
জন্মভূমি ডেস্ক : অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে সংশোধিত পাঠ্যবই নিয়ে একের পর এক বিতর্ক চলছে। এরমধ্যে ‘আদিবাসী’ শব্দটি নিয়ে বিতর্ক সংঘর্ষেও রূপ নিয়েছে। সংঘর্ষে বেশ কয়েকজন গুরুতর আহত হওয়ার পর তা নিয়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায় চলছে নানা প্রতিবাদও। চলতি শিক্ষাবর্ষে প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত বিভিন্ন পাঠ্যবইয়ে বেশকিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে। বইয়ে কোথাও তথ্য ভুল, কোথাও আবার তৈরি হয়েছে রাজনৈতিক বিতর্কও। খবর বিবিসি।
গণঅভ্যুত্থানের পর নতুন পাঠ্যবইয়ে গত জুলাই-অগাস্টের ছাত্র আন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন নিয়ে নানা ইতিহাস যুক্ত করা হয়েছে। কোনো কোনো বইয়ে এই অভ্যুত্থানের ইতিহাস অংশে আওয়ামী লীগ কিংবা শেখ হাসিনার নাম বাদ দেয়া নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন কেউ কেউ। আবার আন্দোলনে নিহতদের নাম নিয়েও ভুল ধরা পড়েছে। কয়েকটি পরিবর্তন নিয়ে বিতর্ক ওঠার পর কিছু কিছু বইয়ে সংশোধনীও আনা হয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, পরিমার্জন করতে কিছু কিছু পরিবর্তন এমনভাবে করা হয়েছে যেটি নিয়ে নতুন করে বিতর্ক শুরু হয়েছে। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড বা এনসিটিবি’র চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ কে এম রিয়াজুল হাসান বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, “এবার ভুলের পরিমাণ কম, কিন্তু বিতর্ক বেশি।” “বিতর্ক মানে দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য বা দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতা। এখন এটা কি আপনারা টলারেন্স দিয়ে মোকাবিলা করবেন নাকি এটাকে সংঘাত দিয়ে মোকাবিলা করবেন, সেটিই হচ্ছে মূল বিষয়।”
ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন, শেখ হাসিনার পালিয়ে যাওয়া ও ২০২৪এর গণঅভ্যুত্থানের বিভিন্ন বিষয় যুক্ত করা হয়েছে নতুন পাঠ্যবইয়ে। পঞ্চম শ্রেণি থেকে নবম-দশম শ্রেণি পর্যন্ত বাংলা ও ইংরেজি বইয়ে জুলাই গণঅভ্যুত্থান নিয়ে মোট আটটি কনটেন্ট বা বিষয় স্থান পেয়েছে। এছাড়া বইয়ের পেছনের পৃষ্ঠায় জুলাই গণঅভ্যুত্থানের নানা ছবি ও গ্রাফিতি যুক্ত করা হয়েছে। নবম ও দশম শ্রেণির ‘বাংলা সাহিত্য বইয়ে ‘আমাদের নতুন গৌরবগাঁথা’ অধ্যায়ে লেখা হয়েছে আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতা এক দফা দাবি পেশ করেছে। সারা দেশ থেকে মানুষ ঢাকায় ছুটছে। ঘেরাও করবে গণভবন। মূলোৎপাটন করবে শাসন ক্ষমতা আঁকড়ে থাকা ফ্যাসিবাদী এক শাসককে। নিপীড়ক সরকারও প্রস্তুত। তার আছে দলীয় বাহিনী, আছে সরকারি নানা বাহিনীকে অন্যভাবে ব্যবহারের নিত্যদিনের অভ্যাস। পাঁচই অগাস্ট ঢাকার রাস্তার অবস্থাও উঠে আসে এই প্রবন্ধের বর্ণনায়। সেখানে লেখা হয়-‘পতন অত্যাসন্ন টের পেয়ে স্বৈরাচারী সরকার প্রধান পালিয়ে যান দেশ ছেড়ে। অভাবনীয় এক গণঅভ্যুত্থান দেখে সারা দুনিয়ার মানুষ।
সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রশ্ন উঠেছে নবম-দশম শ্রেণির এই প্রবন্ধে কোথাও স্বৈরশাসক হিসেবে ‘শেখ হাসিনা’ কিংবা তার দল ‘আওয়ামী লীগে’র নাম লেখা হয়নি। পরিমার্জন কমিটির দায়িত্বে থাকা সাজ্জাদুর রহমান, যিনি রাখাল রাহা নামেও পরিচিত, তিনি বিবিসি বাংলাকে এর একটি ব্যাখ্যা তুলে ধরে বলেছেন, নাইনের বইয়ে শেখ হাসিনা বা আওয়ামী লীগের নাম না থাকলেও অষ্টম শ্রেণির বইয়ে দুটি নামই আছে। শেখ হাসিনা বিনা ভোটে জিতেছেন, গুম খুন করেছেন – সে সবই অষ্টম শ্রেণির বইয়ে আছে। বিচ্ছিন্নভাবে একটা টেক্সট দিয়ে সব পাঠ্যবইয়ের যদি মূল্যায়ন করতে চান, তাহলে তো মানদন্ড ঠিক হয় না। সপ্তম শ্রেণির বাংলা বইয়ে জুলাই-আগস্টের আন্দোলন নিয়ে হাসান রোবায়েত নামে একজন কবির একটি কবিতা ছাপা হয়েছে। ‘সিঁথি’ শিরোনামে ছাপা কবিতার শব্দ চয়ন নিয়ে নানা সমালোচনা হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।
সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের হাত বই পৌঁছানোর পর এই কবিতার শব্দ চয়ন নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেককে বিভিন্ন নেতিবাচক মন্তব্যও করতে দেখা গেছে। মো. মাসুদ নামে একজন ফেসবুকে পোস্টে লিখেছেন, এই কবিতার মাঝে ভাষা বানান মাত্রা ছন্দ সবকিছুর মাঝে ত্রুটিবিচ্যুতি আছে। কবিতাটি স্বজন প্রীতির কারণে পাঠ্য বইয়ের মাঝে স্থান পেয়েছে! মানের কারণে এই কবিতাটি পাঠ্য বইয়ের মাঝে স্থান পায়নি। তবে, সেই কবিতাটি প্রসঙ্গে পরিমার্জনের দায়িত্বে থাকা রহমান বলেন, আমরা সাধ্য অনুযায়ী কাজটা করেছি। আমাদের লিমিটেশন আছেই। ভালো করে খুঁজলে হয়তো আরো কিছু পেতে পারতাম। নতুন পাঠ্যপুস্তকে কয়েকটি জায়গায় বিতর্ক ওঠার পর কিছু কিছু জায়গায় এরইমধ্যে অনলাইন বইয়ে সংশোধন এনেছে এনসিটিবি। তবে, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সাহিত্য নিয়ে যেসব বিষয়ে প্রশ্ন আছে সেব্যাপারে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
নতুন শিক্ষাবর্ষে শিক্ষার্থীদের হাতে যাওয়া নবম-দশম শ্রেণির ‘পৌরনীতি ও নাগরিকতা’ বইয়ের ৭৩ নম্বর পৃষ্ঠায় ‘গণতন্ত্রে রাজনৈতিক দল ও নির্বাচন ব্যবস্থা’ শীর্ষক সপ্তম অধ্যায়ে বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দলসমূহ অধ্যায়ে ‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ’ সাব টপিকে বলা আছে, “আওয়ামী লীগ এ দেশের সবচেয়ে পুরাতন ও বৃহত্তম রাজনৈতিক দল”। এরপরই বিএনপির বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানকে ‘সাবেক রাষ্ট্রপতির’ পরিবর্তে ‘সাবেক সেনাপ্রধান’ উল্লেখ করে তার শাসনামলকে সামরিক শাসনামল হিসেবে উল্লেখ করা হয়। গণঅভ্যুত্থানের পর পাঠ্যপুস্তকে বিএনপি সম্পর্কে এই বয়ান নিয়ে সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলন করেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। সেখানে এনসিটিবি’র সমালোচনা করেন তিনি। পরে পাঠ্যবইয়ের অনলাইন ভার্সনে দ্রুত পরিবর্তন এনে নতুন করে তা সংশোধনও করা হয়।
এক্ষেত্রে কী কোনো রাজনৈতিক চাপ ছিল? এমন প্রশ্নে পাঠ্যবই পরিমার্জন কমিটির সদস্য সাজ্জাদুর রহমান বিবিসি বাংলাকে বলেন, “রাজনৈতিক চাপ ছিল না, ছিল আমলাতান্ত্রিক চাপ। আমলাতন্ত্র পাঠ্যবই ধ্বংসের প্রধান কারিগর। আমলা ও দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদ মিলে আমাদের শিক্ষাকে ধ্বংস করেছে।”
এছাড়াও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও বেশকিছু বিষয় নিয়ে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের যুক্ত করা কিছু বয়ানে পরিবর্তন আনা হয়েছে নতুন পাঠ্যবইয়ে। শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সিদ্দিকুর রহমান এ বিষয়ে বিবিসি বাংলাকে বলেন, বইয়ে পক্ষপাতিত্বমূলক কিছু থাকুক সেটা মঙ্গলজনক নয় দেশের জন্য। যা সঠিক সেটাই বাচ্চাদের শেখাতে হবে। পরিমার্জন করতে গিয়ে পূর্ববর্তী অবস্থার বিপক্ষে কিছু কথা ঢুকিয়েছে। সেটা নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ হয়নি বলেই নানা ঝামেলা ও বিতর্ক তৈরি হয়েছে।