
সিরাজুল ইসলাম, শ্যামনগর : বিশ^খ্যাত ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবনকে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নানামুখী প্রতিকুলতা মোকাবেলা করতে হচ্ছে। তীরবর্তী অংশে বসবাসরত জনগোষ্ঠীর ব্যাপক নির্ভরশীলতার পাশাপাশি রয়েছে মাত্রাতিরিক্ত লবনাক্ততা বৃদ্ধির মত ক্ষতিকর প্রভাব। এছাড়া সুন্দরবনকে আবর্তিত করে ঘুর্ণিঝড় আর জলোচ্ছ্বাস এখন নিত্যকার বিষয়ে পরিণত হয়েছে।
তবে এতসব শত্রুর মোকাবেলা করে টিকে থাকা এ বনাঞ্চলের উপর মনুষ্য সৃষ্ট নুতন এক খড়গ ভর করেছে। প্লাস্টিক-পলিথিন আর মাছ শিকারে ব্যবহৃত বিষ ঐতিহ্যের ধারক এ বনভুমির জন্য নুতন হুমকিতে পরিনত হয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে অপচনশীল বস্তু হিসেবে প্লাস্টিক-পলিথিন সুন্দরবনের প্রাণীকুল ও প্রকৃতির মারাত্মক ক্ষতি করে চলেছে। যা পরোক্ষভবে মানবদেহের জন্যও মারাত্মক ক্ষতির কারণ হয়ে উঠতে যাচ্ছে। এছাড়া নুতন নুতন গাছ-গাছালী বিস্তারের ক্ষেত্রেও তা খুবই নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। উপরোন্ত এক শ্রেণীর অসাধু বনজীবীর ব্যবহৃত বিষ বা কীটনাশক সুন্দরবনের বৈচিত্রতাকে মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দিচ্ছে।
সমীক্ষায় প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায় সুন্দরবনে প্রতি লিটার পানিতে অন্তত দু’টি এবং প্রতি কেজি মাটিতে প্রায় সাড়ে সাত শতাধিক মাইক্রোপ্লাস্টিক রয়েছে। এছাড়া সুন্দরবন ও তদসংলগ্ন নদ-নদী এবং খাল হতে শিকারকৃত প্রতি কেজি মাছ গড়ে ১০-১৫ মিলিগ্রাম মাইক্রোপ্লাস্টিক বহন করছে। ক্যান্সারের মত মরণব্যাধীর ঝুঁকি থাকার পাশাপাশি কিডনী ও লিভারের কার্যক্ষমতা নষ্ট করতে সক্ষম উক্ত মাইক্রোপ্লাস্টিক সুন্দরবনের প্রকৃতি ও পরিবেশসহ উদ্ভীদ এবং প্রাণীকুলেরও মারাত্মক ক্ষতি করছে।
সরেজমিন পশ্চিম সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জের আওতাধীন কদমতলা, হরিনগর, নীলডুমুর ও কৈখালী এলাকা ঘুরে দেখা যায় পাশের নদীসমুহে বিভিন্ন ধরনের প্লাস্টিক-পলিথিন ভেসে বেড়াচ্ছে। খাবার কাজে ব্যবহৃত প্লেটের (একবার ব্যবহারযোগ্য) পাশাপাশি ভাসমান সেসব প্লাসিকের মধ্যে রয়েছে কোমল পানীয়সহ খাবার পানির বোতল। এছাড়া চানাচুর, চিপস, বিস্কুটসহ নানা প্রকার খাদ্য সামগ্রীর প্যাকেট ছাড়াও উপকরণাদী বহনের কাজে ব্যবহৃত পলিথিন রয়েছে ভাসমান সেসব বস্তুর তালিকায়।
স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায় সাম্প্রতিক সময়ে উপকুলবর্তী এলাকায় বসবাসকারীদের মধ্যে প্লাস্টিকের একবার ব্যবহারযোগ্য প্লেট ও গ্লাস ব্যবহারের জনপ্রিয়তা আশংকাজনকহারে বৃদ্ধি পেয়েছে। পারিবারিক সকল অনুষ্ঠানের পাশাপাশি স্থানীয় বাজারসমুহে ব্যাপকভাবে ব্যবহার হচ্ছে প্লাস্টিক-পলিথিন। ব্যবহারের পর পরিত্যক্ত সেসব প্লাস্টিক-পলিথিন ধ্বংস না করে বরং নানাভাবে তা পাশের নদী ও খালে ফেলা হচ্ছে।
পরক্ষণে জোয়ার-ভাটার সুযোগে সেসব পরিত্যক্ত বস্তুসমুহ সুন্দরবনসহ আশপাশের নদ-নদীতে ছড়িয়ে পড়ছে। তাতে সুন্দরবন ও তদসংলগ্ন নদ-নদী মারাত্বকভাবে দুষণের শিকার হওয়ায় ঝুঁকিতে পড়ছে স্থানীয় জীব ও প্রাণ-বেচিত্র্য। শিকার করা মাছর পেটে প্লাস্টিক পলিথিনের অস্থিত্ব পাওয়ার দাবি করে স্থানীয়রা জানান পলিথিনে আটকে মাছ ও কচ্ছ্বপের মৃত্যুর ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী তারা। এছাড়া অপচনশীল এসব বর্জ্যের আধিক্যে সুন্দরবনের চর ও ফাঁকা জয়গায় গাছের বিস্তৃতি ভয়ংকরভাবে হ্রাস পেয়েছে।
শ্যামনগর উপজেলার সুন্দরবন তীরবর্তী মধ্য খলিশাবুনয়িা গ্রামের মতিউর রহমান জানান পেশায় ট্রলার(ইঞ্জিন চালিত নৌকা) চালক হওয়ায় সারাক্ষন তাকে নদীতে থাকতে হয়। সে সুযোগে প্রতিনিয়ত সুন্দরবন সংলগ্ন নদীতে প্রচুর পরিমানে প্লাসিক-পলিথিন ভাসতে দেখেন তিনি। তিন পুরুষ ধরে সুন্দরবনের উপর নির্ভরশীল ঐ যুবকের দাবি আগের মত এখন আর সুন্দরবনের চরে পর্যাপ্ত গাছ জম্মাচ্ছে না।
পর্যাপ্তভাবে নুতন গাছ না জম্মানোর ফলে সুন্দরবনের বিভিন্ন অংশে প্রতিনিয়ত ভাঙনের দৃশ্য অনেকের মত তারও চোখ এড়ায় না। ভাটার সময়ে চর ও বনের মধ্যে প্লাস্টিক-পলিথিন আটকে যাওয়া অংশে বীজ পড়েও চারা গজানোর সুযোগ মিলছে না বলেও দাবি ঐ যুবকের।
বুড়িগোয়ালীনি গ্রামের নুরুন্নাহার বেগম জানান প্যারালাইসি আক্রান্ত স্বামীর পরিবর্তে তিনি সুন্দরবন সংলগ্ন খোলপেটুয়া নদীতে মাছের পোনা ধরে সংসার সামলাচ্ছেন। ভাটার সুযোগে চরে নামলে অধিকাংশ সময় তার জালে উঠে আসে পানির মধ্যে থাকা পলিথিন। লোকালয় থেকে এসব পলিথিন ভেসে আসছে-উল্লেখ করে তিনি বলেন, মুর্খ মানুষ বলে তারা এসব প্লাস্টিক-পলিথিনের ক্ষতির বিষয়ে জ্ঞাত না। বাধ্য হয়ে আগে-পরে কিছু না ভেবে আরও অনেকের মত তিনিও ব্যভহার অনুপযোগী যাবতীয় প্লাস্টিক-পলিথিন পাশের নদীতে ফেলে দেন।
নুরুন্ননাহারসহ কয়েকজন গ্রামবাসী জানান সুশৃঙ্খল একটি বাহিনীর অফিসসহ নীলডুমুর বাজারের সমস্ত পরিত্যক্ত প্লাস্টিক-পলিথিন পাশের খোলপেটুয়া নদীতে ফেলা হয়। বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সুযোগ না থাকার পাশাপাশি স্থানীয়দের অসচেতনতা এমন পরিস্থিতির জন্য দায়ি বলেও তারা মত দেন। একই ধরনের ব্যাখ্যা দেন উপজেলার চুনকুড়ি তীরবর্তী জনপদ হরিনগর বাজারের ব্যবসায়ীসহ স্থানীয়রা।
নীলডুমুর বাজারের ব্যবসায়ী শরিফ উদ্দীন জানান, এখন মানুষ প্রায় সব কাজে প্লাস্টিক ও পলিথিন ব্যবহার করে। সুন্দরবন ভ্রমনে আসা লোকজন তার ব্যতিক্রম নয়। তবে সেখানকার বাজারে কোন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা না থাকায় সপ্তান্তে সমুদয় পরিত্যক্ত প্লাস্টিক-পলিথিন ঝাড়– দিয়ে নদীতে ফেলা হয়। এছাড়া উপকুলবর্তী প্রতিটি পরিবার অনুষ্ঠানাদী সম্পন্ন করে সমুদয় বর্জ্য প্লাস্টিক প্লেট-গ্লাস-কাপ-পলিথিন পাশের নদীতে ফেলে বলেও তিনি স্বীকার করেন।
শরিফ উদ্দীনের ভাষ্য ইতিপুর্বে তিনি কাইন ও লাউ ভোলা মাছের পেটের মধ্যে পলিথিন পেয়েছেন। পলিথিনে জড়িয়ে মৃত কচ্ছ্বপ নিয়ে ফিরতে দেখেছেন জেলেদের। অসাধু কিছু বনজীবী বিষ প্রয়োগে মাছ শিকারের পাশাপাশি সাথে নিয়ে যাওয়া পলিথিন ও প্লাস্টিক বনের মধ্যে ফেলে দেয় বলেও অভিযোগ তার।
সুন্দরবনের দুষণ নিয়ে কাজ করা ইয়ুথ নেট গ্লোবাল এর সাতক্ষীরা জেলা সমন্বয়কারী ইমাম হোসেনের ভাষ্য প্লাস্টিক-পলিথিনে সুন্দরবন মারাত্বকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। উপকুলীয় এলাকার জনগোষ্ঠীর মধ্যে একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকসহ পলিথিনের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার সুন্দরবনের অস্থিত্ত্বকে রীতিমত ‘চ্যালেঞ্জ’ জানাচ্ছে।
উপকুলের সুরক্ষা ও জলবায়ু নিয়ে কাজ করা এ তরুনের দাবি সুন্দরবনের নদ-নদীতে থাকা প্লাস্টিক-পলিথিনের কারনে মাছসহ উদ্ভীদের বংশবিস্তার বাঁধাগ্রস্থ হচ্ছে। মাছ মারা যাওয়ার ঘটনা যেমন ঘটছে তেমনী বৈচিত্রে ভরা সুন্দরবন তার অনুকুল পরিবেশ হারাচ্ছে।
প্লাস্টিক-পলিথিনের মারাত্বক উপস্থিতি সেখানকার প্রাণীকুলের জন্য নানাভাবে ক্ষতিরকর প্রভাব ফেলছে। তিনি জানান আরও বেশী ক্ষতি হওয়ার আগেই সুন্দরবনের নদ-নদীসমুহকে প্লাস্টিক-পলিথিনের দুষনমুক্ত করা দরকার। সেজন্য সরকারি বেসরকারি পর্যায়ে জননসচেতনতা সৃষ্টিসহ আইনের কঠোর প্রয়োগ খুবই জরুরী।
বেসরকারি সংগঠন রুপান্তরের গোলাম কিবরিয়া জানান সুন্দরবনকে প্লাস্টিক-পলিথিন ও বিষের প্রভাবমুক্ত রাখতে তারা স্থানীয়দের সচেতন করার উদ্যোগ নিয়েছে। সুন্দরবনের সুরক্ষা নিশ্চিতে সেখানকার মাটি ও পানি দুষণমুক্ত রাখার বিকল্প নেই-উল্লেখ করে তিনি জানান উপকুলবর্তী এলাকার জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্লাস্টিক-পলিথিনের ব্যবহার কমিয়ে আনা অতি জরুরী।
শ্যামনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিকেল অফিসার মোঃ মিলন হোসেন জানান সুন্দরবনের নদ-নদীতে বিষ দিয়ে শিকারকৃত মাছ মানবদেহের জন্য সরাসরি ক্ষতিকর। এছাড়া লেইদসহ অপরাপর ক্ষতিকর পদার্থ থাকা মাইক্রোপ্লাস্টিক মারাত্মক রোগের কারণ হয়ে উঠতে পাওে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জের সহকারী রেঞ্জার হাবিবুর রহমান জানান সুন্দরবনে আগত পর্যটকদের প্লাস্টিক পলিথিন ব্যবহারে সতর্ক করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে পর্যটকবাহী কয়েকটি নৌযানকে জরিমানা করা হয়েছে। বিষ প্রয়োগ করে মৎস্য শিকারীদের আইনের আওতায় আনতে সহযোগীতার জন্য পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে। তবে বেশিরভাগ প্লাস্টিক-পলিথিন উপকুলবর্তী বাজারগুলোসহ সেসব এলাকায় বসবাসরত পরিবারগুলোর মাধ্যমে সুন্দরবনের নদ-নদীতে ছড়াচ্ছে বলে দাবি তার।
শ্যামনগর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোছাঃ রনী খাতুন জানান সুন্দরবনের দুষণমুক্ত রাখার জন্য নানাভাবে চেষ্টা চলছে। যত্রতত্র প্লাস্টিক-পলিথিন না ফেলতে মানুষকে সচেতন করা হচ্ছে। বিভিন্ন অংশে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার উদ্যোগ নিতে স্থানীয়দের উৎসাহিত করা হচ্ছে। উপকুলবাসীকে মায়ের মত আগলে রাখা সুন্দরবনকে রক্ষায় সরকারের পাশাপাশি স্থানীয়দের অংশগ্রহন খুবই গুরুত্বপুর্ণ বলেও তিনি মন্তব্য করেন।

