
এম সাইফুল ইসলাম
শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা খান মোকসুদ আলী। ১৯৭১ সালের ১২ এপ্রিল তার বাবা শহীদ হন নিজ কর্মক্ষেত্র রংপুরে। তার লাশ খুঁজে পাওয়া যায়নি। আজও শহীদ খান মোকসুদ আলীর স্মৃতি বয়ে বেড়াচ্ছে তার স্বজনরা। খুলনার বটিয়াঘাটা উপজেলার খারাবাদ বাইনতলা গ্রামের বাসিন্দা খান মোকসুদ আলীর বড় ছেলে আশরাফুল আলম খান এখন বটিয়াঘাটা উপজেলার চেয়ারম্যান।
তার এক মেয়ে মুক্তারুন নাহার একজন রতœগর্ভা। তিনি জানান, তার কন্যা পেশায় ব্যারিস্টার এবং ছেলেটি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একজন মেজর। বর্তমানে তিনি উদয়ন খুলনা জিলা পুলিশ স্কুলের প্রধান শিক্ষক।
তিনি এ প্রতিবেদককে জানান, ১৯৭১ সালে আমি ছিলাম ১০ বছরের একটি বালিকা। আমার সোনালী শৈশব ছিল কিন্তু সুন্দর কৈশোর আমি দেখিনি। ১৯৭১ সালের ১২ই এপ্রিল আমার বাবা মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হন তার কর্মক্ষেত্র রংপুরে। বাবা তৎকালীন ইপিআর এ চাকুরীরত ছিলেন। যেতে হবে ট্রেনিং এর জন্য। পশ্চিম পাকিস্তানের মারিতে দুই বছরের জন্য। আমাদের গ্রামের বাড়ি খুলনার বটিয়াঘাটা উপজেলার খারাবাদ গ্রামে। সেখানে আমরা চলে আসি। বাবা তিন দিনের ছুটিতে একাত্তরের ফেব্রæয়ারি ২৪ তারিখ বাড়িতে আসেন। আর পরদিন ২৫ তারিখ কর্মক্ষেত্রের উদ্দেশে চলে যান। তখন আমরা জানতে পারিনি এই যাওয়াই তার শেষ যাওয়া হবে। বাবার সাথে ছিল আমার অনেক সখ্যতা।
পরিবার সম্পর্কে এ সময় তিনি বলেন, আমাদের খান পরিবারের সবাই আওয়ামী পন্থী। আমার দুই মামা চলে যান ভারতে। বিহার ট্রেনিং করে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। আমার চাচা খান শওকাত আলী শহর ছেড়ে গ্রামে স্বপরিবারে চলে আসেন। আমাদের বাড়িতে হিন্দু মুসলিম অনেক পরিবার আশ্রয় নেন। আমাদের মা চাচীরা মিলে উঠানে বড় ডেকচিতে রান্না করেন। সেখান থেকে সবার খাবার সরবরাহ করা হয়। আমার চাচা এই ব্যবস্থা করেন। মানুষের ভিড়ে ঘুমানোর জায়গা পাওয়া যেত না। আমার কাজ ছিল নতুন আগন্তুকদের দেখভাল করা। কিছুদিনের মধ্যে আমাকে ট্রেনিং দেওয়া হলো কী ভাবে মুক্তিবাহিনীদের সাহায্য করতে হবে। টিফিন ক্যারিয়ারে করে খাবার নিয়ে বিলের ধান গাছের ভিতর দিয়ে তাদের খাবার খাইয়ে আবার চুপি চুপি চলে আসা। আমাদের ঘরের মাচার নিচে গ্রেনেড রাখা হতো। কোনোটা মোচাকৃতি আবার কোনোটা কোকের ক্যানের মত। এইগুলি মুক্তিবাহিনীদের হাতে পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব আমার ছিল। আমাকে বলা হতো গ্রেনেডের বোতামে (চাবিতে) যেন স্পর্শ না করি। এক সময় আমি নিজেই মুক্তিযোদ্ধাদের একজন হয়ে গেলাম। যখন এই গুলি বহন করতাম মনে এক অজানা আশঙ্কা, এক ধরনের রোমান্স কাজ করতো। একদিন ভোর রাতে আমার ঘুম ভেঙে যায়। তখন দেখি এক হিন্দু ভদ্রলোক নরেনকুন্ডু এবং তার পরিবারের সবাই আমাদের বারান্দায় বসে আছে। তার বউয়ের ছোট বোন ২০/২১ বছর বয়স তাকে হাড়ির কালি এবং ছাই মুখে মাথায় মাখানো হচ্ছে। আমি হতবাক হয়ে চেয়ে থাকি, কি বলব বুঝিনা, কেনই বা তাকে এই ভাবে ছাই কালি মাখানো হচ্ছে? আমাকে ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়তে বলা হলো। সকালে উঠে দেখি তারা কেউ নেই। মাকে জিজ্ঞাসা করলাম নরেনকুন্ডু কাকুরা কোথায় ? মা বললেন কাউকে বলো না, উনারা ভারতে চলে গেছেন। আমাদের বাড়ি ছাড়া ২১ ঘর বাদে ওই গ্রামে সব রাজাকার, আলবদর হয়েছে। হিন্দুদের বাড়ি লুট করছে, পুড়িয়ে দিচ্ছে, মেয়েদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে। আমাদের বাড়ির মেয়েরা এবং যারা আশ্রয় নিয়েছিল তারাও কি এক অজানা আতঙ্কে থাকে। তখন আমি বুঝতাম না কেন এরা পালিয়ে থাকে। যখন পাকিস্তানি সেনারা জাহাজে করে টহল দেয়, গুলি ও বোমা মারে তখন আমরা সবাই ট্রেন্স (ছোট পরিখা) এর মধ্যে পালাই। পালানোর জন্য অনেকগুলি ট্রেন্স খনন করা হয়েছিল আমাদের বাড়িতে।