সিরাজুল ইসলাম, শ্যামনগর : বঙ্গোপসাগরের তীরে ও বিশ্বের সেরা গহিন গরান বন (mangrove forest) সুন্দরবনের নীড়ে গড়ে ওঠা গাঙেয় বদ্বীপ বাংলাদেশ যেন প্রকৃতির এক বিচিত্র বিলাস। তার মাথার ওপর হিমালয় পর্বত, সাইবেরিয়ার হিমবাহ ঠেকিয়ে চলে অবিরত, পায়ের নিচে বঙ্গোপসাগর তার ধোয়ায় পা প্রতিনিয়ত।
সে কারণেই কর্কটক্রান্তি রেখার ওপর দাঁড়িয়েও চরম নয় তার আবহাওয়া, নাতিশীতোষ্ণতার; মৌসুমি বায়ুর বরমাল্য বরিষণে বাংলা সতত সবুজ-শস্যশ্যামল। আর তাই দ্বিজেন্দ্রলালের কথাই ঠিক- ‘ধন ধান্য পুষ্প ভরা আমাদের এই বসুন্ধরা,’ তার সঙ্গে এ কথা আরও ঠিক- ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি।’ প্রকৃতি বাংলাদেশ আর তার তাবৎ বাসিন্দাদের ভালোবাসা দিয়ে রানীও করেছে, আবার ভিখারিও বানিয়েছে।
তাদের হঠাৎ এমন করে জাগিয়ে দেয় যে ‘জ্বলে পুড়ে ছারখার তবু মাথা নোয়াবার নয়;’ আবার হঠাৎ তাদেরে গহিন ঘুমের দেশেও পাঠায়। তাদের অবস্থা পদ্মার পলিমাটির মতো ‘পানিতে ভিজে নরম কাদা আবার শুকিয়ে গেলে কঠিন খট খইট্টা।’ অসম্ভব চাহিদা অথচ অল্পতে তুষ্ট, সময় পেলে অকর্মণ্য অলসতায় সময় করে পার, ‘আমার বলার কিছু ছিল না’ বলে ফ্যালফ্যাল করে তাকানোয়, অন্যের ওপর দোষ চাপানোয়, আক্ষেপ বেদনা প্রকাশেই প্রাণান্ত, সৃজনশীলতায় ধৈর্যের বড়ই অভাব। সাফল্যকে স্থায়ীকরণে, টেকসইকরণে মনোযোগে বিভ্রান্তি, আবার ব্যর্থতায় ম্রিয়মাণ, বাংলাদেশের ক্রিকেট দল হঠাৎ যেমন ঝলসে ওঠে।
বাংলাদেশের উপকূল অঞ্চলের দৈর্ঘ্য ৭১০ কিলোমিটার। এর মধ্যে সুন্দরবন ১২৫ কিলোমিটার, নদীর মোহনা ও ছোট-বড় দ্বীপমালা ২৭৫ কিলোমিটার, সমতল ও সমুদ্রসৈকত ৩১০ কিলোমিটার। টেকনাফের নাফ নদীর মোহনা থেকে সাতক্ষীরা জেলার সীমান্ত নদী রায়মঙ্গল-কালিন্দী পর্যন্ত খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের মোট ১৪টি উপকূলীয় জেলায় বিস্তৃত বাংলাদেশের উপকূলেই দেশের প্রধান দুটি সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রাম ও মোংলা, বিশ্বের সেরা গহিন গরান বন সুন্দরবন এবং বিশ্বের অন্যতম অখণ্ডিত (unbroken) সমুদ্রসৈকত বা বেলাভূমি কক্সবাজার অবস্থিত।
দেশের ২৫ শতাংশ জনগণ যেমন এ উপকূল অঞ্চলে বসবাস করে, তেমনি জাতীয় অর্থনীতিতে জিডিপির কম-বেশি প্রায় ২৫ শতাংশ অবদানও এ অঞ্চলেরই। দেশের অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও এ অঞ্চল, এর অবকাঠামো এবং বসবাসকারী জনগণের অর্থনৈতিক জীবন নানা দৈব-দুর্বিপাক, বৈষম্য, অবহেলা আর অমনোযোগিতার শিকার।
বলা নেই, কওয়া নেই সমুদ্র প্রায় উত্তাল থাকে। তার মন পবনের ঠিকানা বাংলাদেশের আবহাওয়া দফতর ঠাঁই পায় না। তার এ প্রায়শ পাগলামি সুন্দরবন বরাবরই মাথায় পেতে নিয়ে সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, পিরোজপুর, বরিশাল, বরগুনা ও পটুয়াখালীকে শেল্টার দিয়ে চলেছে।
১৭৯৭ থেকে শুরু করে ২০০৯ সালে আইলা পর্যন্ত সময়ের শুমার পর্যালোচনায় দেখা গেছে, মোট ৪৭৮ বার মাঝারি ও মোটা দাগের জলোচ্ছ্বাস, গোর্কি, হারিকেন, সিডর, নার্গিসেরা বাংলাদেশের উপকূলকে ক্ষতবিক্ষত করেছে। ১৯৭০ সাল পর্যন্ত ১৭৩ বছরে প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছে ৩২৯টি, এসেছে গড়ে ৫-১০ বছর পরপর; কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে বিগত ৪০ বছরে ১৪৯টি ঝড় বা জলোচ্ছ্বাসের ঘটনা ঘটেছে ঘন ঘন।
মাত্র এক বছরের ব্যবধানে সর্বশেষ সিডর আর আইলার আঘাতে স্বয়ং সুন্দরবনও পর্যুদস্ত হয়েছে। প্রাকৃতিক সম্পদে পরিপূর্ণ বাংলাদেশের উপকূল অঞ্চল প্রকৃতির বিরূপ আচরণের প্রথম ও প্রত্যক্ষ শিকার সবসময়েই।
কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে উপকূলীয় অঞ্চলের অর্থনীতির সুরতহাল রিপোর্ট পর্যালোচনা করলে এটি প্রতিভাত হয়ে ওঠে যে, জাতীয় অর্থনীতির আন্তঃসলিলা শক্তির উদ্বোধন যার হাতে; সেই সুন্দরবন বেদনায় বিবর্ণ। বাংলাদেশের পরিসংখ্যান ব্যুরো অর্থনীতির অনেক প্রবণতার সূচক সন্ধানে কালাতিপাত করে; কিন্তু উপকূলীয় জেলাগুলোর আর্থসামাজিক চালচিত্র, খানা থেকে শুরু করে ভূমি বণ্টন ব্যবস্থা, চাষাবাদের হালহকিকত, প্রাণিসম্পদের সালতামামি অনেক কিছুরই বাস্তবতার ব্যাখ্যা তাদের কাছে নেই। উপকূলীয় অঞ্চলের অর্থনীতি যেন শুধু দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ের মাথাব্যথা সূত্রে উপস্থিত; শুধু আকালের দিনে নাকালের মোহনায় এবং একমাত্র মিডিয়ায়।
নদীর অববাহিকাই মানবসভ্যতার সূতিকাগার, কৃষিই প্রাচীনতম জীবিকা আর শ্যামল-সবুজ প্রান্তরে প্রাণিসম্পদের সমারোহই জীবনায়নের স্পন্দন। বাংলাদেশের উপকূল অঞ্চল যে এসব সত্য
গোটা দেশের, সমাজের, অর্থনীতির জন্য অনিবার্য অবকাঠামো শুধু নয়, উন্নয়ন প্রয়াস প্রচেষ্টায় সার্বিক ভারসাম্য রক্ষার জন্যও জরুরি। এটা সুপ্রাচীন কাল থেকে, ইতিহাসের পথ ধরে এ সত্য সতত সব ভূগোলে স্বীকৃত থাকলেও প্রাচীন এ জনপদে তা যেন সবসময় নতুন করে মনে করিয়ে দিতে হয়, যখন পালা করে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে সবাই।
বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রভাবে পড়ে, তাপমাত্রার পবির্তন প্রসূত তারতম্য সূত্রে সমুদ্রের তলদেশ স্ফীত হয়ে ওঠার ফলে পরিবেশ ভারসাম্যহীনতার যে ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে চলেছে, বিশ্বের প্রায় সব সমুদ্র উপকূল বেষ্টনীতে বঙ্গোপসাগর তীরবর্তী বাংলাদেশের জন্য তা মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ের অশনিসংকেত দিয়ে চলেছে। বাংলাদেশের নিম্নাঞ্চল, বিশেষ করে অদূরবর্তী দ্বীপাঞ্চল সামান্য জলোচ্ছ্বাসের সূচনাতেই তলিয়ে যাচ্ছে, তা উদ্ধারে বশংবদ কোনো কার্যক্রম সফল হচ্ছে না। সুন্দরবনের প্রাণিবৈচিত্র্য বিপন্ন হতে চলেছে এর প্রভাবে। বাংলাদেশের উকূলীয় অঞ্চলের কৃষি অর্থনীতির জন্য তা দারুণ দুঃসংবাদ বৈকি!
কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের অর্থনীতিতে একটা গুণগত ও কার্যকরণগত পরিবর্তন সময়ের প্রেক্ষাপটে ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। স্বাধীনতা লাভের প্রায় পাঁচ দশকের মাথায় এসে দেশের সমাজ ও অর্থনীতিতে যতগুলো পরিবর্তন তথা সাফল্যজনিত সূচক শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে, তার মধ্যে খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ম্ভরতা অর্জন অন্যতম।
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ে দেশের জনসংখ্যা ছিল সাড়ে সাত কোটি। সে সময় চাষাবাদযোগ্য ২৫৫ লাখ একর জমিতে ১০০ লাখ টন ধান উৎপাদিত হতো, সে তুলনায় ২০১৮ সালে জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৪০ লাখে দাঁড়ালেও এ সময় ২৬১ লাখ একর জমিতে ধান উৎপাদিত হয়েছে ৩৩০ লাখ টন অর্থাৎ প্রায় তিন গুণ। দ্বিগুণ বর্ধিত জনসংখ্যার জন্য তিন গুণ বর্ধিত খাদ্যশস্য উৎপাদন নিঃসন্দেহে খাদ্যে স্বয়ম্ভরতা অর্জনের ক্ষেত্রে একটি ইতিবাচক অগ্রগতি বা সাফল্য। ১৯৭০ থেকে ২০০৮ সাল সময়ে বাজেটে ক্রমান্বয়ে কৃষি খাতের জন্য বরাদ্দের হিস্যা যথেষ্ট হ্রাস (১৯ থেকে ৭ শতাংশ!) পাওয়া সত্ত্বেও এই প্রবৃদ্ধি একটি নীরব বিপ্লবের সাক্ষ্য বহন করে আর এর অগ্রসাধক হল দেশের আপামর কৃষকসমাজ।
এ প্রেক্ষাপটে উপকূলীয় অঞ্চলের কৃষি অর্থনীতির অবদান তুলনামূলকভাবে নিম্নমুখী। উপকূলীয় অঞ্চলের কৃষি খাত প্রধানত শস্য ও অশস্য (নন ক্রপ) এ দু’ভাগে বিভক্ত। প্রথমত বারবার প্রাকৃতিক দুর্যোগকবলিত হওয়ার কারণে খাদ্যশস্য উৎপাদন তুলনামূলকভাবে এ ক্ষেত্রে বৃদ্ধি পায়নি। একটি পরিশীলিত সমীক্ষা-গবেষণা পর্যালোচনায় দেখা যায়, ১৯৮৪ থেকে ১৯৯৭ সালের মধ্যবর্তী মাত্র ১৩ বছরে জাতীয় পর্যায়ে যেখানে প্রায় দ্বিগুণ পরিমাণ শস্য (খাদ্য ও অর্থকরী ফসল) উৎপাদিত হয়েছে, সেখানে উপকূলীয় অঞ্চলে একই সময়ে শস্য উৎপাদন বাড়েনি বরং কমেছে।
উজান থেকে পানিপ্রবাহ কমে যাওয়ায় পানিতে লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাওয়ায় এখানে চাষাবাদযোগ্য জমির পরিমাণ ক্রমান্বয়ে হ্রাস পেলেও চাষাবাদ পদ্ধতি প্রক্রিয়ায় নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েও কাক্সিক্ষত ফল ততটা আসেনি; যতটা অশস্য-অর্থকরী খাতে অর্থাৎ মৎস্য চাষসহ প্রাণিসম্পদ চাষ ও বিকল্প পণ্য উৎপাদন ক্ষেত্রে এসেছে।
প্রধান সম্পাদক: লে. কমান্ডার (অব.) রাশেদ ইকবাল, প্রকাশক আসিফ কবীর কর্তৃক জন্মভূমি প্রকাশনী লি: ১১০/২,সাংবাদিক হুমায়ুন কবীর বালু সড়ক, খুলনা থেকে মূদ্রিত ও প্রকাশিত