জন্মভূমি ডেস্ক : দূষণের ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণের পরিমাণ বাড়িয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তর। এরই মধ্যে তা কার্যকরও করেছে সংস্থাটি। নতুন ঘোষিত ক্ষতিপূরণের ক্ষেত্রে মানমাত্রার তারতম্যের বিষয়টিও সুনির্দিষ্ট করা হয়েছে। তবে এ ধরনের সিদ্ধান্তের আগে ক্ষতিগ্রস্তদের সঙ্গে আলোচনা জরুরি ছিল বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, গত ১৪ জানুয়ারি থেকে এনফোর্সমেন্টের হার পুনর্র্নিধারণ করেছে সংস্থাটি। এক অফিস আদেশ জারি করে সব ধরনের দূষণের দায়ে ক্ষতিপূরণের হার পুনর্র্নিধারণ করা হয়। অফিস আদেশে বলা হয়, ‘বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫ (সংশোধিত-২০১০)-এর ধারা ৭ অনুযায়ী মহাপরিচালককে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে বিভিন্ন ধরনের শিল্প, প্রকল্প, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, আবাসিক স্থাপনা, উদ্যোগ এবং ঘটনা দ্বারা পরিবেশ ও প্রতিবেশের ক্ষতিসাধনের জন্য সংযুক্তি-১, সংযুক্তি-২ ও সংযুক্তি-৩-এ উল্লেখিত হারে ক্ষতিপূরণ পুনর্র্নিধারণ করা হলো। এ-সংক্রান্ত আগের সব অফিস আদেশ এতদ্বারা বাতিল করা হলো। জনস্বার্থে জারীকৃত এ আদেশ অবিলম্বে কার্যকর হবে।’
জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তরের মনিটরিং অ্যান্ড এনফোর্সমেন্টের পরিচালক মোহাম্মাদ মাসুদ হাসান পাটোয়ারী বলেন, ‘গত মাসের ১৪ তারিখ থেকে আমরা নতুন হারে এনফোর্সমেন্ট ধার্যের বিষয়টি কার্যকর করেছি। ফলে পরিবেশ দূষণকারীদের বিরুদ্ধে এখন আগের চেয়ে বেশি ক্ষতিপূরণ ধার্য করা যাচ্ছে।’
পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র, জ্বালানি তেলবিদ্যুৎ কেন্দ্র, গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, সিমেন্ট শিল্প, টেক্সটাইল স্পিনিং মিল, সার কারখানা, শিল্পপ্রতিষ্ঠানের বয়লার গ্যাসীয় নিঃসরণ ক্ষেত্র, ব্যাটারি প্রস্তুত শিল্প, সিরামিক টাইলস ও স্যানিটারিওয়্যার প্রস্তুতকারী কারখানা, ইটভাটাসহ পরিবেশ দূষণের যতগুলো মাধ্যমে পরিবেশ দূষণ হচ্ছে, সব মাধ্যমেই ক্ষতিপূরণ ধার্যের পরিমাণ বাড়ানো হয়েছে।’
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, শিল্পপ্রতিষ্ঠান থেকে ডিসচার্জ করা পানিতে পিএইচের গ্রহণযোগ্য মাত্রা হলো প্রতি ঘনমিটারে ৬ দশমিক ৫ থেকে ৮ পর্যন্ত। আগে কোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠানের দূষণ পানির পিএইচ ১০ বা ১৫ বাড়ালে যে পরিমাণ ক্ষতিপূরণ ধার্য করা হতো, পিএইচ ২০ করলেও একই পরিমাণ জরিমানা করা হতো।
একইভাবে বায়ুদূষণের ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য মানদণ্ড হলো প্রতি মাইক্রোগ্রামে বস্তুকণা (পিএম) ৫০। এটা যদি কেউ মিলিগ্রামপ্রতি ১০০ বা কমবেশি করত তাহলে একই ক্ষতিপূরণ ধার্য করা হতো। কিন্তু নতুন ঘোষণা অনুযায়ী দূষণকারী কী পরিমাণ দূষণ করছে সেটা বিবেচনায় নিয়ে ক্ষতিপূরণ ধার্য করবে পরিবেশ অধিদপ্তর।
সিমেন্ট প্লান্ট বা ক্লিংকার গ্রাইন্ডিং প্লান্ট থেকে প্রলম্বিত বস্তুকণার (এসপিএম) গ্রহণযোগ্য মানমাত্রা হচ্ছে প্রতি মাইক্রোগ্রাম/ঘনমিটার ৬০০। নতুন ঘোষণা অনুযায়ী দূষণের মাত্রা যদি ৬০০-৮০০ পর্যন্ত হয় তাহলে ক্ষতিপূরণ ধার্য হবে ২ লাখ টাকা। আবার ৮০০-১০০০ হালে ৪ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ ধার্য করা হবে। এক হাজারের ওপরে গেলে ক্ষতিপূরণ ধার্য হবে ৬ লাখ টাকা।
একইভাবে বেড়েছে ছাড়পত্র ছাড়া বা নবায়ন না করে শিল্পপ্রতিষ্ঠান পরিচালনার ক্ষতিপূরণ হারও। সবুজ-হলুদ-কমলা ও লাল শ্রেণীর কোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠান যদি পরিবেশগত ছাড়পত্র না নেয় তাহলে জায়গার পরিমাণ অনুযায়ী ক্ষতিপূরণ ধার্য করা হবে। লাল শ্রেণীর শিল্পপ্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে ছাড়পত্র না নিলে একরপ্রতি ৩ লাখ টাকা, এক থেকে তিন একর পর্যন্ত ৬ লাখ, তিন থেকে ছয় একর পর্যন্ত ১২ লাখ, ছয় থেকে ১০ একর পর্যন্ত ২৫ লাখ ও ১০ একরের বেশি হলে ৫০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ ধার্য করা হয়েছে।
তবে ক্ষতিপূরণ বৃদ্ধির আগে বিষয়টি নিয়ে ক্ষতিগ্রস্তদের সঙ্গে শুনানি করার প্রয়োজনীয়তা ছিল বলে মনে করেন ধরিত্রী রক্ষায় আমরার (ধরা) সদস্য সচিব শরীফ জামিল। তিনি বলেন, ‘যারা ক্ষতিগ্রস্ত তাদের পরামর্শ নিয়ে তবেই ক্ষতিপূরণের হার বাড়ানোর প্রয়োজন ছিল। কিন্তু পরিবেশ অধিদপ্তর কোনো কাজের আগেই ক্ষতিগ্রস্তদের মতামত নেয় না। আর ক্ষতিপূরণ ধার্যের পরিমাণ এমন হওয়া উচিত যেটা দৃষ্টান্তমূলক হয়। ৫০ লাখ থেকে ১ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ ধার্য করে কখনই পরিবেশ দূষণের লাগাম টানা যাবে না।’
বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫ (সংশোধিত ২০১০)-এর ৭ ধারা মোতাবেক কোনো ব্যক্তির কর্মকাণ্ড দ্বারা পরিবেশের ক্ষতি হলে ওই ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণপূর্বক জড়িত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে তা আদায়ের বিধান রয়েছে। এটি ‘পল্যুটারস পে প্রিন্সিপল’ নামে বহুল পরিচিত। উন্নত বিশ্বের দেশগুলোয় পরিবেশ সংরক্ষণে এর বহুল প্রয়োগ লক্ষণীয়।
দূষণকারীরা যেন আপিলের সুযোগ নিয়ে ধার্যকৃত ক্ষতিপূরণ একেবারে নামমাত্র অংকে নামিয়ে না আনে এ বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয়কে সতর্ক থাকতে হবে বলে দাবি পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘বাংলাদেশে যে পরিমাণ পরিবেশের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে এবং হচ্ছে এর বিপরীতে ক্ষতিপূরণ ধার্য অনেক বেশি হওয়ার কথা। পরিবেশ দূষণকারীরা ক্ষতিপূরণ ধার্যের পর আপিল করে সেটা একেবারে নামমাত্র অংকে নিয়ে আসে। আমরা একটা আবাসন কোম্পানির বিরুদ্ধে মামলা করলে ৫০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ ধার্য করা হয়। পরে আপিল করে সেটা মাত্র ৫ লাখ টাকায় নিয়ে আসা হয়। তার মানে পরিবেশ দূষণ রোধে মন্ত্রণালয়ের কোনো সদিচ্ছা আছে বলে মনে হয় না। সরকার আমাদের শুধু উন্নয়নের গল্প বলে, পরিবেশের কোনো কথা তো আমরা শুনি না। তাই পরিবেশের উন্নতির জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা সবার আগে প্রয়োজন।’
পরিবেশ দূষণে ক্ষতিপূরণের পরিমাণ বাড়িয়েছে অধিদপ্তর
Leave a comment