জন্মভূমি ডেস্ক : পরিবেশগত শর্ত পূরণে ব্যর্থ হওয়ায় চামড়া রপ্তানিতে আন্তর্জাতিক বাজার হারাচ্ছে বাংলাদেশ। এর পাশাপাশি ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিশ্বের বড় ব্র্যান্ডগুলোর কাছে ভালো দামে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য বিক্রি করতে হলে এলডব্লিউজি সনদ জরুরি। সেই সনদ রয়েছে বাংলাদেশের মাত্র দুটি প্রতিষ্ঠানের। এছাড়া করোনা পরবর্তী বৈশ্বিক মন্দা ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশসমূহে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে চামড়া ও চামড়াজাতপণ্য রপ্তানি। মূলত এই চার কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়া ও চামড়াজাতপণ্যের চাহিদা কমায় রপ্তানিতে ভালো দাম পাওয়া যাচ্ছে না। ঢাকার হাজারীবাগ থেকে সাভারের হেমায়েতপুরে চামড়া শিল্প নগরীতে ১৫৫টি কারখানা স্থানান্তর করা হলেও সেখানকার পরিবেশগত সমস্যা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে বিদেশী ক্রেতারা। সেখানকার কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগার অকার্যকর ও ধলেশ্বরী নদী দূষণের অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া স্থানীয় পরিবেশ-প্রতিবেশ দূষণ নিয়েও আপত্তি রয়েছে বিদেশী ক্রেতাদের। ফলে বিপুল সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও দেশের চামড়া রপ্তানি সেভাবে বাড়ানো যাচ্ছে না।
কোরবানির কাঁচা চামড়ার দাম পড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের ভালো দাম না পাওয়া। গত কয়েক বছর ধরে সরকার দাম নির্ধারণ করে দিলেও মাঠ পর্যায়ে তা কার্যকর হয়না। এমনকি চামড়া কেনার চাহিদাও কম রয়েছে ট্যানারি মালিক ও আড়তদারদের। ফলে এবারও চামড়ার দাম কার্যকর হয়নি। আর ছাগলের চামড়া বিক্রি হয়েছে পানির দরে। এর ফলে কোরবানির চামড়া নিয়ে এবারও দেশে এক ধরনের অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়। অনেকে দাম না পেয়ে বিনামূল্যেই দিয়ে দিয়েছেন কোরবানির চামড়া। ট্যানারি মালিকরা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কম হওয়ার কারণে দেশেও চামড়ার দাম পড়ে গেছে। অথচ রপ্তানিতে ভালো দাম পাওয়া গেলে কেনার সময়ও ভালো দাম নিশ্চিত করা সম্ভব ছিল। বিটিএর তথ্যমতে, বর্তমানে দেশ থেকে লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপ বা এলডব্লিউজি সনদবিহীন কারখানায় প্রক্রিয়াজাত প্রতিটি চামড়া ন্যূনতম ৪৫ সেন্ট থেকে শুরু করে ১ দশমিক ৮০ ডলারে রপ্তানি হচ্ছে। তবে এলডব্লিউজি সনদধারী কারখানার ক্ষেত্রে এই দাম দ্বিগুণের বেশি। এ অবস্থায় এ খাতের সক্ষমতা বাড়ানোর ওপর জোর দিয়েছেন শিল্প মালিকরা।
চামড়া ও চামড়াজাতপণ্যের রপ্তানি সক্ষমতা বাড়াতে সরকারের উন্নয়ন প্রকল্প প্রোগ্রাম টু সাপোর্ট সেফটি রেট্রোফিটস অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল আপগ্রেডসে (এসআরইইউপি) অন্তর্ভুক্ত হতে চায় এ খাতের উদ্যোক্তারা। সম্প্রতি লেদার গুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফেকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এই প্রকল্পে সংগঠনটির সদস্যদের অন্তর্ভুক্তকরণে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছে চামড়া ও পাদুকা শিল্প খাতের উদ্যোক্তারা। ওই চিঠিতে বলা হয়, বৈশ্বিক কমপ্লায়েন্স বা পরিবেশ সুরক্ষা অর্জনে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে সহজে অর্থের সংস্থানে এই প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত হতে চায় এই খাতের উদ্যোক্তা ও বিনিয়োগকারীরা। উল্লেখ্য, ২০১৯ সাল থেকে বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী ও সরকারের সহায়তায় পোশাক খাতের নিরাপত্তাজনিত সংস্কার ও পরিবেশগত উন্নয়ন প্রকল্প এসআরইইউপি বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সরকারের এই উদ্যোগ বস্ত্র খাতকে পরিবেশবান্ধব করে রপ্তানিকারকদের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়াতে বড় ভূমিকা রাখছে জানিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে দেওয়া চিঠিতে সংগঠনটির সভাপতি সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর বলেছেন, বস্ত্র খাত এবং চামড়াজাত ও পাদুকা শিল্পের প্রধান রপ্তানি গন্তব্য একই। অভিন্ন ক্রেতা, ব্র্যান্ড এবং প্রতিনিয়ত একই ধরনের কমপ্লায়েন্স চাপ নিয়ে পণ্য রপ্তানি করতে হয় এ খাতগুলোকে।
এছাড়া বৈশ্বিক কমপ্লায়েন্স অনুসরণ জোরদার ও আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিযোগিতামূলক সক্ষমতা বৃদ্ধিতে এসআরইইউপি প্রকল্পে এই খাতের উদ্যোক্তাদের অন্তর্ভুক্ত করতে তিনটি কারণ তুলে ধরা হয়। চিঠিতে বলা হয়, বস্ত্র খাত এবং চামড়াজাত ও পাদুকা শিল্প ইউরোপ, জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য বাজারে পণ্য রপ্তানি করে। বস্ত্রের মতোই দীর্ঘ লিড টাইম, চড়া খরচ, ফ্যাশন পণ্যে ভোক্তা চাহিদা হ্রাস, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক মুদ্রাস্ফীতি, রপ্তানি গন্তব্যে উচ্চ সুদের হার ও সার্বিক ব্যবসায়িক ধীরগতির চ্যালেঞ্জে চামড়াজাত ও পাদুকা শিল্প খাত। তবে লেদার সেক্টর বিজনেস প্রমোশন কাউন্সিলের সহযোগিতায় অ্যাসোসিয়েশন ইতোমধ্যে চামড়াজাত পণ্য ও জুতা কারখানায় বৈদ্যুতিক মূল্যায়ন ও বিপদ চিহ্নিত করে তা প্রশমনের নির্দেশ দিয়েছে। কিন্তু এসব কমপ্লায়েন্স অর্জনে অবকাঠামোগত উন্নয়নে যে বাড়তি বিনিয়োগ প্রয়োজন, সেটা জোগান দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তবে এসআরইইউপির চলমান প্রকল্পে চামড়াজাত পণ্য ও পাদুকা শিল্পকে অন্তর্ভুক্ত করলে তহবিল থেকে ঋণ নিয়ে কারখানা সংস্কার ও মানোন্নয়নে আরও বেশি কারখানা এগিয়ে আসবে।
বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) তথ্য অনুসারে, আন্তর্জাতিক সংস্থা লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের (এলডব্লিউজি) সনদ না থাকায় বাংলাদেশ চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানিতে বছরে প্রায় ৫০০ মিলিয়ন বা ৫০ কোটি মার্কিন ডলার আয় হারাচ্ছে। বাংলাদেশে মাত্র দুটি প্রতিষ্ঠানের এলডব্লিউজি সনদ রয়েছে। ফলে বাংলাদেশ মূলত এমন বাজারে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি করে, যেখানে ব্র্যান্ড মূল্য নেই। ফলে এ দেশের রপ্তানিকারকরা পণ্যের দাম কম পান। এই অবস্থায় রপ্তানিতে প্রতিযোগী ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, ভারত ও ব্রাজিলের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে চামড়া ও পাদুকা শিল্প খাতের রপ্তানিকারকদের সক্ষমতা বৃদ্ধি জরুরি বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। চামড়া খাত নিয়ে এক বৈঠক শেষে সম্প্রতি বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, ২০৩০ সালের মধ্যে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য থেকে বার্ষিক রপ্তানি আয় এক বিলিয়ন থেকে বাড়িয়ে ১০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার চেষ্টা করছে সরকার।
এজন্য চামড়া পণ্যের মান ঠিক রাখা রপ্তানি বাজারের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, দেশে কাঁচামাল এবং দক্ষ জনশক্তি রয়েছে। নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার করে চামড়া শিল্পকে অনেক দূর এগিয়ে নেওয়া সম্ভব। আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়া পণ্যের প্রচুর চাহিদা রয়েছে। ২০২৬ সালে বাংলাদেশ এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন করে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হবে। তখন বাংলাদেশের জন্য এলডিসিভুক্ত দেশের সুযোগ-সুবিধা থাকবে না। বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতা করেই দেশকে এগিয়ে যেতে হবে। তিনি জানান, চলমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে ভিয়েতনাম ও চীনের মতো দেশগুলো থেকে লেদার শিল্প স্থানান্তর করা হচ্ছে, যেটি বাংলাদেশের জন্য বড় সুযোগ। এ সুযোগকে কাজে লাগাতে হবে। উন্নতমানের পণ্য উৎপাদন করে লেদার শিল্পকে এগিয়ে নিতে হবে। দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো এ ধরনের শিল্প উন্নয়নে সহায়তা দিচ্ছে। সরকারও প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করছে। তবে বাণিজ্যমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী এই লক্ষ্যমাত্রা পূরণ নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন উদ্যোক্তারা। এজন্য কারখানাগুলোকে শতভাগ কমপ্লায়েন্স হওয়া জরুরি বলে মনে করা হচ্ছে। এছাড়া ১৫৫টি কারখানার মধ্যে ১৫৩টি ট্যানারির এলডব্লিউজি সনদ নেই। এ বিষয়ে নজর দেওয়া জরুরি।