
মান্না দে, ফকিরহাট : বাগেরহাটের ফকিরহাটে প্রায় পাঁচশত বছরের প্রাচীন পাতাল জোড়া শিব মন্দিরের সুড়ঙ্গে গুপ্তধনের সন্ধানে কুচক্রী মহলের অবৈধ খনন তৎপরতা শুরু হয়েছে। শতাব্দীর পর শতাব্দী সংস্কার ও নিরাপত্তাহীনতায় থাকা এই ধর্মীয় স্থাপনাটির সামান্য ধ্বংসাবশেষ অবশিষ্ট রয়েছে। তার মাটির নিচে থাকা সুড়ঙ্গ রাতের আঁধারে একটি কুচক্রী মহল খনন চালাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। লোকমূখে প্রচলিত আছে, মন্দিরের ভূগর্ভাস্থ সুড়ঙ্গে সোনার মুর্তি, কষ্টি পাথরের মুর্তিসহ স্বর্ণমূদ্রা ও সোনার তৈজষপত্র সহ বিপুল গুপ্তধন থাকতে পারে। বুধবার (৩ ডিসেম্বর) সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, চুন, সুড়কি ও পোড়া মাটির তৈরি জোড়া শিব মন্দির দুটি ভঙ্গুর অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে। ভবন থেকে খসে পড়া পলেস্তার ও ফাটলের ভেতর থেকে গাছ হয়ে তা আরো ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে। একটু দুরে বন জঙ্গলের ভেতর পাতাল শিব মন্দিরের সুরঙ্গের পাশে স্তুপ করা সদ্য খনন করা মাটি। মন্দির কমিটির দাবী, কোন একটি চক্র রাতের আধারে বেশকিছু দিন ধরে মাটি খুড়ছে গুপ্তধনের আশায়। জানা গেছে, উপজেলার পিলজংগ ইউনিয়ন পরিষদের উত্তর-পশ্চিম কোণে ৫ নম্বর ওয়ার্ড এলাকায় অবস্থিত দুটি প্রাচীন ধ্বংসপ্রায় জোড়া শিব মন্দির রয়েছে। মন্দির দুইটিতে থাকা অত্যান্ত দামী দুইটি কষ্টি পাথরের মুর্তি প্রায় ২৫ বছর আগে চুরি হয়ে গেছে। তিন বছর আগে ইউনিয়ন পরিষদের উদ্যোগে ৪০ দিনের কর্মসূচির বরাদ্দ থেকে মন্দিরের প্রবেশপথ সংস্কার ও জঙ্গল পরিষ্কার করা হয়। এরপর থেকে শিবরাত্রিসহ বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে ওই মন্দিরে ভক্তদের উপস্থিতি বাড়ে। তবে এর একটু দুরে অপর একটি পাতাল শীব মন্দিররের ধ্বংসাবশেষ বন জঙ্গলে লোকচক্ষুর অন্তরালে ছিল। সম্প্রতি সময়ে প্রায় ২০-১৫ ফুট উচু মাটির স্তুপের উপর অবস্থিত মন্দিরটি সুড়ঙ্গের ধ্বংসাবশেষ সড়িয়ে রাতের আধারে কোন একটি কুচক্রি মহল মাটি খোড়ার কাজ করছে। ইতোমধ্যে ভূগর্ভাস্থ ২০টি সিড়ি পর্যন্ত মাটি খুড়েছে। বিষয়টি টের পেয়ে মন্দির কমিটির লোকজন দিনের বেলা গিয়ে দেখতে পান সুগঙ্গের ভেতরের মাটি অপসরনের কাজে ব্যবহৃত সাবল, ঝুড়ি, কোদাল, বালতি, ত্রিশূল পড়ে রয়েছে। স্থানীয়দের ধারনা, দীর্ঘদিন ধরে রাতের আঁধারে কোন একটি মহল এই খনন কাজ চালাচ্ছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মন্দির কমিটির এক সদস্য জানান, খননের বিষয়টি নিয়ে থানায় জিডি করতে চাইলে স্থানীয় প্রভাবশালী একটি মহল বিষয়টি নিয়ে চুপ থাকতে চাপ প্রয়োগ করেছে। ফলে নিজেদের নিরাপত্তার ভয়ে তারা থানায় কোন অভিযোগ করেননি। মন্দির কমিটির উপদেষ্টা ও স্থানীয় প্রবীন ব্যক্তি সাধন কুমার দাস ও সাধারণ সম্পাদক সুজিত কুমার দাস মন্দির প্রতিষ্ঠার বিষয়ে জানান, লোকমুখে প্রচলিত তথ্য অনুযায়ী পঞ্চদশ শতাব্দীর দিকে এই স্থানে ৩৬০ ঘর ভ্রাহ্মণ বাস করতেন। এখানকার এক সাধু ভ্রাহ্মণ পবিত্রস্থান কাশী যাওয়ার পথে একদল ডাকাতের কবলে পড়েন। ডাকাতরা তার কাছে কোন সম্পদ না পেয়ে মারধোর ও বন্দি করে ডেরায় নিয়ে আসে। এক কয়েক দিনের মধ্যে ডাকাতের ডেরায় মরক (প্লেগ) লাগলে সাধু ব্রাহ্মণ তাদের লতা-পাতার ওষুধ ও সেবা যত্ন করে বাঁচিতে তোলেন। পরে ডাকাতরা তাদের ওই পেশা ছেড়ে দিয়ে সাধুর ভক্তে পরিনত হন এবং এই এলাকায় এসে পাতাল শিব মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন ও সেবক হিসেবে আত্মনিয়োগ করেন। মন্দিরটির সুরঙ্গ দিয়ে উকি দিলে মাটির নিচে বহুদুর পর্যন্ত চুন-সুরকি দিয়ে তৈরি সিড়ি দেখা যায়। এর পর ডানে ও বামে ভাগ গেয়ে গেছে সিড়িগুলো। লোক মুখে শোনা যায়, মাটির নিচে মন্দিরের বেশ কয়েকটি কক্ষ ছিল যেখানে নিয়মিত শিব ও কালীর পূজা অর্চণা করা হতো। পরম্পরায় মন্দিরটির সেবক হিসেবে ওই ভ্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের লোকেরা পুজা অর্চনা করতেন। তবে দেশ ভাগের সময় পুরহিত বীরেশ্বর ভট্টাচার্য ভারতে চলে গেলে অরক্ষিত হয়ে পড়ে মন্দিরটি। কালক্রমে পরিত্যাক্ত ও বনজঙ্গল হয়ে একপ্রকার লোক চক্ষুর আড়ালে থেকে যায় মন্দিরটি। এ অবস্থায় দ্রুত এই শিবমন্দিরটি সংরক্ষণ, অরক্ষিত সুড়ঙ্গ বন্ধ, কুচক্রী মহলের তৎপরতা তদন্ত এবং স্থায়ী নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের জরুরী হস্তক্ষেপ দাবি করেছেন স্থানীয় সনাতনী সম্প্রদায়ের মানুষজন। এলাকাবাসীর দাবি ঐতিহ্যবাহী এই স্থাপনাটি প্রত্নসম্পদ হিসেবে সংরক্ষণে দ্রুত কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা হোক। উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) সুমনা আইরিন জানান, এ বিষয়ে তিনি আগে জানতেন না। তবে খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন বলে জানান। বাগেরহাট প্রত্মতত্ব অধিদপ্তরের কাস্টোডিয়ান মো যায়েদ বলেন,মন্দিরটি অনেক পুরানো। বছর দুই আগে আমি এটি পরিদর্শন করেছিলাম। সুরঙ্গ খোড়ার বিষয়টি আমি জানতাম না। তবে এটি সংরক্ষণ করা অীত জরুরী বলে তিনি জানান।

