
৫ থানায় শতাধিক অভিযোগ ও ২৬টি মামলা
পুলিশের কাছে ৭টি হত্যা মামলার নথি
জন্মভূমি রিপোর্ট : অবশেষে পুলিশের খাচায় বন্দী হলো ট্যারা মোস্ত। খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের বিশেষ অভিযানে তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী, ভূমিদস্যু, চাঁদাবাজী ও হত্যাসহ ২৬ মামলার আসামি শেখ গোলাম মোস্তফা ওরফে ট্যারা মোস্তকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ট্যারা মোস্ত ওই এলাকার শেখ আবুল হোসেনের পুত্র। পুলিশ কমিশনার মো: মোজাম্মেল হক বুধবার দুপুরে কেএমপির সদর দপ্তরের সম্মেলন কক্ষে প্রেস ব্রিফিংয়ে এ তথ্য জানান।
তিনি বলেন, গত মঙ্গলবার দিবাগত রাত ১টায় লবণচরা থানার একটি টিম বান্দাবাজার এলাকায় বিশেষ অভিযান পরিচালনা করে তাকে গ্রেফতার করে। এ ব্যাপারে লবণচরা থানায় একটি মামলা রুজু করা হয়েছে। আসামির নামে জেলা ও মহানগরীর বিভিন্ন থানায় ৮টি হত্যা, ৪টি চাঁদাবাজি, ১টি জালিয়াতি, ১টি অস্ত্র আইনে এবং বিভিন্ন ধারায় ১২টিসহ মোট ২৬টি মামলা রয়েছে।
নগরীর লবণচরা এলাকায় শিশু থেকে বৃদ্ধ সবার কাছে তিনি ‘ভয়ংকর কিলার’ হিসেবে একনামে পরিচিত। এলাকার শিশু থেকে শুরু করে তরুণ-বৃদ্ধার কাছে আতংকের আরেক নাম ট্যারা মোস্ত। পুলিশের হিসাবে ২৬ মামলার চিহ্নিত এই আসামির পুরো নাম শেখ গোলাম মোস্তফা (৪৭)। নগরীর লবণচরা থানার বান্দাবাজারের সিমেন্ট ফ্যাক্টরি রোডের শেখ আবুল হোসেনের ছেলে তিনি। দীর্ঘদিন ধরে সন্ত্রাসী কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত থাকা ও একটি চোখ ট্যারা হওয়ায় পুলিশের বিশেষ শাখার তালিকায় তাকে ‘ট্যারা মোস্ত’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
ভয়ংকর এই খুনির নামে পুলিশের কাছে রয়েছে সাতটি হত্যা মামলার নথি। এছাড়া চাঁদাবাজি, অপহরণ, বিস্ফোরকদ্রব্য ব্যবহার, হত্যাচেষ্টা, সরকারি কাজে বাধাদান, দ্রুত বিচার আইন ও বিশেষ ক্ষমতা আইনসহ বিভিন্ন ধারায় বিভিন্ন সময়ে তার বিরুদ্ধে ১৯টি মামলা হয়েছে। শতাধিক অভিযোগ ও সাধারণ ডায়েরি (জিডি) পড়ে আছে খুলনা সদর, ডুমুরিয়া, বটিয়াঘাটা, লবণচরা ও রূপসা থানায়।
শহরের জিরো পয়েন্ট এলাকা থেকে খানজাহান আলী সেতু (রূপসা ব্রিজ) পর্যন্ত এলাকায় জমির দখলদারি ব্যবসায় জড়িয়ে রয়েছে এই ‘ট্যারা মোস্ত’র সন্ত্রাসী কার্যক্রম। জমির ব্যবসা নিয়ন্ত্রণের জন্য লবণচরার বান্দাবাজারে তার ব্যক্তিগত কার্যালয় রয়েছে। সেখানে বসেই ওই এলাকার জমি-জমা সংক্রান্ত সব বিচার-সালিশ করেন তিনি। কেউ তার বিচার না মেনে নিলে হামলার শিকার হন।
ট্যারা মোস্ত সর্বশেষ ২০২২ সালের ১৭ ডিসেম্বর গ্রেফতার হন। ওইদিন ১০-১২ জন সহযোগীর সঙ্গে ছোরা, রামদা, চায়নিজ কুড়াল, চাপাতি, লোহার রড নিয়ে আব্দুল গফ্ফার নামের এক তরুণের ওপর হামলা চালান তিনি। ধারালো অস্ত্রের আঘাতে গফ্ফার জ্ঞান হারালে তাকে মৃত ভেবে তারা সরে যান। হামলার শিকার গফ্ফার প্রাণে বাঁচলেও পঙ্গু হয়ে গেছেন।
ওই ঘটনায় আব্দুল গফ্ফারের স্ত্রী সাদিয়া আক্তার সাথি হত্যাচেষ্টা মামলা করলে ট্যারা মোস্ত গ্রেফতার হন। তবে কিছু দিনের মধ্যেই জামিনে বেরিয়ে ফের সন্ত্রাসী কার্যক্রম শুরু করেন।
এর আগে স্থানীয় স্বপ্না বেগমের করা চাঁদাবাজি ও প্রতারণা মামলায় ২০১৯ সালের ১ অক্টোবর ট্যারা মোস্তকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠায় পুলিশ। একই থানায় ২০১৮ ও ২০১৫ সালেও তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধারায় মামলা হয়েছে।
পুলিশের পিসিপিআর (পূর্বের মামলার পরিসংখ্যান) থেকে জানা গেছে, ট্যারা মোস্ত খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের (কেএমপি) বিশেষ শাখার তালিকাভুক্ত একজন শীর্ষ সন্ত্রাসী ও লবণচরা থানার তালিকাভুক্ত ১ নম্বর ভূমিদস্যু। তিনি সন্ত্রাসী কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়েন ১৯৯৫ সালে। ওই বছরের আগস্ট মাসে খুলনা সদর থানায় তার বিরুদ্ধে সরকারি কাজে বাধার অভিযোগে মামলা হয়। পরের মাস সেপ্টেম্বরে বিস্ফোরক আইন এবং নভেম্বরেও বিস্ফোরক ও ছিনতাই আইনে তার বিরুদ্ধে একই থানায় মামলা হয়। এছাড়া ট্যারা মোস্তর বিরুদ্ধে প্রথম হত্যা মামলা হয় ২০০৩ সালের জুলাই মাসে খুলনা সদর থানায়। একই থানায় সেপ্টেম্বরে আরেকটি হত্যা মামলা হয়। ২০০৪ সালে তার নামে হত্যা মামলা হয় খুলনার ডুমুরিয়া থানায়। এরপর ২০১০, ২০১২ ও ২০১৩ সালের খুলনা সদর থানায় এবং ২০১৩ সালের জুলাইয়ে খুলনার বটিয়াঘাটা থানায় ধারাবাহিকভাবে হত্যা মামলার আসামি হয়েছেন তিনি।
একসময় ভাড়াটে সন্ত্রাসী হয়ে কর্মকাণ্ড পরিচালনা করলেও ২০১০ সাল থেকে নিজেই জমির দখলে নজর দেন ট্যারা মোস্ত। কোনো পক্ষের হয়ে জমির দখল, উচ্ছেদ বা অন্যের জমির জাল দলিল করে দখলে নিতে শুরু করেন।
পুলিশের তথ্যমতে, ২০ থেকে ২৫ জন নিয়ে গঠিত ট্যারা মোস্তর সন্ত্রাসী বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে চানমারী বাজারের আশিক, একই এলাকার মিজান ওরফে বস মিজান, সুরুজ, বান্দাবাজারের মো. গোলাম মোস্তফা, উকিলের কালভার্ট এলাকার সোহেল, গেদনপাড়ার আব্দুল্লাহ, আলামিন মৃধা, বেলাল, হেলাল ও মোক্তার হোসেন রোডের পারভেজ উল্লেখযোগ্য। এদের মাধ্যমেই লবণচরা এলাকায় জমি দখল ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছেন তিনি। ট্যারা মোস্তর সঙ্গে স্থানীয়দের দ্বন্দ্বের মূলে জমির ব্যবসা ও দখলদারিত্ব। অন্যের জমির জাল কাগজপত্র বানিয়ে বিক্রি করে দেন তিনি। জমি ব্যবসার জন্য মাধ্যম হয়ে কাজ করলেও কোথাও নিজের নামে জমির দলিল বা নথি তৈরি করেন না। তাই তাকে সহজে আইনের জালে আটকানো যায় না।