লক্ষ্যমাত্রা সাড়ে ১৪ শত হেক্টর ছাপিয়ে সাড়ে ২৩ শত হেক্টর
পূর্ণ চন্দ্র মন্ডল, পাইকগাছা : বিস্তৃর্ণ প্রান্তর। দু’চোখে যতদূর দৃষ্টি যায় মাঠে পর মাঠ তরমুজের চারা পরিচর্যায় ব্যস্ত কৃষাণ-কৃষাণীরা। কাউকে বীজতলা প্রস্তুত করতে দেখা যায়, কেউ করছেন রোপণ, আবার কেউ কেউ পানি সেচ দিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন। বলা যায় দম ফেলার ফুরসত নেই। সার, কীটনাশক, শ্রমিকের দাম বৃদ্ধি নিয়ে চিন্তিত তারা। গত বছর তরমুজের বাম্পার ফলন হাওয়ায় এবছর তরমুজ চাষে বেশি আগ্রহ নিয়ে মাঠে নেমে পড়েছেন তারা। এভাবে দিন যায় এক একটা চারা মাথা তুলে যত বেড়ে উঠছে চাষীদের স্বপ্ন পূরণের আশায় তত বুক বাঁধছে। তপ্ত রোদে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কৃষক-কৃষাণীরা তরমুজ ক্ষেত পরিচর্যায় ব্যস্ত হতে দেখা যায় উপজেলায় দেলুটি ও গড়ুইখালী ইউনিয়ানের বিভিন্ন এলাকার তরমুজ চাষীদের মধ্যে। আবার মৌসুমে ক্ষেতগুলোতে এলাকার শ্রমিকদের কর্মসংস্থানের সুযোগ মেলে এতে খুশি স্থানীয় শ্রমিকরা।
গত বছরের তুলনায় এ বছর চলতি মৌসুমে দ্বিগুণ বেশি জমিতে তরমুজ চাষ করা হচ্ছে। কৃষকরা তরমুজের বাম্পার ফলন আশা করছেন। ব্যাপক হারে রিজেন-২, বিগ পাঞ্জাব, আস্থা, আস্থা ১০০, ড্রাগন, সুইট ড্রাগন, পাকিজা, বীগ ফ্যামিলি, কালো মানিক সহ বিভিন্ন জাতের তরমুজ বীজ বপণ করা হয়েছে। উপকূলবর্তী দক্ষিণাঞ্চলের অন্যতম লবণাক্ত এলাকা পাইকগাছায় বেশির ভাগ মৎস্য লীজ ঘেরে মূলত চিংড়ি চাষে সীমাবদ্ধ। এখানে এক ফসলি জমিতে আমন ধান ছাড়া অন্য কোনো ফসল হতো না। কিছুদিন আগেও এসব জমিতে লবণাক্ত পানি থৈই থৈই করত। লবণাক্ত পানি বন্ধ হলে পরে ওই সব জমিতে তিল ও মুগ চাষ শুরু হয়। গড়ইখালী ইউনিয়নে আমনের এক ফসল হতো। বাকী সময়ে পতিত থাকতো। গত দু’বছর অতিরিক্ত বৃষ্টির কারণে কৃষি কর্মকর্তার পরামর্শে তিল চাষ বাদ দিয়ে কৃষকেরা তরমুজ চাষে ঝুঁকে পড়েন। জমিতে ভালো ফলন হওয়ায় গত বছরের তুলনায় এ বছর দ্বিগুণ বেশি জমিতে তরমুজ চাষ হয়েছে। যে কারণে তরমুজকে ঘিরে নতুন করে স্বপ্ন দেখছেন হাজারও কৃষক। লবণাক্তর করালগ্রাসে দক্ষিণাঞ্চলে পতিত থাকতো হাজার হাজার হেক্টর জমি। দু’বেলা খেয়ে জীবন চলত বেশির ভাগ কৃষকের। পাইকগাছা কৃষি কর্মকর্তার দিক নির্দেশনায় এবং কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা এসএম মনিরুল হুদা, উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা সুমিত দেবনাথ, ফয়সাল আহমেদ, মো. সোহাগ হোসেন ও আকরাম হোসেনদের বারবার পরামর্শ, আলোচনা সভা ও বিভিন্ন এলাকায় দিনরাত ছুটে চলার কারণে ১৪ শত ৪৫ হেক্টর জমিতে বিভিন্ন প্রজাতির তরমুজ চাষ হয়েছিল। এবছরও ওটাই লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ হয়েছে।
এই লাভজনক চাষে উপজেলার এ দু’টি ছাড়াও অন্যান্য ইউনিয়নের চাষিরাও ঝুঁকছেন। তরমুজের জীবনকাল ৯০-১২০ দিন। তবে ফল ধরা শুরু হয় ৬০ দিন পর থেকে। এই উপজেলায় ব্যাপকহারে ড্রাগন, পাকিজা, বীগ ফ্যামিলি, কালো মানিক জাতের তরমুজ চাষ হচ্ছে।
উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, উপজেলায় এ বছর তরমুজের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৪শ ৪৫ হেক্টর। অদ্যাবধি ১৬ শত হেক্টর আবাদ সম্পন্ন হয়েছে। তবে কৃষকের মধ্যে যে উদ্দেপনা লক্ষ্য করা যাচ্ছে এবছর ২৩ শত ৫০ হেক্টর ছাড়িয়ে যাবে। উপকূলের লবণ পানির এলাকায় গড়ুইখালী ও দেলুটি ইউনিয়ন। গড়ুইখালী ইউনিয়নের ঘোষখালী নদী ও দেলুটি ইউনিয়নের ডিহিবুড়া খাল খননে বৃষ্টির (মিষ্টি) পানি সংরক্ষণ করে তরমুজের চাষ করা হয়েছে।
দেলুটিতে দায়িত্বে থাকা উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা সুমিত দেবনাথ, ফয়সাল সহ অন্যরা জানান, এ উপজেলায় তরমুজ চাষের লক্ষ্যমাত্রা ১১৪শত ৫০ হেক্টর জমিতে। কিন্তু বেড়িবাঁধ ভাঙনে বন্যা পরবর্তীতে জলাবদ্ধতায় আমনের ফলন দেরিতে হওয়ায় তরমুজ চাষাবাদে একটু সময় লাগছে। আগামি দুই সপ্তাহের মধ্যে বাকি জমি চাষাবাদ সহ রোপণ সম্ভবপর হবে।
গড়ইখালীতে দায়িত্বে থাকা উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা আকরাম হোসেন ও মো. সোহাগ হোসেন রা জানান, গতবারের তুলনায় এবছর দ্বিগুণ বেশি জমিতে তরমুজের আবাদ হয়েছে। আবাদ হয়েছে ১২ শত ৫০ হেক্টর। দেলুটি ইউনিয়নে ১২ শত হেক্টর এবং গড়ইখালী ১১শত ৫০ হেক্টর মোট ২৩ শত ৫০ হেক্টর জমিতে তরমুজ চাষ করা হয়েছে। বিঘা প্রতি খরচ ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা। প্রতি হেক্টরে খরচ পড়ে ২ লাখ ১০ থেকে ২০ হাজার টাকা। বিক্রি হয় ৬৫ থেকে ৭০ হাজার টাকা।সঠিকভাবে চাষাবাদ করলে হেক্টর প্রতি ৪০ থেকে ৪৫ মেট্রিকটন ফসল উৎপাদন হবার সম্ভাবনা রয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান। সরজমিনে পাইকগাছা উপজেলার দৈনিক জন্মভূমি প্রতিনিধি পূর্ণ চন্দ্র মন্ডল কে দেলুটি ইউনিয়নের দারুণমল্লিক এর বরুণ মন্ডল বলেন, গতবছর ১১ বিঘা জমিতে তরমুজের চাষ করি। বাম্পার ফলন হওয়ায় ২০ বিঘা জমিতে আবাদ করছেন। কেবল ছোট ছোট পাতা বের হয়েছে। ফুলবাড়ি’র প্রকাশ হালদার বলেন, আমি প্রতিবছর তরমুজ চাষ করি। এ বছর ২৫ বিঘা জমিতে তরমুজ লাগাচ্ছি কেবল ছোট ছোট পাতা বের হয়েছে। এরকম কালিনগরে কৃষক পরিতোষ, সেবনেরবেড় হিরেন্ময় ও গোপীপাগলা গ্রামের প্রহ্লাদ, গেউয়াবুনিয়া প্রসেনজিৎ রা জানান, গতবছরের তুলনায় এবার খরচ অনেক বেশি পড়তেছে শ্রমিকের দাম ও জিনিসপএের দাম বেশি থাকার কারণে।চাষাবাদে পাওয়ারটিলার এর তীব্র সংকটে চাষাবাদ ব্যাহত হচ্ছে। গড়ইখালী ইউপির দক্ষিণ আমেরপুর সনত সরদার বলেন, বাম্পার ফলনের আশায় ধার দেনা করে এ বছর ৩৬ বিঘা জমিতে তরমুজ চাষ করিতেছি। কেবল তরমুজের ছোট ছোট পাতা বের হয়েছে।
মিল্টন সানা, অনিমেষ মন্ডল, বাইনবাড়িয়ার বীরেন্দ্রনাথ, গোবিন্দ, উত্তম, শান্তার শফিকুল ইসলাম, কুমখালী দিলীপ ঢালী ও ব্যাসদেব কবিরাজ, হোগলারচক গ্রামের মলয়, কানাখালীর জ্যোতিকা মন্ডল, বিনয় তরমুজ চাষীরা বলেন, খুলনায় তরমুজ চাষের জন্য বিখ্যাত পাইকগাছায় এবারও ব্যাপক হারে তরমুজের চাষ করা হয়েছে। এলাকার তরমুজ খুব মিষ্টি। বাজারে চাহিদাও ব্যাপক। গত বছর করোনা, সেন্ডিকেড, অনুপযোগী যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে ন্যায্য দাম পাননি চাষিরা। এবার সেই ক্ষতি পুষিয়ে উঠার আশা করছেন। তারা দুই বিঘা থেকে বারো-তেরো বিঘা জমিতে এবার তরমুজের বীজ বপন করেছেন। এসকল ব্যাপারে সমাধানে কৃষি অফিসারের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ঠ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মো. একরামুল হোসেন জানান, এ মৌসুমে তরমুজের ফলন ভালো হবে। কারণ বর্ষা ভালো হয়েছে। আর আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে তরমুজের বাম্পার ফলন হবে বলে আশা করা যায়। কৃষক তাদের ন্যায্য মূল্যে ফসল যাতে লাভজনক অবস্থায় ঘরে তুলতে পারে সেজন্য কৃষি বিভাগ সব সময়ই সহযোগীতা করছে। ছোটখাটো সমস্যা সমাধানে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে।