
সাতক্ষীরা প্রতিনিধি : তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে/ সব গাছ ছাড়িয়ে উঁকি মারে আকাশে- কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “তালগাছ” এ কবিতাটির সাথে আমরা সবাই কম বেশি পরিচিত। তালগাছের নানা উপকারিতার কথা আমরা সবাই কমবেশি অবগত। বাংলা ও বাঙালির জনপ্রিয় ফল তাল। তাল দিয়ে তৈরি নানা স্বাদের পিঠা পায়েস এবং তালের কাঁচা পাকা শাঁস অনেকের খুব পছন্দের খাবার। ‘ভাদ্র মাসের তাল না খেলে কালে ছাড়ে না’ বলে একটি প্রবাদও আছে। বাংলাদেশে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বজ্রপাতের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় ব্যাপক প্রাণহানি ঘটছে। জলবায়ু পরিবর্তন আর বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে বজ্রপাত বাড়ছে। তাপমাত্রা যত বেশি হবে বজ্রপাত তত বাড়বে। গত ৪০ বছরে প্রায় ১৫ শতাংশ বজ্রপাত বৃদ্ধি পেয়েছে। আর এই তাল গাছই এখন মানুষের অন্যরকম উপকারে আসছে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করছে এবং বজ্রপাত প্রতিরোধের উপায় হিসাবে কাজ করছে।
জানা যায়, তালগাছ বজ্রপাত প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা রাখছে। সরকারের পক্ষ থেকে ২০১৭ সালে প্রধানমন্ত্রী বজ্রপাত থেকে রক্ষা পেতে সারা দেশে রাস্তার দুই পাশে তালগাছের চারা-আঁটি রোপণের জন্য নির্দেশ দিয়েছিলেন। এরপর সারা দেশে বিশেষ করে বজ্রপাত প্রবণ এলাকায় কাবিখা-টিআর প্রকল্পের আওতায় তালগাছের চারা-আঁটি লাগানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়। এরই ধারাবাহিকতায় গত কয়েক বছর ধরে দেশে সবুজায়ন বৃদ্ধি করতে পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো ধারাবাহিকভাবে বর্ষা ও সারা বছরে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি পালন করে আসছে। সম্প্রতি পটুয়াখালী জেলার বাউফল উপজেলায় ইউনিয়ন ফর সেক্রিফাইস এন্ড হিউম্যান এইড নামের একটি মানবিক সংগঠন প্রাকৃতিক দুর্যোগ বজ্রপাতের হাত থেকে বাঁচতে ও পরিবেশে ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে ১০ হাজার তালের বীজ রোপণ করেছে। পাশাপাশি তালগাছের উপকারিতা সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করতে সচেতনতা সভারও আয়োজন করা হয়। সংগঠনটি বজ্রপাত থেকে বাচঁতে ও প্রাকৃতিক দুযোর্গ মোকাবেলায় সরকারি ও বিভিন্ন সংগঠনের তালগাছ রোপন কর্মসূচির পাশাপাশি ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রতিটি বাড়িতে দুই চারটি করে তালগাছ লাগানোর আহ্বান জানায়।
বজ্রপাতে বিশ্বের এক-চতুর্থাংশ মৃত্যুই বাংলাদেশে ঘটছে। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি বজ্রপাতে মৃত্যুের অন্যতম কারণ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। দেশের হাওড়, বাঁওড় ও বিলপ্রবণ জেলায় বজ্রপাতের মৃত্যুর সংখ্যা বেশি। ২০২১ সালের অগাস্ট মাসে বাংলাদেশে একসাথে ১৭ জনের বজ্রপাতে মৃত্যুর ঘটনা ব্যাপক আলোড়ন তুলেছিল। উত্তরাঞ্চলে চাঁপাইনবাবগঞ্জে জেলার শিবগঞ্জ ইউনিয়নে এ ঘটনা ঘটে। পদ্মা নদীর ঘাটে হঠাৎ বজ্রসহ বৃষ্টি শুরু হলে ওই ১৭ জন নদীর ঘাটে টিনের দোচালা ঘরে আশ্রয় নেন। সেখানেই বজ্রপাত হলে একসাথে তাদের মৃত্যু হয়। জানা গেছে, মার্চ থেকে অন্তত তিন মাস বোরো আবাদে হাওড়ে বিপুল সংখ্যক মানুষ কৃষিকাজে নিয়োজিত থাকে। ওই সময় বজ্রপাতে মৃত্যু বেশি ঘটে।
দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় সহ বিভিন্ন সংস্থার জরিপের দেওয়া দেওয়া তথ্যানুযায়ী, ২০১১ সাল থেকে ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশে মৃত্যু বরণ করেছে ৪১৮৫ জন ১৬৪ জন মানুষ। ২০১১ সালে ১৭৯ জন, ২০১১ সালে ২০১ জন, ২০১৩ সালে ৩৮৫ জন, ২০১৪ সালে ৩৭০ জন, ২০১৫ সালে ২৬০ জন, ২০১৬ সালে ৪০৫ জন, ২০১৭ সালে ৫০১ জন, ২০১৮ সালে ৪৫৯ জন, ২০১৯ সালে ২৬৮ জন ও ২০২০ সালে মৃত্যুবরণ করেছে ১৩৬ জন ২০২১ সালে ২৬৩ ২০২২ সালে ২৬৫ ২০২৩ সালে ২৭০ ২০২৪ সালে ৩৫৮ ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মৃত্যুবরণ করেছে ২৬৬। প্রাকৃতিক এ দুর্যোগে প্রতি বছর গড়ে ২৬৫ জনের বেশি মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে। আর ২০২১ সালে বজ্রপাতে অন্তত ৩৬২ জনের মৃত্যু হয়েছে। ২০২২ সালের এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বজ্রপাতে ২৭৪ জন মারা গেছে। প্রতি বছর মার্চ থেকে আগস্ট মাসের মধ্যে বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। ২০২২ সালের এপ্রিল থেকে ২০২৩ সালের মে মাস পর্যন্ত বজ্রপাতে ৩৪০ জন মানুষের মৃত্যু হয়েছে। বজ্রপাতে মৃত্যুর ৭০ শতাংশই মাঠে থাকা কৃষক, সাড়ে ১৪ শতাংশ বাড়ি ফেরার পথে, আর ১৩ শতাংশ গোসল কিংবা মাছ শিকারের সময়। তবে শহরের ভবনগুলোতে বজ্রপাত প্রতিরোধক দণ্ড থাকায় হতাহতের সংখ্যা কম। অস্ট্রেলিয়ার কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণা বলছে, ২০১৩ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে বাংলাদেশে বজ্রপাতে মারা গেছে ১৮৭৮ জন এবং তাদের ৭২ শতাংশই কৃষক।
অবশ্য পৃথিবীর অনেক দেশ তাদের আবহাওয়ার উপযোগী করে বিভিন্ন বজ্রনিরোধক যন্ত্র “লাইটনিং অ্যারেস্টার” বা ব্যবস্থা তৈরির পর তা ব্যবহার করে আসছে। সবচেয়ে শক্তিশালী বজ্রনিরোধক ব্যবস্থা ব্যবহার করা হয় উড়োজাহাজে। আমাদের দেশে বজ্রনিরোধক যন্ত্র বা ব্যবস্থা ব্যবহার করে বজ্রপাতের ফলে প্রাণহানি ও সম্পদের ক্ষতি অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব। লাইটনিং অ্যারেস্টার বা সার্জ ডাইভার্টার হল এক ধরনের প্রটেকটিভ ডিভাইস, যা পাওয়ার সিস্টেমে হাই ভোল্টেজ সার্জকে সারাসরি মাটিতে প্রেরন করে। এটির প্রধান কাজ হচ্ছে লাইনে বজ্রপাত হলে তাকে সরাসরি মাটিতে পাঠিয়ে দেয়া। এজন্য লাইটনিং অ্যারেস্টারকে আর্থ করতে হয়। তালগাছ রোপণের মাধ্যমে বজ্রপাত নিরোধ সময় সাপেক্ষ ও দীর্ঘমেয়াদী হওয়ায় সম্প্রতি সরকার ১ হাজার ২৩২ কোটি টাকা ব্যয়ে বজ্রপাত নিরোধক দণ্ড স্থাপনের প্রকল্প নিয়েছে সরকার। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে ১৫টি জেলার ১৩৫টি উপজেলা বজ্রপাতপ্রবণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে এবং সেসব স্থানে বজ্রপাত নিরোধক দণ্ড স্থাপনের কাজ শুরু হয়েছে।
বজ্রপাত একটি আকস্মিক ঘটনা, যা প্রতিরোধ করা অত্যন্ত কঠিন। আবহাওয়াবিদরা বলেছেন, বজ্রপাত কখন কোথায় পড়বে এর কোন নিশ্চয়তা নেই। দূর্যোগ প্রবণ বাংলাদেশের ৬৪ জেলাতেই বজ্রঝুকিতে রয়েছে। বজ্রপাত আকস্মিক প্রাকৃতিক দূর্যোগ। ২০১৬ সালে বজ্রপাতকে প্রাকৃতিক দূর্যোগ হিসাবে ঘোষণা করেছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। এ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ ও অভিমত হলো, খোলামাঠ, রাস্তার পাশে এমনকি বিল, হাওড়-বাওড় ও বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠে উঁচু তালগাছ লাগাতে হবে। তাল, নারকেল, সুপারি প্রভৃতি উঁচু গাছ লাগানো যেতে পারে। তালগাছ বজ্রপাত নিরোধ হিসাবে উল্লেখযোগ্য ও অনেকটা কার্যকর। বিশেষজ্ঞারা বলছেন, তালগাছে কার্বনের স্তর বেশি থাকায় তা বজ্রপাত নিরোধে সহায়তা করে। কারণ, তালগাছের বাকলে পুরু কার্বনের স্তর থাকে। তালগাছের উচ্চতা ও গঠনগত দিক থেকেও বজ্রপাত নিরোধে সহায়ক। তালগাছের পাশাপাশি নারকেলগাছ, সুপারিগাছের মতো উচ্চতা সম্পন্ন গাছ বজ্রপাত নিরোধে বেশ কার্যকরী। প্রকৃতি দিয়েই প্রকৃতিকে রক্ষা করতে হবে। বজ্রপাত শুধু বাংলাদেশ, নয় সারা বিশ্বের জন্য আতঙ্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই দুর্যোগ থেকে পরিত্রাণের জন্য মানুষের ভাবনার অন্ত নেই। তালগাছ লাগানোর পাশাপাশি নারকেলগাছ, সুপারিগাছ লাগানোর উদ্যোগকে সামাজিক আন্দোলনে পরিণত করতে হবে।
সাধারণত একটি তালগাছ ৯০ থেকে ১০০ ফুট উঁচু হয়। উঁচু গাছ হওয়ায় বজ্রপাত সরাসরি এ গাছের মাধ্যমে মাটিতে গিয়ে আমাদের রক্ষা করে। এ ছাড়াও ভূমিক্ষয়, ভূমিধস, ভূগর্ভস্থ পানির মজুত বৃদ্ধি ও মাটির উর্বরতা রক্ষা করে। তালগাছের আকর্ষণে বাড়ে মেঘের ঘনঘটা, ঘটে বৃষ্টিপাতও। তালগাছের শিকড় মাটির অনেক নিচ পর্যন্ত প্রবেশ করায় ঝড়ে হেলে পড়ে না কিংবা ভেঙে পড়ে না। যেখানে কোনো কিছু চাষ হয় না সেখানেও তালগাছ তার শক্ত অবস্থানে দাঁড়িয়ে যায়। নতুন রাস্তার অবকাঠামো, বাঁধ ও নদীভাঙন ঠেকাতে তালগাছের রয়েছে সফল প্রয়োগ। তালগাছ আমাদের উপকূল ও গ্রামীণ জীবনের প্রতিচ্ছবি।
তালগাছ শুধু বজ্রপাতের হাত থেকে মানুষকে রক্ষা করে না বরং তালগাছের নানান উপকারিতা রয়েছে। তালের পাতা দিয়ে হাতপাখা তৈরি হয়। তালগাছের আঁশ দিয়ে কুটির শিল্পজাত পণ্য তৈরি করা হয়। পাকা তালের সুন্দর ঘ্রাণ সবাইকে মোহিত করে। তালগাছের পাতা জ্বালানির বড় উৎস। তালের রস, তালের গুড়, তালের শাঁস দিয়ে সুস্বাদু মিষ্টি খাবার রান্না করা হয়, তাল দিয়ে ঐতিহ্যবাহী অনেক পিঠা তৈরি করা হয়। তালের গাছ ও পাতা ঘর তৈরির কাজেও ব্যবহার করা হয়। আশ্রয় হিসেবে এ গাছ বাবুই পাখিদের বড়ই প্রিয় জায়গা। বাবুই ছাড়াও অঞ্জন, বাদুরসহ নানা প্রাণী আশ্রয় হিসেবে এ গাছটি বেছে নেয়। গ্রামগঞ্জে একসময় তালের পাতায় সুন্দরভাবে বাসা তৈরি করে সেখানে মানুষও বসবাস করতো। এগুলো আমাদের গ্রাম অঞ্চলের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি ধরে রেখেছে। তালগাছ মানুষ ও পাখি উভয়ের জন্যই বেশ উপকারী। যে এলাকায় তালগাছ বেশি, সে এলাকায় ঝড় ও বিজলিতে মানুষ ও পশু-পাখির মৃত্যু কম। প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় বাড়ির আঙিনার পাশে, রাস্তার ধারে, অনাবাদি ও পতিত জমিতে ব্যাপকভাবে তালগাছ রোপণ করা উচিত। কিন্তু নানা কাজে ব্যবহারের জন্য নির্বিচারে কেটে ফেলা হচ্ছে আমাদের এ গাছবন্ধুকে। অর্থনৈতিক সুবিধার পাশাপাশি বজ্রপাত, ঘূর্ণিঝড়, ঝড়ো হাওয়া ও জলোচ্ছ্বাস থেকে উপকূলীয় বাড়িঘর, শস্য রক্ষা ও পরিবেশ উন্নয়নে তালগাছের ভূমিকা অনন্য। তালগাছ বড় হতে থাকে আর প্রসারিত হতে থাকে পাতা ও কাণ্ড। জন্মের পর বছর না পেরুতেই এই গাছ প্রকৃতি ও মানুষের সেবায় নিয়োজিত হয়ে যায়।
তাই আসুন আমরা সবাই মিলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে রাস্তার দুপাশে, পুকুর পাড়ে, বাড়ির আশপাশে, পরিত্যক্ত জায়গায় তালবীজ বপন করি। নিজে ও গ্রামের সবাইকে সচেতন করি তালবীজ বপনে উদ্যোগী করে তুলি, এতে মানুষসহ পশুপাখি বিভিন্নভাবে উপকৃত হবে। আর বজ্রপাত থেকে জীবন রক্ষায় উঁচু তালগাছের বিকল্প নেই। বেশি করে তালগাছ লাগাই, বজ্রপাতে প্রাণহানি কমাই। সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি এনজিও, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ও ব্যক্তি উদ্যোগে তালবীজ রোপনের পাশাপাশি জন সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। তা হলে আকস্মিক প্রাকৃতিক দূর্যোগ বজ্রপাত থেকে মৃত্যু হার কমিয়ে আনা সম্ভব হবে এবং মানুষ ও গবাদিপশু সুরক্ষায় থাকবে। গ্রামীণ ও উপকূলীয় জনপদে তালগাছের পরিকল্পিত চাষে নান্দনিক সৌন্দর্যরূপ তুলে ধরে তালগাছে প্রকৃতি সাজাই জীবন বাঁচাই। সারা দেশে গড়ে উঠুক তালগাছে প্রকৃতির সবুজ বেষ্টনী।
২০১৬ সালে সরকার বজ্রপাতকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা করেছে। প্রতি বছর বজ্রপাত বৃদ্ধি পাওয়ায় মানুষ ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ছে। সারাদেশে কোন না কোন স্থানে বজ্রপাতে মানুষ, গবাদিপশু ও বন্যপ্রাণী মারা যাচ্ছে। আবহাওয়া বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, আমাদের দেশে এপ্রিল থেকে জুলাই পর্যন্ত বজ্রপাতের আশঙ্কা বেশি থাকে এবং সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চলতে থাকে। মৃত্যুর সংখ্যা বিচারে এখন প্রতি বছর বর্ষাকালে বজ্রপাত ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। গত কয়েক বছরে সহস্রাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এটি নিঃসন্দেহে আতঙ্কের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
গত সাড়ে ৯ বছরে বজ্রপাতে দেশে আড়াই হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে।। বজ্রপাতে প্রতিবছর গড়ে দুই শতাধিক মানুষ মারা যায়।
জলবায়ু পরিবর্তন আর বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে বজ্রপাত বাড়ছে। তাপমাত্রা যত বেশি হবে বজ্রপাত তত বাড়বে। আবহাওয়াবিদরা বলছেন, ৪০ বছরে বাংলাদেশের তাপমাত্রা শূন্য দশমিক ৭ ডিগ্রী বৃদ্ধি পেয়েছে। এক ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রা বাড়লে ২০ শতাংশ বজ্রপাত বেড়ে যায়। এ হিসাবে বজ্রপাত বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ১৫ শতাংশ। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বজ্রপাত বৃদ্ধি পাওয়ায় মানুষ ভীত হয়ে পড়েছে। বর্ষাকালে বজ্রপাত বেশি হয়। বাংলাদেশে মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বজ্রপাতের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।
বজ্রপাত থেকে রক্ষা পাওয়ার প্রাকৃতিক ব্যবস্থা হিসেবে তালগাছ লাগানোকে বিশেষজ্ঞরা গুরুত্ব দিচ্ছেন। বজ্রপাত নিরোধে তালগাছ বেশ কার্যকর। বিশেষজ্ঞারা বলছেন, তালগাছে কার্বনের স্তর বেশি থাকায় তা বজ্রপাত নিরোধে সহায়তা করে। কারণ তালগাছের বাঁকলে পুরু কার্বনের স্তর থাকে। তালগাছের উচ্চতা ও গঠনগত দিক থেকেও বজ্রপাত নিরোধে সহায়ক হতে পারে। তালগাছের পাশাপাশি নারকেল গাছ, সুপারি গাছ এর মতো উচ্চতা সম্পন্ন গাছ বজ্রপাত নিরোধে বেশ কার্যকরী। প্রকৃতি দিয়েই প্রকৃতিকে রক্ষা করতে হবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতিরোধে প্রকৃতিই বাঁচার উপায়।
বজ্রপাত শুধু বাংলাদেশ, নয় সারাবিশ্বের জন্য আতঙ্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই দুর্যোগ থেকে পরিত্রাণের জন্য মানুষের ভাবনার অন্ত নেই। বজ্রপাত নিরোধে তালগাছ কাজে লাগানো দরকার। সরকারি উদ্যোগে তালগাছ লাগানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে ও কার্যক্রম চলমান রয়েছে। পাশাপাশি এনজিও, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, সামাজিক ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে এই কার্যক্রমকে সারাদেশে ছড়িয়ে দিতে হবে। তালগাছ লাগানোর পাশাপশি নারকেল গাছ, সুপারি গাছ লাগানোর উদ্যোগকে সামাজিক আন্দোলনে পরিণত করতে হবে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রণালয় থেকে জানা যায়, এ পর্যন্ত প্রায় ৩১ লাখ ৬৪ হাজার তালবীজ রোপণ করা হয়েছে।
নাসার তথ্য অনুযায়ী বজ্রপাতের অন্যতম হটস্পট বাংলাদেশ। বজ্রপাত থেকে রক্ষা পেতে প্রাকৃতিকভাবে লম্বা গাছ যেমন তাল গাছ, সুপারি গাছ, নারকেল গাছ, বট গাছ কমে যাবার কারণেও বজ্রপাত এখন যেখানে সেখানে আঘাত হানছে। আগে বড় বড় বটগাছ, তালগাছ ও সুপারি গাছ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকায় বজ্রপাত হতো এসব গাছের ওপর। বড় বড় গাছ কেটে ফেলায় বজ্রপাতে মৃতের সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে। বজ্রপাতে মানুষের মৃত্যু ঠেকাতে দেশের বিভিন্ন এলাকায় বসতবাড়িতে, রাস্তার পাশে, ফসলি জমির আইলে তালগাছ, সুপারি গাছ, নারকেল গাছ রোপণ করতে হবে।
বজ্রপাত প্রসঙ্গে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ নাঈম ওয়ারা বলেন, ‘প্রতিবছর যে হারে গাছ কাটা হয় সে অনুপাতে গাছ রোপণ করা হয় না। আগে গ্রামের মাঠঘাটে তালগাছ দেখা যেত। তালগাছ বজ্রপাত ঠেকানোর অন্যতম উপায়। এখন তালগাছের সংখ্যা কমে এসেছে। বজ্রপাতে মৃত্যু কমাতে মাঠেঘাটে প্রচুর গাছ লাগাতে হবে। পাশাপাশি প্রতিটি বাড়িতে আরথিন ব্যবস্থা সেট করতে হবে।’ মোবাইল টাওয়ারগুলোতে আরথিনের ব্যবস্থা করতে হবে। বজ্রপাত মোকাবিলায় দালানকোঠা নির্মাণের সময় বজ্র নিরোধক লাগাতে হবে। পাশাপাশি জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।
বজ্রপাতের আঘাত থেকে রেহাই পেতে হলে কিছু সতর্কমূলক ব্যবস্থা সবার জেনে রাখা ভালো। বজ্রপাতের শঙ্কা থাকলে পাকা বাড়ির নিচে আশ্রয় নিতে হবে। উঁচুস্থান পরিহার করতে হবে। বিদ্যুতের খুঁটিতে বজ্রপাতের শঙ্কা বেশি থাকে বিধায় বিদ্যুতের লাইন থেকে দূরে থাকতে হবে। ঘরে থাকলে জানালা থেকে দূরে থাকতে হবে। ধাতব বস্তু এড়িয়ে চলতে হবে। বজ্রপাতে শুধু প্রাণহানি হয় না, নষ্ট হচ্ছে বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতিও, বিধায় এসময় ইলেক্ট্রনিক্স সামগ্রীর সুইচ বন্ধ করে রাখা উত্তম।
বজ্রপাতের মতো আকস্মিক প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য বিশেষজ্ঞদের অভিমত হলো, গ্রামে-গঞ্জে প্রচুর পরিমাণে তালগাছ ও নারিকেল গাছ থাকলে সেগুলো বজ্রনিরোধক হিসেবে কাজ করতে পারে। খোলামাঠ, রাস্তার পাশে এমনকি বিল, হাওড়-বাঁওর ও বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠে উঁচু তালগাছ লাগাতে হবে। তাল, নারকেল, সুপারি প্রভৃতি উঁচু গাছ লাগানো যেতে পারে। এর মধ্যে বজ্রপাত নিরোধক হিসাবে তালগাছ উল্লেখযোগ্য।