
সাতক্ষীরা প্রতিনিধি : বাওয়ালি ও মৌয়ালরা বনের পরিচর্যা করে বন রক্ষার জন্য ভারত সরকার একসময় প্রায় জিহাদ ঘোষণা করেছিল। কংগ্রেস তখন ক্ষমতায়, নেহরু ক্ষমতার চূড়ায়। উঁচুতে থাকলে সবকিছু ঠাওর করা কঠিন। তাই নিচে থাকা মানুষদের বুদ্ধিসুদ্ধি, চিন্তাচেতনার ওপর নির্ভর করতে হয়। সেটা না করে বনকর্তারা নেহরুকে বোঝালেন, কাজটা খুব সহজ। আমাদের হুকুম দিলেই হবে। নেহরু ভ্রু কুঁচকে জানতে চান, কী রকম? কী হুকুম নেই, যেটা তোমাদের দরকার? তাঁরা জানালেন, বন রক্ষার জন্য আমাদের বনরক্ষীরা জান কোরবান করে দিচ্ছে। শুধু সমস্যা করছে বনে যেসব অশিক্ষিত বুনো, বাগদি, সাঁওতাল, আপাতানি, মেটটি, রাজবংশী, গুজজার, বোড়ো, মিনা ইত্যাদি লোকজনের বসবাস, তারা। এরাই গাছ কেটে, পশুপাখি শিকার করে বনের বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছে। আমরা এখন স্বাধীন দেশ, এরা কেন বনে-বাদাড়ে থাকবে? শহরে বসবাসের অধিকার, স্কুল, গরম পানি, রেল, উড়োজাহাজ এরা দেখবে না? দেশের সুখ–শান্তির ভাগীদার তাদেরও করতে হবে। বনে-বাদাড়ে আর তাদের রাখা ঠিক হবে না। এটা স্বাধীনতার ঘোষণার সঙ্গে মানায় না। বনের বাইরে শহরতলির কাছে তাদের বসবাসের সুযোগ করে দিলে বনও বাঁচবে, তারাও উন্নতি করবে। চা, পাউরুটি, পাউভাজি খাবে। হিন্দি-ইংরেজি শিখবে। নেহরু ভাবলেন আর পরিকল্পনা কমিশনের মি. মহলানবিশকে পরিকল্পনা তৈরির হুকুম দিলেন। বন বাঁচাও, আদিবাসী তাড়াও টাইপের সেই পরিকল্পনা ক্রমে তৈরি হতে থাকল। বন সৃজন করেছেন যিনি, সেই ভগবান দেখলেন, এ তো মহাবিপদ! বনও থাকবে না, আদিবাসীও থাকবে না। তিনি আঁটলেন অন্য ফন্দি। আল্লাহর মার দুনিয়ার বাইর। নেহরুকে বহনকারী হেলিকপ্টার হঠাৎ আকাশে বিগড়ে গেল। জরুরি অবতরণ করলেন এক জঙ্গলে। সেখানে নির্ভরেরা নেই, নেই ভাঁড়েরাও। আরেকটা উদ্ধারকারী হেলিকপ্টার না আসা পর্যন্ত নেহরুর অখণ্ড সময়। তিনি দেখলেন, জঙ্গলটা ম্যাপেই আছে, আসলে সব ফরসা। নেহরু হাঁটা শুরু করলেন। দেখলেন, সেখানেই শুধু গাছপালা আর পাখপাখালি আছে, যেখানে আদিবাসীরা বসবাস করছেন। তারাই গাছ রক্ষা করছেন, বন রক্ষা করছেন। যেখানে আদিবাসী, নেই সেখানে বন বিভাগের কোঠা আছে কিন্তু বন নেই। সব কারা যেন রাতে চুরি করে নিয়ে যায়। নেহরু মত বদলালেন। আদিবাসীদের বনচ্যুত করার ফন্দি-ফিকির মার্কা পরিকল্পনার শিকড় উপড়ালেন। বন বাঁচল, আদিবাসীরাও সমূহ সংকট থেকে রেহাই পেলেন।
আমাদের সবেধন নীলমণি সুন্দরবন নিয়ে প্রায় একই ধরনের সর্বনাশা আয়োজন চলছে। প্রচার করা হচ্ছে, বাওয়ালি-মৌয়ালরা বন খেয়ে ফেলছে। তাদের পায়ে দড়ি দিলেই বন হু হু করে বাড়বে—এ রকম একটা ধারণা নীতিনির্ধারণী মহলকে বেশ ভালোভাবে বোঝাতে সক্ষম হয়েছে বনের মালিক বন বিভাগ। পরিণামে সুন্দরবনে বাওয়ালিদের প্রবেশ কঠোরভাবে সীমিত করার চেষ্টা চলছে। মানুষের যেমন বন প্রয়োজন, বনেরও তেমনি মানুষ প্রয়োজন। বিশেষ করে সুন্দরবনের মতো বনে মানুষ না ঢুকালে বনের স্বাভাবিক বিস্তার বিঘ্নিত হবেই। ২০০৮ সালে সিডরে আক্রান্ত সুন্দরবনকে প্রকৃতির হাতে ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। বনে বাওয়ালিরা যাবে না, তাহলেই বন নিজের মতো করে বেড়ে উঠবে—খুবই নান্দনিক ধারণা। কিন্তু কী পেলাম আমরা? এক বছরের মধ্যে খবর রটে গেল, সুন্দরবন লতাজাতীয় আগাছায় ছেয়ে যাচ্ছে। অজানা-অচেনা এক লতা বড় বড় গাছের মাথা নষ্ট করে দিচ্ছে, লাফিয়ে লাফিয়ে গ্রাস করে ফেলে গাছ। আগে কেন তা করত না? এখন কেন করল? এটা কি সিডরের তাছির, না অন্য কিছু? মৌয়ালরা মধু সংগ্রহে গেলে গাছে ওঠার সময় গাছকে পরিষ্কার করে। আগাছাগুলো কেটে দেয়, গাছ ভারমুক্ত হয়। মৌয়ালদের অনুপস্থিতিতে সে কাজ কে করবে? বন কর্মকর্তা বনবাবুরা? তারা কেন দা-কাটারি হাতে ধরবে?
একই ঘটনা ঘটেছে গোলপাতার বেলায়। গোলপাতার বন বাড়তে পারেনি যেমন বাড়া উচিত ছিল। গোলপাতা তাল, নারকেল-জাতীয় গাছ। ইংরেজরা এর নাম দিয়েছে নিপা পাম। তাল-নারকেল বছর বছর ঝুড়তে হয়, মানে এ গাছগুলোর পরিণত ডালগুলো কেটে দিতে হয়, গাছের মাথা পরিষ্কার করে দিলে নতুন ডাল ডানা মেলে, ফুল মুকুলিত হয়ে ফল ধরে। কয়েক বছর নারকেলগাছ পরিষ্কার না করে দিলে ফল ধরা বন্ধ হয়ে যায়, গাছের স্বাভাবিক বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হয়। এসব গাছ পরিষ্কার করার আবার একটা নির্দিষ্ট সময় আছে। বর্ষার পর আশ্বিন মাসে নারকেলগাছ পরিষ্কার করতে হয়। কোনোমতেই কার্তিক পার করা ঠিক নয়। আবার তালগাছ পরিষ্কার করার সময় মাঘ-ফাল্গুন। মূলত, ফাল্গুন-চৈত্রের দাবদাহ শুরুর আগেই এভাবে তালপাতার পাখাও মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে যায়।
গোলপাতা পরিষ্কারের সময়ও এটা মাঘ-ফাল্গুন-চৈত্রে—মানে মার্চের পর আর কাটা ঠিক নয়। এই পঞ্জিকা মেনেই এযাবৎ বন বিভাগ বাওয়ালিদের অনুমতি দিত। চাঁদপাই ও শরণখোলা—এই দুই রেঞ্জ নিয়ে পূর্ব সুন্দরবন আর খুলনা সাতক্ষীরা রেঞ্জ নিয়ে পশ্চিম সুন্দরবন। এবার বাওয়ালিদের পূর্ব সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জে সীমিত আকারে গোলপাতা আহরণের পাস দেওয়া হলেও শরণখোলা রেঞ্জে কোনো পাস দেওয়া হয়নি। ২০০ থেকে ৩০০ নৌকা চলাচলের অনুমতির রেওয়াজ থাকলেও এবার মাত্র ১৩৩টি বাছাই করা (রাজনৈতিক বিবেচনায় কি?) নৌকাকে অনুমতি দেওয়া হয়েছে। চাঁদপাই রেঞ্জের এসিএফ (বন কর্মকর্তা) সংবাদমাধ্যমকে এ খবর নিশ্চিত করেছেন। তা ছাড়া নৌকার দৈর্ঘ্য নিয়েও বায়নাক্কা আছে। বন বিভাগের সিদ্ধান্তহীনতার কারণে এ বছর এমনিতেই দেরি করে অনুমতি দেওয়ার কার্যক্রম শুরু হয়। আবার ফেব্রুয়ারির ১৪ তারিখে গোলপাতা কাটার সব আদেশ স্থগিত করে বন থেকে সব বাওয়ালিকে বের করে দেওয়া হয়। পরে নানা শর্ত দিয়ে আবার অনুমতি দিলে অনেকেই পক্ষে আবার নৌকা জোগাড় করে ফিরে আসা সম্ভব হয়নি। লোকসানের টাকাই শুধু তাদের গুনতে হয়েছে।
বিভাগীয় বন কর্মকর্তা ডিএফও সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, নিতান্তই মানবিক বিবেচনায় বাওয়ালিদের সংসারের কথা ভেবে এসব সীমিত অনুমতির ব্যবস্থা। দয়ার সাগর বন কর্মকর্তা।
তাহলে গোলপাতার ঝাড় পরিষ্কার করবে কে? বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে গোলপাতার ফুল হবে, বংশবিস্তারের প্রক্রিয়া শুরু হবে। বরগুনা-পটুয়াখালী অঞ্চলে গোলপাতার গুড়ের মৌসুম এবার কি শূন্য থাকবে। গোলপাতা এখনো দক্ষিণ অঞ্চলের প্রধান গৃহনির্মাণসামগ্রী। আসন্ন কালবৈশাখী আর বর্ষার মৌসুমের আগে তাদের ঘর ছাওয়ার কাজ শেষ করে ফেলতে হয়। গোলপাতার সরবরাহ কম থাকায় দাম এই ভরা মৌসুমেও আকাশছোঁয়া। বড় গৃহস্থরা পারলেও প্রান্তিক মানুষেরা এবার পারবে কি? সীমিত ভাগ্যবান মুখচেনা নৌকামালিকদের ভালো ব্যবসার সুযোগ করে দিয়ে আমরা না বনের ভালো করলাম, না প্রান্তিক মানুষের পাশে দাঁড়ালাম। এই প্রান্তিক মানুষেরাই এ দেশটা স্বাধীন করার জন্য মুক্তিপণ যুদ্ধ করেছিল। ছাউনির গোলপাতা এখন আকাশের চাঁদ—গাছেরাও খুশি নয়। বনজীবীদের যাতে ভালো হয়, বনেরও তাতেই মঙ্গল। এই সত্যটা না বুঝে কীভাবে চলবে বন প্রশাসন?
বাংলাদেশের গর্ব করার মতো যে কয়টি প্রাকৃতিক ঐতিহ্য রয়েছে, তার মধ্যে সুন্দরবন অন্যতম। জাতিসংঘের অঙ্গসংস্থা ইউনেস্কো এই বনকে অনেক আগেই ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ’ হিসেবে ঘোষণা করেছে। এর প্রাকৃতিক পরিবেশ ও প্রাণীকূল রক্ষার তাকিদ বরাবরই প্রতিষ্ঠানটি দিয়ে আসছে। এটি শুধু বাংলাদেশেরই সম্পদ নয়, বিশ্বেরও সম্পদ। সুন্দরবন দেশকে ঝড়-ঝঞ্ঝা থেকে রক্ষা করার অন্যতম প্রাকৃতিক বুহ্য। সর্বশেষ আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড় আমফানের তীব্রতা ঠেকিয়ে দিয়ে নিজের সক্ষমতা আবারো প্রমাণ করেছে সে। দানবের মতো আছড়ে পড়া সুপার সাইক্লোন আমফানের তাণ্ডব থেকে ঢাল হয়ে সুন্দরবন বৃহত্তর খুলনার উপকূলীয় ১০ উপজেলার লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন ও সম্পদ বাঁচাতে সহায়তা করেছে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ঝড়টি বাংলাদেশ ও ভারতের উপকূলের ১০০ কিলোমিটারের কাছে আসার সময় এর বাতাসের গতি ঘণ্টায় ছিল ২২০ কিলোমিটার। কিন্তু সুন্দরবন অতিক্রমের পর বসতি এলাকায় আঘাতের সময় এর গতি কমে আসে ১৫১ কিলোমিটারে। অন্যদিকে সরকারের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের হিসাবে ঝড়টির সঙ্গে আসা জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা থাকার কথা ১৫ থেকে ১৮ ফুট। কিন্তু তা উপকূলে আছড়ে পড়ার সময় ১০ থেকে ১২ ফুটে নেমে আসে। অর্থাৎ ঘূর্ণিঝড় আমফানের গতি অন্তত ৭০ কিলোমিটার কমিয়েছে সুন্দরবন। এর জলোচ্ছাসের উচ্চতাও ৫ থেকে ৬ ফুট কমিয়েছে। ফলে ঝড়ে যে পরিমাণে ক্ষতি হয়েছে তার চেয়ে আরও অনেক বেশি ক্ষতির হাত থেকে উপকূলের মানুষ ও সম্পদ রক্ষা পেয়েছে। এর জন্য অবশ্য সুন্দরবনকেও বেশ ক্ষয়ক্ষতির শিকার হতে হয়েছে। ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী সময়ে গঠিত সুন্দরবনের ক্ষতি নির্ধারণ কমিটির প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, ঝড়ের সাথে লড়াই করতে গিয়ে উপড়ে পড়েছে অন্তত ১২৩০০টি গাছ। পাশাপাশি অন্যান্য ক্ষতি মিলিয়ে আমফানে দুই কোটি ২৫ লাখ টাকার সমপরিমাণ ক্ষতি হয়েছে সুন্দরবনের। এর আগে ঘূর্ণিঝড় সিডর, আইলা, রোয়ানু, বুলবুল ও ফণীর গতিও থমকে দিয়ে লাখো মানুষের জীবন ও সম্পদ রক্ষায় ভূমিকা রেখেছে সুন্দরবন।
আল্লাহপাক কোনো কিছুই অনর্থক সৃষ্টি করেননি। প্রতিটি সৃষ্টির পেছনেই রয়েছে সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য। যেমন তিনি পাহাড়কে সৃষ্টি করেছেন কীলক বা পেরেক স্বরূপ, যাতে পৃথিবীর ভূ-ভাগ অহেতুক নড়াচড়া করতে না পারে। এটা তিনি কোরআনে নিজেই বলেছেন। তেমনি, পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবনকে আমাদের জন্য করেছেন প্রাকৃতিক দেওয়াল, যা ঝড়-ঝাপটা থেকে বার বার আমাদের জীবন ও সম্পদ রক্ষা করছে। ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা উইনরক ইন্টারন্যাশনালের তত্ত্বাবধানে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বন ও পরিবেশবিদ্যা ইনস্টিটিউট ‘সুন্দরবনের পর্যটন, ঘূর্ণিঝড় থেকে বসতবাড়ি সুরক্ষা এবং আহরিত সম্পদের আর্থিক মূল্যায়ন’ শীর্ষক একটি গবেষণা করেছিল। তাতে দেখা যায়, ঘূর্ণিঝড় ‘সিডর’-এর সময় সুন্দরবন দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ৪৮৫ দশমিক ২৯ মিলিয়ন ডলারের সম্পদ বাঁচিয়েছিল, বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ চার হাজার কোটি টাকারও বেশি। গবেষকরা বলছেন, ৬ লাখ ৩ হাজার হেক্টর আয়তনের সুন্দরবন না থাকলে টাকার অঙ্কে ক্ষতির পরিমাণ আরও অনেক বেশি হতো। ঘূর্ণিঝড় সিডরের পর আইলা, রোয়ানু, বুলবুল, ফণী এবং সর্বশেষ আমফানের গতি এবং জলোচ্ছাসের উচ্চতা কমিয়ে দিয়ে সুন্দরবন আমাদের ঠিক কী পরিমাণ জীবন ও সম্পদ বাঁচিয়েছে তা এককথায় কল্পনাতীত। শুধু কি ঝড়-ঝাপটা থেকেই সুন্দরবন আমাদের রক্ষা করছে? না, বরং লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন ও জীবিকার উৎসও এই সুন্দরবন। এ বন থেকে গোল পাতা, মধু, মোম, মাছ, কাঠ এবং অন্যান্য বনজসম্পদ সংগ্রহ করে জীবন চলে বিপুল সংখ্যক মানুষের। প্রতি বছর সুন্দরবন থেকে পর্যটন ও বন বিভাগের বিশাল অংকের রাজস্ব আয় হয়ে থাকে। বাংলাদেশ জনসংখ্যার দিক থেকে অতিঘনত্বের একটি দেশ। আয়তনের তুলনায় জনসংখ্যা এখানে অস্বাভাবিক বেশি। আর এই বিপুল জনগোষ্ঠির বেঁচে থাকার জন্য নিঃশ্বাসের সাথে গ্রহণের জন্য যে অক্সিজেন প্রয়োজন, আমাদের বায়ুমণ্ডলে তার সবচে বড় যোগানদাতা এই সুন্দরবন। পাশাপাশি মানুষ, পশু, পাখি প্রশ্বাসের সাথে প্রতি মুহূর্তে যে পরিমাণ কার্বন ডাই-অক্সাইড বাতাসে ছাড়ছে এবং মিল-কারখানা থেকে কার্বনসহ পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর যেসব উপাদান নির্গত হচ্ছে সেসব শোষণ করে আমাদের বায়ুমণ্ডলকে পরিশুদ্ধ করছে এই বন।
আসলে আমাদের জাতীয় জীবনে সুন্দরবনের গুরুত্ব বলে শেষ করা যাবে না। কিন্তু তারপরও আমাদের জন্য এ অমূল্য সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণে তদারকির কোনো বালাই নেই। বরং নানাভাবে এ বনকে ধ্বংস করার পাঁয়তারাই যেন চলছে। সুন্দরবনের চারপাশে শিল্পকারখানা স্থাপন করে, চিংড়ির ঘের দিয়ে, অবাধে গাছপালা কেটে বসতবাড়ি নির্মাণ করে সুন্দরবনকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এক সময় শুধু বাংলাদেশ অংশেই যে বনের আয়তন ছিল ১০ হাজার বর্গ কিলোমিটার, তা এখন দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার বর্গ কিলোমিটারের কাছাকাছি। ভারতের অংশ মিলিয়ে তা ৬ হাজার বর্গ কিলোমিটারের মতো হবে। তারপরও থেমে নেই বন ধ্বংসের প্রক্রিয়া। ২০১৭ সালে সংবাপত্রে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, সুন্দরবন ঘেঁষে ৩২০টি শিল্পকারখানা গড়ে তোলার নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে জাতীয় পরিবেশ কমিটি। ১৯৯৯ সালে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় সুন্দরবনের চারপাশের ১০ কিলোমিটার এলাকাকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা ঘোষণা করলেও তার বরখেলাপ করে এসব শিল্পকারখানার অনুমোদন দেয়া হয়েছে বলে পরিবেশবিদরা অভিযোগ করেছেন। বলা হচ্ছে, জাতীয় পরিবেশ কমিটি দেশের শিল্পায়ন, জ্বালানি নিরাপত্তা ও কর্মসংস্থানের স্বার্থে এসব কারখানাকে অনুমোদন দিয়েছে। যদিও এসব এলাকায় কলকারখানাসহ যেকোনো উন্নয়নকাজ করার আগে বন বনের প্রাণীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য বিভিন্ন শর্ত দিয়ে বিধি করা হয়েছে। কিন্তু কয়লানির্ভর তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র, তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি) বোতলজাত করার কারখানার মতো মারাত্মক পরিবেশ দূষণকারী শিল্পকারখানাও স্থাপন করা হচ্ছে সুন্দরবনের পাশে। পরিবেশবিদরা মনে করছেন, এসব শিল্পকারখানা সুন্দরবনের পরিবেশ ও প্রতিবেশকে ধীরে ধীরে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাবে। যতই বন ও বনের প্রাণীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য শর্তের কথা বলা হোক, তাতে কোনো কাজ হবে না। সুন্দরবনকে ঘিরে শিল্পকারখানা গড়ে উঠার অর্থই হচ্ছে, এর ক্ষতিসাধন। রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন নিয়ে অনেক তর্ক-বিতর্ক এবং এর বিরুদ্ধে সচেতন নাগরিক সমাজ আন্দোলন পর্যন্ত করছে। এ বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপিত হলে সুন্দরবনের কী ধরনের ক্ষতি হবে তার বৈজ্ঞানিক তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরেছেন বিশেষজ্ঞরা। অন্যদিকে সরকারও বিভিন্ন যুক্তি দিয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে বদ্ধপরিকর এবং ইতোমধ্যে তারা এর নির্মাণ কাজ অনেকদূর এগিয়ে নিয়েছে।
নির্মাণাধীন এবং অনুমোদন প্রাপ্ত সুন্দরবন সংলগ্ন সকল কারখানা চালু হলে বনটি যে ভয়াবহ ক্ষতির সম্মুখীন হবে, তাতে সন্দেহ নেই। যতই নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা হোক না কেন, অনাকাক্সিক্ষত দুর্ঘটনা ঘটলে এর প্রভাব যে সুন্দরবনের পরিবেশ ও প্রতিবেশের উপর পড়বে, তা নিশ্চিত করে বলা যায়। দুর্ঘটনা না ঘটার গ্যারান্টি তো কেউ দিতে পারবে না। কয়েক বছর আগে সুন্দরবনের অভ্যন্তরে শ্যালা নদীতে অপরিশোধিত তেলবাহী জাহাজ ডুবে তেল ছড়িয়ে যাওয়ায় কী ভয়াবহ ক্ষতি সাধিত হয়েছে। বৃক্ষরাজির ক্ষতি সাধনের পাশাপাশি নদীর মাছ ও অন্যান্য প্রাণীর মৃত্যু হয়েছে। সুন্দরবনের অভ্যন্তরে নদীতে কয়লাবাহী জাহাজ ডুবির ঘটনাও ঘটেছে। অনুমোদনপ্রাপ্ত শত শত শিল্পকারখানা যখন পুর্নোদ্যমে চালু হবে, তখন সেগুলো থেকে নিঃসরিত বিষাক্ত ধোঁয়া ও কেমিক্যাল অবশ্যই সুন্দরবনের জন্য ক্ষতিকারক হয়ে উঠবে। এ ক্ষতি তাৎক্ষণিকভাবে হয়তো দৃষ্টিগোচর হবে না, তবে বছরের পর বছর ধরে নিঃসরিত হতে থাকা ক্ষতিকর এসব উপাদানের প্রভাব সুন্দরবনের উপর নিশ্চিতভাবেই পড়বে। দেশে কলকারখানা স্থাপন, শিল্পায়ন ও কর্মসংস্থান করার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। তবে এজন্য কেবল সুন্দরবন এলাকাকেই কেন বেছে নিতে হবে? সুন্দরবন ঘেঁষে যেসব কলকারখানা স্থাপন ও চালুর অনুমোদন দেয়া হয়েছে, সেগুলো দেশের অন্যান্য স্থানে করা অসম্ভব ছিল না। সুন্দরবনের অস্তিত্ব ও স্বার্থ রক্ষায় সরকারকে বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করা উচিত। এ কথা মনে রাখা দরকার, শিল্পকারখানা যে কোনো সময় যে কোনো স্থানে স্থাপন করা যেতে পারে। সুন্দরবনের ক্ষতি বা ধ্বংস হলে আরেকটি সুন্দরবন সৃষ্টি করা সম্ভব নয়। তাছাড়া পরিবেশ রক্ষায় যেখানে দেশের মোট আয়তনের অন্তত ২৫ শতাংশ বন থাকা প্রয়োজন, সেখানে আমাদের দেশের আয়তনের ১০ শতাংশ বনভূমিও নেই। এই অবস্থায় যদি সুন্দরবনের আয়তন আরো সংকুচিত হতে থাকে তাহলে পরিবেশের উপর কতটা মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব পড়তে পারে তা ভাবনার বিষয়। আরো ভাবনার বিষয় হলো, পরিবেশবিদ এবং সচেতন নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময় সরকারকে এ ব্যাপারে সতর্ক করা হলেও কোনো ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না।
আমাদের জাতীয় জীবনে প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট সুন্দরবনের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তার শেষ নেই। এর অপরিহার্যতা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল মানুষের সংখ্যাও দেশে কম নেই। তারপরও নানা কারণে সকলের সামনেই তিলে তিলে ধ্বংস হচ্ছে এ বনটি। এর জন্য সরকারের নীতি নির্ধারকরা যেমন দায়ী, তেমনি বন বিভাগসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও দপ্তরের কতিপয় অসাধু ব্যক্তির কাণ্ডজ্ঞানহীনতাও দায়ী। ফলে একদিকে অবাধে বন থেকে মূল্যবান কাঠ পাচার করা হচ্ছে, পশু-পাখি শিকার করে সুন্দরবনকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। কোনো কোনো সময় বন বিভাগের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের এসবের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ততার খবরও পাওয়া যায়। কিন্তু কখনো উপযুক্ত প্রতিকার পাওয়ার সংবাদ পাওয়া যায় না। অন্যদিকে অবাধে শিল্পকারখানা স্থাপন করতে দিয়ে গলায় ফাঁস পরিয়ে সুন্দরবনকে মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে অস্তিত্ব হারাতে পারে আমাদের প্রাকৃতিক দেওয়াল সুন্দরবন। আর সুন্দরবন অস্তিত্ব হারালে তার কী ভয়াবহ পরিণতি হতে পারে তা ধারাণাও করা অসম্ভব। তবে ঘূর্ণিঝড় আমফান সম্পর্কে বিশেষজ্ঞদের মতামত থেকে একটা ধারণা পাওয়া যেতে পারে। দুর্যোগ ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সুন্দরবন না থাকলে কলকাতা শহরে ঘূর্ণিঝড় আমফান যে তাণ্ডব চালিয়েছে, একই পরিণিত হতো ঢাকাসহ আশপাশের গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোর। ঘূর্ণিঝড়ের সময় ঢাকায় বাতাসের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ৭২ কিলোমিটার, আর কলকাতায় ছিল ১১২ কিলোমিটার। সুন্দরবন না থাকলে ঢাকাতেও ১০০ কিলোমিটারের বেশি গতি নিয়ে ঝড়টি চলে আসত। এ অবস্থায় এটি আমাদের সমুদ্র উপকূল থেকে শুরু করে ঢাকা অবদি কী পরিমাণ তাণ্ডব চালিয়ে মানুষের জীবন ও সম্পদ ধ্বংস করত তার হিসাব করাও অসম্ভব হয়ে পড়ত। ১৯৭০ এবং ১৯৯১ সালের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় দুটি আমাদের ভূখণ্ডে আঘাত করেছিল সুন্দরবন বহির্ভূত এলাকা দিয়ে। এই দুটি ঝড়ের আঘাতে বিপুল প্রাণহানি ও তাণ্ডবের কথা স্মরণ করলেই আঁচ করা সম্ভব হবে, যে সুন্দরবন অস্তিত্ব হারালে খুলনা-বাঘেরহাট এবং তৎসংলগ্ন এলাকাগুলোর অবস্থা কী ভয়াবহ হবে। শুধু তাই নয়, আজ যারা সুন্দরবন ঘিরে কলকারখানা স্থাপন করছেন কোনো কারণে যদি এ বন নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় তাহলে পরবর্তী কোনো ঝড়ে সেসব শিল্পকারখানাও যে উড়ে যাবে না তার নিশ্চয়তা কোথায়? কিংবা কলকাতায় ঘূর্ণিঝড় আমফান যে ধ্বংসলীলা চালিয়েছে সেই একই তাণ্ডবে ঢাকায় হলে কী ভয়াবহ অবস্থা হতো তা তো স্যাটেলাইট চিত্রগুলো দেখলেই অনুমান করা যায়।
সুন্দরবন আল্লাহপাকের দেয়া আমাদের জন্য এক অমূল্য নেয়ামত। এটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ঝড়-ঝঞ্জা থেকে যেমন আমাদের রক্ষা করছে। তেমনি নানা রকম বনজ সম্পদ দিয়ে, কার্বন শোষণ করে আমাদের বাঁচিয়ে রাখছে। এটি আমাদের বেঁচে থাকার অতি প্রয়োজনীয় উপাদান অক্সিজেন উৎপাদনেরও প্রাকৃতিক কারখানা। এ বনের কাছে আমাদের ঋণের শেষ নেই। তাই যে কোনোমূল্যে সুন্দরবনকে রক্ষা করাও আমাদের দায়িত্ব। আমরা আমাদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে সুন্দরবন শুধু একাই ধ্বংস হবে না, বরং আমাদের ধ্বংসও অনিবার্য হয়ে উঠবে। তাই নিজেদের স্বার্থেই সুন্দরবনকে টিকে থাকার সুযোগ দিতে হবে। পাশাপাশি আমাদের দীর্ঘ উপকূলজুড়ে এবং বঙ্গোপসাগরে জেগে ওঠা দ্বীপগুলোতে পরিকল্পিত বনায়নের মাধ্যমে প্রাকৃতিক বেষ্টনীকে আরো মজবুত করতে হবে। এর জন্য যদি পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর বিবেচিত শিল্পকারখানাগুলোকে দূরে সরিয়ে নেওয়ার প্রয়োজন হয়, তাহলে সেটাই করতে হবে। সুন্দরবনে সক্রিয় চোরাকারবারী, বনদস্যুদের নির্মূল করতে হবে। পাশাপাশি বনবিভাগের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধেও কঠোর পদক্ষেপ
নিতে হবে সরকারকে।

