পূর্ণ চন্দ্র মন্ডল, পাইকগাছা : মরুভূমির মিষ্টি ফল ‘সাম্মাম’। কেউ কখনও আশা করেছে বাংলার মাটিতে হবে? এখন শোভা পাচ্ছে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের উর্বর মাঠে। তাহাও আবার উপকূলবর্তী খুলনা জেলাধীন পাইকগাছার নোনাভূমিতে।দেখতে অনেকটা বেল কিংবা বাতাবি লেবুর মতো, কিন্তু ভেতরে রসালো প্রায় তরমুজের মতো। মধ্যপ্রাচ্যের জনপ্রিয় এই ফলের দেশীয় অভিযোজন ঘটিয়েছেন পাইকগাছা উপজেলার কুমখালী গ্রামের তরুণ উদ্যোক্তা শান্ত কুমার মন্ডল। ইউটিউবে অনুপ্রাণিত হয়ে শুরু করা তার এই পথচলা। ইতিমধ্যেই স্থানীয় কৃষক ও দর্শনার্থীদের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহের জন্ম দিয়েছে। “আমি ইউটিউব দেখে সাম্মাম ফল সম্পর্কে জানতে পারি। অনেকটা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মতো করে ১ বিঘা জমিতে প্রথমবারের মতো এটি চাষ করি। ফলন এতটাই ভালো হয়েছে যে আগামী মৌসুমে আমি ১০ বিঘা জমিতে সাম্মাম চাষের পরিকল্পনা করছি।” এই কথা গুলো তরুণ উদ্যোক্তা শান্ত’র।
উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানায়, সাম্মাম মূলত মধ্যপ্রাচ্যের একটি মরুভূমির ফল হলেও এটি বাংলাদেশের আবহাওয়াতেও সফলভাবে চাষ করা সম্ভব হচ্ছে। ‘রকমেলন’ নামেও পরিচিত এই ফল তরমুজের মতই চাষ করা হয়। তবে মালচিং পদ্ধুতিতে চাষাবাদ করলে ভাল ফল পাওয়া যায়। যেখানে মাটি ঢেকে রাখা হয় প্লাস্টিকের ছাদ দিয়ে যাতে আগাছা কমে এবং মাটির আর্দ্রতা ধরে রাখা যায়। একটি পরিপক্ব সাম্মামের ওজন হয় প্রায় ২ থেকে আড়াই কেজি। চারা রোপণের ৬০-৭০ দিনের মধ্যেই ফল সংগ্রহযোগ্য হয়ে ওঠে। সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হলো, খুবই সামান্য সার ও কীটনাশক ব্যবহার করেই এই ফলন থেকে ভালো লাভ করা যায়।
সরজমিনে দেখা গেছে, তরমুজ চাষের মতো করেই রোপণ করা হয়েছে। দূর থেকে যে কেউ দেখলে মনে করবেন এটা তরমুজ ক্ষেত। সারি সারি গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে উঁকি ফল। কিন্তু কাছে যেতেই বোঝা গেল এটি তরমুজ নয় অন্যকিছু ছোট-বড় সাম্মাম। কোনোটির ওজন এক কেজির নিচে, আবার কোনোটির ওজন প্রায় দুই কেজি। হালকা বাতাসে দুলছে সারি সারি সাম্মামের গাছ।
শান্ত দৈনিক জন্মভূমি’র এ প্রতিনিধিকে জানান, দীর্ঘদিন ধরে তিনি তরমুজ চাষ করে আসছেন। তবে সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ইউটিউবে মরুভূমির ফল ‘সাম্মাম’ চাষ দেখে উৎসাহী হন তিনি। ইন্ডিয়ান কোম্পানি মালিনী বীজ স্থানীয় প্রতিনিধির মাধ্যমে নিজ বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছিল। “প্রাথমিক তরমুজের মতো করেই মাটিতে এই ফলের চাষ করা যায়। জমিতে রোপণের দেড় মাসের মধ্যে গাছে ফল আসতে শুরু করে। তিন মাসের মধ্যে পরিপক্ব হয় ‘সাম্মাম’।”
তিনি আরও বলেন, বীজ, চারা তৈরি, জমি চাষ, কীটনাশক ও শ্রমিক সহ আনুষঙ্গিক প্রায় ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা মতো খচর হয়েছে। মাঠের এক পাশে দর্শনার্থীদের কৌতূহলী ভিড়। অনেকেই এসেছেন দেখতে কীভাবে মরুভূমির এই ফল বাংলার মাটিতে হাসছে, তা দেখতে। বিশেষ করে পাইকগাছার নোনাভূমিতে।
মাত্র তিন মাসের মধ্যে ফলটি বাজারজাত শুরু হয়েছে। একটা সারি প্রায় এক কাঠা জমিতে সাম্মাম হয়েছে প্রায় ১৫ মণ। তিনি কেজি প্রতি ১১০ টাকা করে পাইকারি বিক্রি করছেন। ঢাকার কাওরান বাজার সহ বিভিন্ন বাজারে এসব বিক্রি হচ্ছে। উপজেলা কৃষি অফিসার মো. একরামুল হোসেন বলেন, “এটা সত্যিই প্রশংসনীয় উদ্যোগ। শান্তর মতো তরুণদের এই উদ্যোগ আমাদের অনুপ্রাণিত করে। আমরা সবসময় নতুন চাষাবাদে কৃষকদের সহায়তা করি। সাম্মাম চাষে সম্ভাবনা অনেক। এবার উপজেলায় সব মিলিয়ে ২-৩ হেক্টর জমিতে সাম্মাম আবাদ হয়েছে।” শান্ত’র সফলতায় এলাকার অনেকেই সাম্মাম চাষে আগ্রহ প্রকাশ করছেন। কৃষি বিভাগ বলছে, বিদেশি এই ফল চাষে আগ্রহীদের প্রশিক্ষণ ও কারিগরি সহযোগিতা দেওয়া হবে।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার মাহেরা নাজনীন বলেন, শান্তর এই সাহসী উদ্যোগ শুধু তার নিজের স্বপ্ন পূরণের পথ খুলে দেয়নি বরং স্থানীয় পর্যায়ে কর্মসংস্থান ও কৃষির নতুন দিগন্তও উন্মোচিত করেছে। দেশের বেকারত্ব দূরীকরণে এবং কৃষি খাতে আধুনিকায়নে এই ধরনের উদ্যোগ অর্থনীতিতে বড় ধরনের ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে করেন উপজেলা প্রশাসনের এ নির্বাহী অফিসার।
পাইকগাছার নোনাভূমিতে সাম্মাম চাষে তরুণ উদ্যোক্তার নজিরবিহীন সাফল্য

Leave a comment