
শাহরিয়ার কবির,পাইকগাছা (খুলনা) : ভোর হলেই পাইকগাছার আকাশ ঢেকে যায় ঘন কালো ধোঁয়ায়। দূর থেকে দেখলে কুয়াশা মনে হলেও কাছে গেলেই স্পষ্ট—এটি ইটভাটার বিষাক্ত ধোঁয়া। উপজেলার প্রায় ১৫টি ইটভাটার অধিকাংশই পরিবেশগত ছাড়পত্র, অগ্নি নিরাপত্তা ও প্রয়োজনীয় আইনগত অনুমোদন ছাড়াই বছরের পর বছর ধরে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। অথচ এসব ভাটার আশপাশে রয়েছে বসতবাড়ি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ফসলি জমি—যা বিদ্যমান আইন অনুযায়ী সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
চিমনির নিচে দাঁড়িয়ে আজ আইন যেন অসহায়। ধোঁয়ার আড়ালে গড়ে উঠেছে একটি প্রভাবশালী সিন্ডিকেট, যারা পরিবেশ আইন, কৃষিজমি সুরক্ষা ও জনস্বাস্থ্য—সবকিছুকেই ইট বানিয়ে পুড়িয়ে দিচ্ছে।
একটি ভাটা ছাড়া বাকি ১২টি কোনো ধরনের বৈধ অনুমোদন ছাড়াই চলছে। তবুও বছরের পর বছর ধরে সেগুলো দাপটের সঙ্গে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। প্রশাসন বিষয়টি জানে, স্থানীয়রা ভোগে—তবুও প্রশ্ন থেকেই যায়, কার ছত্রচ্ছায়ায় চলছে এই ধোঁয়ার সাম্রাজ্য?
স্থানীয়দের অভিযোগ, প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে নয়—বরং প্রশাসনের নীরব উপস্থিতিতেই অবৈধ ইটভাটাগুলো সমান তালে চলছে। ফলে প্রশ্ন উঠছে—প্রশাসন কি কেবল নিরব দর্শক, নাকি এর পেছনে রয়েছে অদৃশ্য কোনো সমঝোতা?
স্থানীয়রা জানান, দীর্ঘদিন ধরে এসব ইটভাটা অবৈধভাবে পরিচালিত হচ্ছে। শুকনো মৌসুমে সড়কে মাটি পড়ে, আর বৃষ্টির সময় সেই মাটি কাঁদায় পরিণত হয়ে সড়ককে মরণ ফাঁদে পরিণত করে। ভাটার মালিকদের বিরুদ্ধে মুখ খুললেই নানা ভয়ভীতি দেখানো হয় বলেও অভিযোগ রয়েছে।
এক কৃষক ক্ষোভের সঙ্গে বলেন,“ধান আর সবজির পাতায় কালো আস্তরণ পড়ে। আগের মতো ফলন হয় না। ক্ষতির দায় কেউ নেয় না। আমাদের জমি ধীরে ধীরে বিষাক্ত হয়ে উঠছে।”
অগ্নি নিরাপত্তাহীন ভাটা, যে কোনো সময় বড় দুর্ঘটনার শঙ্কা
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, অধিকাংশ ইটভাটায় নেই ফায়ার এক্সটিংগুইশার, নেই প্রশিক্ষিত কর্মী কিংবা জরুরি ব্যবস্থাপনার কোনো প্রস্তুতি। কাঠ ও নিম্নমানের জ্বালানি ব্যবহারের কারণে যে কোনো সময় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটতে পারে। স্থানীয়দের আশঙ্কা—একটি দুর্ঘটনাই পুরো এলাকা ধ্বংস করে দিতে পারে।
শ্রমিকরা নীরব বন্দী
ইটভাটার শ্রমিকদের অবস্থাও শোচনীয়। সুরক্ষা সরঞ্জাম ছাড়াই ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত তারা। নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষার কোনো ব্যবস্থা নেই। নারী ও কিশোর শ্রম ব্যবহারের অভিযোগও উঠেছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক শ্রমিক বলেন,“কাজ না করলে খাওয়ার টাকা নেই। অসুস্থ হলে নিজের খরচেই চিকিৎসা করতে হয়।”
১২টি ভাটা অবৈধ—তবু চলছে দাপটে চাঁদখালী, গদাইপুর, রাড়ুলী ও হরিঢালী ইউনিয়নে বর্তমানে ১৩টি ইটভাটা কৃষিজমির ওপর অবস্থিত। এর মধ্যে মাত্র একটি ভাটার বৈধ কাগজপত্র রয়েছে। বাকি ১২টি সম্পূর্ণ অবৈধ।
এছাড়া রাড়ুলী এলাকার দুটি ভাটার মালিক দাবি করেন, তারা সাতক্ষীরা জেলার আওতাভুক্ত—এ কারণে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। অথচ এসব ভাটা সারা বছর নদীতে অবৈধভাবে ড্রেজার বসিয়ে বালি উত্তোলন করছে। আজ পর্যন্ত এ বিষয়ে প্রশাসনের কোনো কার্যকর পদক্ষেপ দেখা যায়নি। সচেতন মহলের প্রশ্ন—এই ক্ষমতার উৎস কোথায়? তবে কি আইন চলে ভাটামালিকদের ইশারায়?
কঠোর নির্দেশ, বাস্তবায়ন নেই
গত বছর সাবেক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাহেরা নাজনীন স্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছিলেন—
“এক সপ্তাহের মধ্যে অবৈধ ইটভাটাগুলো বন্ধ না করলে আইন অনুযায়ী স্থাপনা গুঁড়িয়ে দেওয়া হবে।”
সভায় প্রশাসনের কর্মকর্তা, ভাটা মালিক ও রাজনৈতিক নেতারা উপস্থিত থাকলেও বাস্তবে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এতে জনমনে প্রশ্ন উঠছে—তবে কি প্রশাসন টাকার কাছে বিক্রি হয়ে গেছে?
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ওয়াসিউজ্জামান চৌধুরী বলেন,
“আমি সদ্য যোগদান করেছি। কিছু দিনের মধ্যেই অভিযান পরিচালনা করা হবে। অবৈধভাবে পরিচালিত ইটভাটার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
অভিযানে বিলম্বের বিষয়ে তিনি জানান,“উপজেলায় ফায়ার সার্ভিস না থাকায় আপাতত অভিযান পরিচালনা করা সম্ভব হচ্ছে না। স্কেভেটরের প্রয়োজন হয়। পাশ্ববর্তী উপজেলার ফায়ার স্টেশনের সঙ্গে সমন্বয় করে অভিযান পরিচালনার পরিকল্পনা রয়েছে।”
গত বছর সাত দিনের সময়সীমা অমান্য করে ভাটা মালিকরা পুনরায় কার্যক্রম শুরু করেছে—এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি দৃঢ় কণ্ঠে বলেন,
“অবৈধভাবে কোনো ইটভাটা চলতে দেওয়া হবে না। বৈধতা না থাকলে জায়গায় ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হবে।”
খুলনা পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. আসিফুর রহমান বলেন,“আমরা পাইকগাছা উপজেলায় অভিযান পরিচালনা করব। উপজেলাটি কিছুটা ক্রিটিক্যাল হওয়ায় সেখানে সব ধরনের নিরাপত্তা ও প্রয়োজনীয় প্রটেকশন নিশ্চিত করেই অভিযানে নামতে হবে। আমরা গত বছরও সম্মিলিতভাবে অভিযান চালানোর বিষয়ে আলোচনায় বসেছিলাম, তবে তখন তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। এবার অবশ্যই অভিযান পরিচালনা করা হবে।”
পাইকগাছার আকাশে প্রতিদিন ধোঁয়া উঠছে। কিন্তু এই আগুন যদি এখনই না নেভানো হয়, তবে তা শুধু ইট পোড়াবে না—ধ্বংস করবে মানুষের জীবন, কৃষি ও পরিবেশ। এখন দেখার বিষয়, প্রশাসনের কথার সঙ্গে বাস্তব কাজের মিল হয় কি না। স্থানীয়দের একটাই দাবি—এবার যেন অভিযান কাগজে নয়, মাঠে দেখা যায়।

