
শেখ আব্দুল হামিদ : স্বাধীনতার ৫২ বছরেও সুরক্ষিত হয়নি বটিয়াঘাটার বাদামতলা বধ্যভূমি। পাক সেনাদের মূহুর্মূহু গোলাবর্ষণে বহুজন শহীদ হন এ ভূমিতে। এলোপাতাড়ি গুলির মাঝেও সেদিন বেঁচে যায় এক বছরের শিশু মিনু। আজ তার বয়স ৫১ বছর। অনেকেই আজও সে স্মৃতি রোমান্থন করে অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়েন।
১৯৭১ সালের ১৯ মে বুধবার সকাল ছয়টার দিকে গানবোট যোগে পাকবাহিনী আর তাদের দোসররা ফুলতলা গ্রামে প্রবেশ করে গুলি ছুড়তে ছুড়তে দক্ষিণ দিকে এগোতে থাকে। দেবীতলা গ্রামের পার্বতী মন্ডল নামে এক লোক খিলে নৌকা বেয়ে পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে যাচ্ছিলেন। পাকসেনারা তার নৌকায় পার হয়ে তাকে গুলি করে হত্যা করে। তারা উপেন্দ্র নাথ (৮৩) মন্ডলের বাড়ি ঢুকেই তাকে গুলি করে বুক ঝাঁঝরা করে দেয়। বয়ারভাঙ্গা গ্রামের বলাই মন্ডল এসেছিলেন তার শ্বশুর সন্নাসী মন্ডলের বাড়িতে। তাকে নীরদ বিশ্বাসের উঠানে ফেলে গুলি করে মেরে ফেলে। মতিরাম বিশ্বাসের বাড়িতে ফুলতলার নীলকমল রায় ও নির্মল মন্ডলকে হত্যা করে।
কথাগুলো বলতে-বলতে প্রত্যক্ষদর্শী বসুরাবাদ গ্রামের নিরঞ্জন মন্ডল অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়েন। তিনি বলেন, বাদামতলা বাজারের চারের নিকট এসে এলোপাতাড়ি গুলি শুরু করলে নিত্যানন্দ মন্ডল ও কুঞ্জবিহারী মন্ডল নিহত হয়। এসময় রামপাল, ফকিরহাট ও পিরোজপুর এলাকার অনেকেই হতাহত হন। যারা পালাতে চেষ্টা করেন তাদের অনেককেই ধরে এনে বাদামতলার ন’লে ভিটের কাছে রাস্তার পূর্ব পাশে জড়ো করতে থাকে। আমি ও হিমাংশু মন্ডল ধরা পড়ে যাই। আমাদের ন’লে ভিটার নিকট নেয়ার সময় হিমাংশু মন্ডল দৌড়ে একটি বাগানের মধ্যে ঢুকে পড়ে। সেদিন ভাগ্যক্রমে তিনি বেঁচে গেলেও পরে ২০০১ সালের ২০ জানুয়ারি ঢাকায় কমিউনিস্ট পার্টির জনসভায় যোগ দিতে গিয়ে বোমার আঘাতে মারা যান। সামছুর রহমান নামে একজনকে দেখে পাকসেনারা তাকে ধরে নেয়ার সময় মুসলমান দাবি করে বাঁচার চেষ্টা করেন। তাকে গুলি করে মেরে ফেলে। এ সময় জাবুসা গ্রামের রবীন্দ্রনাথ গাইন ছিলেন নব-বিবাহিত। তিনি তার ১৪/১৫ বছর বয়সী স্ত্রীর হাত ধরে আলাদা দাঁড়ান। একজন পাকসেনা তাকে স্ত্রীর হাত থেকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য রবীনকে লাথি মারলে মাটিতে পড়ে যায়। রবীন পড়ে গিয়ে চিৎকার দিয়ে বলেন, যে যেদিক পারো ছুটে পালও। লাইনে দাঁড়ানো চার শতাধিক মানুষ আমরা যে যার মত ছুটে পালাতে চেষ্ঠা করি। তখন পাকবাহিনী এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়লে ৩০/৩৫ জন মানুষ এখানেই শহীদ হয়। স্ত্রীর তলপেটে গুলি লাগে। সে তার এক হাতে পেট চেপে ধরে অন্য হাতে স্বামীকে জড়িয়ে পড়ে থাকে। আমি ছুটে গিয়ে পাশের খালে পড়ে কাঁটা ঝাড়ের মধ্যে লুকাই। দু’টি বসতি দোকানে আগুন দেয়।
পেটে গুলিবিদ্ধ হয়ে আমার পাশে এসে পালিয়ে ছিলেন বসুরাবাদ গ্রামের প্রাণকৃষ্ণ হালদার। সেখানে সারি-সারি লাশ পড়ে আছে। রবীন তখনও জীবিত আছেন। উপায় খুঁজে না পেয়ে ধরাধরি করে পাশে বাওয়ালী বাড়ি নিয়ে চিনির বস্তা থেকে খানিকটা চিনি বের করে রবীনের গুলিবিদ্ধ স্থানে ঢুকিয়ে কাপড় পেঁচিয়ে বেঁধে দিলাম। রবীন মারা গেলেন। রবীনের স্ত্রী ভারতে গিয়ে সুস্থ হয়ে ছিলেন। বাদামতলার ন’লের ভিটায় অমুল্য রায় ও তার স্ত্রী মনোরমা গুলিতে নিহত হলেও তাদের এক বছরের শিশু কন্যা মিনু প্রাণে বেঁচে যায়। মিনু তখন তার মৃত মায়ের বুকের উপর স্তনপানের জন্য কাঁদছে। তার সারা গায়ে ওর মায়ের রক্ত লেগে আছে। একপাক সেনা মিনুকে নিয়ে যাবার জন্য রাজাকার হাবিবুর রহমান গোলদারকে নির্দেশ দেয়। দেশ স্বাধীনের পর মিনুকে তার কাকার কাছে ফেরৎ দিয়েছিল।
বাদামতলার গুলিতে এলাকার যারা নিহত হয়ে ছিলেন তাদের মধ্যে যাদের নাম জানা আছে তারা হলেন, অমুল্য চক্রবর্তী, সামছুর রহমান, মনোরমা বিশ্বাস, গীতঞ্জলী বিশ্বাস, দিনেস বিশ্বাস, নিত্যানন্দ মন্ডল, সাধন বৈরাগী, মনোহর মন্ডল, নির্মল মন্ডল, কুঞ্জবিহারী মন্ডল, মান্দার ঢালী, বীরেন তরফদার, সাহেব ঠাকুর, ব্রজেন্দ্রনাথ বিশ্বাস প্রমুখ।
ন’লের ভিটার ঠিক উত্তর পাশেই বৃদ্ধ মুকুন্দ মন্ডলের বাড়ি। তিনি বলেন, বধ্যভূমির কোন উন্নয়ন হয় না। সেদিন এ রাস্তার উপর দিয়ে সবাইকে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে দেয়। গুলি করে। পাশের খালের মধ্যে এ ভিটায় কত লাশ পড়ে থাকে। দেশ স্বাধীনের পর ১০/১২টি মাথার খুলি রাস্তার পাশে ঝুলিয়ে রেখেছিলাম। তার আক্ষেপ এ বধ্যভূমির চারিদিকে একটু পাঁচিল দেয়া হলেও জীবজন্তুর ময়লা থেকে শহীদের আত্মা শান্তি পেত।
সেদিনের সেই নির্মম স্মৃতি বুকে নিয়ে আজও অনেকেই বেঁচে আছেন। বিজয় দিবস এলেই স্বজনহারাদের মুখগুলো চোখের তারায় ভেসে ওঠে। দেশের সর্ব দক্ষিণে প্রত্যন্ত গ্রামের ছাঁয়া ঘেরা পরিবেশে পড়ে আছে বধ্যভূমি। যার সংরক্ষণ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতেও হয়নি।

