পূর্ণ চন্দ্র মন্ডল, পাইকগাছা : পাইকগাছায় এবার আমন ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। মাঠজুড়ে কৃষকের সোনালি আমন ধান দোল খাচ্ছে। আমন ধানের বাম্পার ফলনে খুঁশি কৃষকেরা। ধান পাকতে শুরু করায় কাটা ও মাড়াইয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন কৃষক ও শ্রমিকরা। চাষের খরচ মিটিয়ে তারা ধারদেনাও শোধ করতে পারবেন বলে এমনটিই আশা করছেন। এবছর উপজেলায় আমনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৭ হাজার ৪ শত ২৫ হেক্টর। জমিতে রোপা আমনের আবাদ হয়েছে ১৫ হাজার ৪ শত ২৫ হেক্টর। বাকি ২ হাজার হেক্টর জমি প্রাকৃতিক দুর্যোগ, দুর্বল বেড়িবাঁধ ভেঙে বন্যা, অতিবৃষ্টি, জলাবদ্ধতায় পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা না থাকা সহ নানাবিধ প্রতিবন্ধকতায় সম্ভব হয়নি। অনেক চাষী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সরজমিনে, কৃষক ও দায়িত্বরত সরকারি কর্মকর্তাদের সাথে আলোপচারিতায় জানা যায়, ইতোমধ্যে আমনের ধান কর্তন শুরু হয়েছে। উঁচু ক্ষেতের আমন ধান কর্তন ও ঝাড়াই চলছে। তবে নিচু ও মৎস্য লিজ ঘেরের কোন আমন ক্ষেতের ধানে দুধ এসেছে ও ক্ষেতের ধান সবুজ রং ধারণ করেছে। ১৫ থেকে ২০ দিনের মধ্যে এসব ক্ষেতের ধান কাটার উপযোগী হবে। উচু ক্ষেতের ধান ইতোমধ্যে প্রায় ৭ হাজার হেক্টর ধান কাটা হয়েছে। আগামী ১০-১২ দিনের মধ্যে বাকী ধান কাটা সম্পন্ন হবে বলে কৃষকরা জানিয়েছে। উপকূলীয় এ অঞ্চলের নড়বড়ে বেড়িবাঁধ সংস্কার না হওয়ায় বেড়িবাঁধ ভেঙে বন্যায় সোনা খ্যাত দেলুটির ২২নং পোল্ডার জুড়ে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত, গড়ইখালীর খুদখালি সহ আংশিক। সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা বিলের ভরাটি বদ্ধ নদনদী ও খাল গুলো খনন না করায়, দখল বেদখল, ইজারাদারের দৌরাত্ম, নেটপাটা, যত্রতত্র বাঁধে অতিবৃষ্টিতে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা না থাকায় জলাবদ্ধতার জন্য কৃষকরা সময় মত আমনের আবাদ করতে পারেনি। কৃষকরা আগাম কিছু ক্ষেতে সেচ দিয়ে চারা রোপন করেছে আবার দেরিতে প্রচুর বৃষ্টি হওয়ায় নাবি আবাদ করতে হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অন্য এলাকা থেকে উপকূল এলাকায় এক মাস পরে কৃষি কাজের পরিবেশ তৈরি হয়। আবহাওয়া জনিত কারণ ও মৎস্য লীজ ঘের গুলোতে দেরিতে আমনের আবাদ করা হয়। সে জন্য আমন ধান কাটাও দেরিতে শুরু হয়। তবে এতকিছুর পরও নতুন আমন ধান আশানারুপ দামে বিক্রি হচ্ছে। নতুন আমন ধান মন প্রতি সাড়ে ১৪শ থেকে সাড়ে ১৫শ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। তবে ধানের থেকে বিচুলীর চাহিদা থাকায় কৃষকরা আরও বেশী লাভবান হচ্ছে।
উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, এ মৌসুমে উপজেলার ১টি পৌরসভা ও ১০টি ইউনিয়নে আমনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৭ হাজার ৪ শত ২৫ হেক্টর। প্রাকৃতিক দুর্যোগ বন্যা অতিবৃষ্টির ফলে বর্তমানে গত খরিদ ২ মৌসুমে ১৫ হাজার ৪ শত ২৫ হেক্টর জমিতে রোপা আমনের আবাদ হয়। এর মধ্যে উপজেলায় উঁচু ক্ষেতে প্রায় ৭ হাজার হেক্টর জমির ধান কাটা সম্পন্ন হয়েছে। কর্তনকৃত ধানের হেক্টর প্রতি ফলন হাইব্রিড ৫.৯ মেট্রিকটন ও উফশী ৫.৬ মেট্রিকটন হারে ফলন পাওয়া যাচ্ছে। আর নাবিতে লাগানো ক্ষেতের ৩০ ভাগ ধানে দুধ হয়েছে ও ২২ ভাগ পাকা এবং দানা অবস্থায় আছে।উপজেলার গদাইপুর ইউনিয়নের হিতামপুর ব্লকের কৃষক আলাউদ্দিন, পুরাইকাটী ব্লকের কৃষক ফারুক হোসেন ও তোকিয়া ব্লকের কৃষক শফিকুল জানান, বৈরি আবহাওয়ার পরও তাদের ক্ষেতের আমনের ফলন ভালো হয়েছে। মটবাটি গ্রামের কৃষক আলাউদ্দিন বলেন, তার মৎস্য ঘেরে আবাদকৃত ক্ষেতের ধানে দুধ এসেছে। তাছাড়া মাজড়া পোকা লাগায় অতিরিক্ত পরিচর্যা ও কীটনাশক ব্যবহার করতে হয়েছে। কিছু কিছু ক্ষেতের ধানে চিটার পরিমানও বেশী দেখা যাচ্ছে। এতে কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে।
উপজেলার দেলুটি ইউনিয়ন, গড়ইখালী, রাড়ুলী, গদাইপুর ও চাঁদখালী ইউনিয়নের গজালিয়া, মৌখালী, কৃষ্ণনগর, দেবদুয়ার কৃষক বৃন্দাবন দেবনাথ, স্বপন ঘোষ, আঃ সামাদ গাজী, প্রকাশরা জানান, উপজেলা কৃষি অফিসের সহায়তায় আমন ধানের প্রবল সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অতিবৃষ্টিতে জলাবদ্ধতায় ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়। আশানুরূপ ফসল হয়নি। খাল, নদী ভরাট থাকায় যথাসময়ে পানি নিস্কাশন করা সম্ভব হয়নি। তারা খাল ও নদী গুলো খনন এবং ইজারা বন্ধ করে পানি সরবরাহ নিশ্চিত করার কথা বলেছেন।
এদিকে, গত বুধবার দিনব্যাপী ঘূর্ণিঝড় রিমেল ও অতিবৃষ্টির কারণে প্লাবিত পাইকগাছা উপজেলার অধিক ক্ষতিগ্রস্থ ৪ নং দেলুটি ইউনিয়নের সাধারণ জনগণের সার্বিক খোঁজ খবর নেওয়া, দেলুটি ইউনিয়ন পরিদর্শন, পাশাপাশি উপজেলা প্রশাসন ও উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর এর সহযোগীতায় বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থ কৃষকদের মাঝে বিনামূল্যে সরিষা , সুইট কর্ণ জাতের ভুট্টা, সূর্যমূখি বীজ, শীতকালীন সবজির বীজ এবং সার বিতরণ করেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার মাহেরা নাজনীন।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মোঃ একরামুল হোসেন জানান, আমনের ফলন ভাল হয়েছে। আবহাওয়ার কারণে কৃষকদের আমন আবাদ শুরু করতে কিছুটা দেরি হলেও পরে প্রচুর বৃষ্টিতে লবণাক্ত মাটি পরিশোধিত হওয়ায় আমনের ফলন ভাল হয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং অতিবৃষ্টিতে জলাবদ্ধতায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের মাঝে প্রণোদনা হিসেবে নগদ অর্থ ও বীজ, সার বিতরণ করা হয়। বেড়িবাঁধ সংস্কার, পানি নিষ্কাশনে খাল ও নদী খননের ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে অবহিত করা হয়েছে। ইতোমধ্যে সোনালী অঞ্চল খ্যাত এ জনপদের মানুষ কৃষি খাতে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করে চললেও উপরের উল্লেখিত প্রতিবন্ধকতা উপজেলার কৃষি সেক্টরে উৎপাদনের জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। কৃষি প্রণোদনা, নিচু জমিতে লম্বা জাতের বীজ, খাল ও বদ্ধ নদী খনন, উপকূলীয় এ অঞ্চলে স্থায়ী বেড়িবাঁধ নির্মাণ সহ অন্যান্য সমস্যা সমাধানে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন এলাকাবাসী।
পাইকগাছায় আমন ধানের বাম্পার ফলন
Leave a comment