতিষ্ঠানে শুরু হয়েছে বাণিজ্যিক উৎপাদনও। তবে অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের লগ্নি করা অর্থ জমি কেনাতেই সীমাবদ্ধ।
যোগাযোগব্যবস্থা সহজ এবং মোংলা বন্দর খুব কাছে হওয়ায় এসব স্থানে ব্যবসায়ীদের আগ্রহ বেশি থাকলেও, জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত না হওয়ায় অবকাঠামো উন্নয়ন বা উৎপাদনে যাওয়ার অপেক্ষায় তারা। পদ্মা সেতুর পুরোপুরি সুফল পেলে এ অঞ্চলে দ্রুত পাইপলাইনে গ্যাস সরবরাহ ও ইকোনমিক জোন তৈরির দাবি তাদের।
পদ্মা সেতু চালুর আগের দু’বছর ও চালুর পরের দু’বছর বড় অঙ্কের টাকা বিনিয়োগ হলেও টাকার অধিকাংশটাই ছিল জমি কেনা বাবদ। সবশেষ দুবছরে খুলনা অঞ্চলে নতুন করে শিল্পপ্রতিষ্ঠান হয়েছে মাত্র ১১টি। অথচ প্রত্যাশা ছিল যোগাযোগব্যবস্থাকে কাজে লাগিয়ে দ্রুত শিল্পায়ন হবে খুলনা অঞ্চলে। সে অনুযায়ী জমিও কিনে রেখেছেন শিল্প উদ্যোক্তারা। তবে তারা এখন শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার ঝুঁকি নিতে চান না জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত না হওয়ার কারণে।
খুলনা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির পরিচালক চৌধুরী মিনহাজ উজ জামান সজল বলেন, ‘পদ্মা সেতুর কাজ চলাকালীন অবস্থা থেকেই দেশি-বিদেশি বিভিন্ন বড় বড় প্রতিষ্ঠান শিল্প গড়ে তোলার জন্য আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। আমরা তাদের আশ্বস্তও করেছিলাম। তবে পাইপলাইনে গ্যাস সরবরাহ না থাকায় আর্থিক ঝুঁকি নিতে চাচ্ছেন না অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান। মূলত মোংলা বন্দরকে কেন্দ্র করেই তাদের আগ্রহ বেশি ছিল। খুলনা-মোংলা মহাসড়েকের আশপাশে এসব প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা গেলে মোংলা থেকে বিদেশে রফতানি করার ক্ষেত্রে খরচ অনেক কমে আসবে। তবে পাইপলাইনে গ্যাস না থাকায় বিদ্যুতের ওপর ভর করে প্রতিষ্ঠানগুলো দাঁড়াচ্ছে না। এতে একদিকে যেমন এ অঞ্চলে শিল্পায়ন হচ্ছে না, তেমনি প্রত্যাশিতভাবে মোংলা বন্দরের কার্যক্রমও বাড়ছে না।’ ‘আমরা সরকারের কাছে দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছি, এ অঞ্চলে শিল্পায়নের এত সুযোগ আর পদ্মা সেতুর পুরোপুরি সুফল পেতে পাইপলাইনের মাধ্যমে দ্রুত গ্যাস সরবরাহ করা প্রয়োজন।’
খুলনা-মোংলা মহাসড়কের কাটাখালি এলাকায় বিশাল এলাকাজুড়ে জমি কিনে রেখেছে হ্যামকো গ্রুপ। তবে অবকাঠামো নির্মাণের কাজই শুরু হয়নি তাদের এখনও। এ এলাকায় প্রতিষ্ঠানটির একটি প্লাস্টিক তৈরির কারখানা রয়েছে।
প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপক সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘কাটাখালি এলাকায় আমাদের প্লাস্টিক কারখানা রয়েছে। বিদ্যুতের মাধ্যমে এখানে আমরা পণ্য উৎপাদন করি। তবে এ পণ্য উৎপাদন করতে আমাদের অনেক খরচ পড়ে যায়। যে খরচ দিয়ে মার্কেটে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা বেশ কষ্টকর। পাশেই আমাদের আরও কিছু জায়গা কেনা রয়েছে। গ্যাসের নিশ্চয়তা পেলেই আমরা এখানে নতুন কারখানা তৈরি করব। আমরা আশা করব, সরকার দ্রুত এ অঞ্চলে গ্যাস সরবরাহের ব্যবস্থা করবে।’
খুলনা চেম্বার অব কমার্সের আরেক পরিচালক জেডএ মাহমুদ বলেন, ‘খুলনা অঞ্চলে শিল্পায়নের দারুণ সম্ভাবনা রয়েছে। এ জন্য প্রতিবন্ধকতাগুলো দূর করতে হবে। পাইপলাইনে গ্যাস সরবরাহের পাশপাশি এ অঞ্চলে ইকোনমিক জোনেরও খুব প্রয়োজন। ব্যবসায়ীরা যখন একসঙ্গে অনেক জমি খুঁজতে যান, সবসময় সেটা পান না। এ কারণে একস্থানে বেশি জমির জন্য ইকোনমিক জোনেরও প্রয়োজন।’
বিনিয়োগ উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য বলছে, সবশেষ দুবছরে খুলনা অঞ্চলে গড়ে ওঠা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে প্রায় সাড়ে তিন হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। তবে এ সংখ্যা আরও বহু বাড়তে পারতো বলে মত চেম্বার অব কমার্সের আরেক পরিচালক মফিদুল ইসলাম টুটুলের।
তিনি বলেন, ‘পদ্মা সেতু আমাদের অনেক কিছু দিয়েছে; আরও অনেক দেবে। এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক যে সম্ভাবনা রয়েছে, তার জন্য শিল্পায়ন জরুরি। এখানে যেসব শিল্পপ্রতিষ্ঠান জমি কিনে রেখেছে, সেগুলো উৎপাদনে গেলে আরও বহু মানুষের কর্মসংস্থান হবে।’
বিনিয়োগ বা শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে বড় প্রতিবন্ধকতা গ্যাস-- এটা স্বীকার করেন বিনিয়োগ উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তা প্রণব কুমার রায়। তবে দেশি-বিদেশি শিল্প উদ্যোক্তাদের আকৃষ্ট করতে বোর্ড কাজ করছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এটা ঠিক আমরা যেভাবে ভেবেছিলাম, সেভাবে গত দুবছরে এ অঞ্চলে বিনিয়োগ হয়নি। তবে আমরা বিভিন্নভাবে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করছি। অন্যান্য সুযোগ সুবিধাও নিশ্চিত করার চেষ্টা করছি। আশা করছি, সামনের বছরগুলোতে আরও বেশি বিনিয়োগ হবে, বাড়বে শিল্পপ্রতিষ্ঠান।’
প্রধান সম্পাদক: লে. কমান্ডার (অব.) রাশেদ ইকবাল, প্রকাশক আসিফ কবীর কর্তৃক জন্মভূমি প্রকাশনী লি: ১১০/২,সাংবাদিক হুমায়ুন কবীর বালু সড়ক, খুলনা থেকে মূদ্রিত ও প্রকাশিত