জন্মভূমি ডেস্ক : বিডিআর হত্যাকাণ্ডে ৫৭ সেনা অফিসারকে হত্যা, মেজর সিনহা হত্যাসহ বিগত সরকারের সময়ে বিভিন্ন গুম-খুন ও আয়নাঘরের সাথে যারা জড়িত তাদের সবাইকে গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন সাবেক সামরিক কর্মকর্তারা। সেই সাথে বিভিন্ন সময়ে সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর চাকরিচ্যুত প্রায় এক হাজার সদস্যের মধ্যে যাদের চাকরির বয়স রয়েছে তাদের পুর্নবহালের দাবিও করেন তারা।
মঙ্গলবার (১০ ডিসেম্বর) দুপুরে রাজধানীর সেগুনবাগিচায় ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে এক সংবাদ সম্মেলনে অবসরপ্রাপ্ত সামরিক অফিসারদের সংগঠন জাস্টিস ফর কমরেডসের পক্ষ থেকে এসব দাবি জানানো হয়।
এসময় লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন মেজর (অব.) শাকিল নেওয়াজ। সংবাদ সম্মেলনে লে. ক. (অব.) ইমরান কাজল, লে. ক. (অব.) সাইফুল আলম পাইকদার, লে. ক. (অব.) মেহেদী হাসান, লে. ক. (অব.) সাহানুর রহমান, কর্নেল সামস ও সেনা সদস্য নাইমুল ইসলাম প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
লিখিত বক্তব্যে শাকিল নেওয়াজ বলেন, ২০০৯ সালে বিডিআর হত্যাকাণ্ডে ৫৭ জন সেনা অফিসার হত্যার এখনো পূর্ণাঙ্গ তদন্ত হয়নি। এমনকি প্রকৃত দোষীদেরও বিচার হয়নি। ঢাকা দক্ষিণ সিটির সাবেক মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস মেধাবী অফিসারদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা করেছেন। পরে তাদেরকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে এবং তাদের অন্যায়ভাবে জেল দেওয়া হয়েছে। আমরা এই ঘটনায় পুনঃতদন্ত দাবি করে জড়িতদের বিচারের আওতায় আনার দাবি জানাচ্ছি।
লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, আলোচিত আয়নাঞরের মাস্টারমাইন্ড ছিলেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল মামুন খালেদ, লেফটেন্যান্ট জেনারেল সাইফ, লেফটেন্যান্ট জেনারেল আবেদিন, লেফটেন্যান্ট জেনারেল মুজিব, মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান, মেজর জেনারেল হামিদ। তাদের অতিসত্তর আইনের আওতায় আনতে হবে। ভবিষ্যতে যাতে এমন আর বাংলার মাটিতে এরকম আয়নাঘর সৃষ্টি না হয় সে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি করছি। পুলিশের সাবেক আইজি বেনজীর আহমেদ এবং সাবেক ডিবি প্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশীদসহ বেশ কয়েকজন উচ্চপদস্থ ব্যক্তির বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে গুম খুন হত্যার মতো গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। অতিসত্তর তাদের গ্রেফতার করে বিচারের আওতায় আনা হোক। সাবেক সেনা অফিসার সিনহাকে কীভাবে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে, কিন্তু সেই ওসি প্রদীপের স্ত্রীকে বেকসুর খালাস দেওয়া হয়েছে। প্রদীপের মতো একজন হত্যাকারীর স্ত্রীকে আপনারা এভাবে ছেড়ে দেবেন! কারা এর পেছনে বিহাইন্ড দ্যা সিন রয়েছে, তাদের খুঁজে বের করে আমরা বিচারের দাবি জানাচ্ছি।
শাকিল নেওয়াজ বলেন, বিগত সরকারের সময়ে প্রায় এক হাজার সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর অফিসার এবং সদস্যকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। তারা বাচ্চাদের জন্য দুধ কিনতে পারে না। পরিবারে অশাস্তি হয়েছে। এসব চাকরিচ্যুত সামরিক অফিসার ও সদস্যদের যাদের বয়স রয়েছে তাদেরকে চাকরিতে পুর্নবহালের দাবি করছি।
এসময় সংগঠনটির নেতারা দাবি করেন, বাংলাদেশ পুলিশের অনেক অফিসারকে বিগত সময়ে যারা বঞ্চিত ছিল, তাদের প্রমোশন দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু সামরিক বাহিনীর বঞ্চিত অফিসারদের যাদের জোর করে অবসর ও চাকরিচ্যুত করা হয়েছিল, তাদের ব্যাপারে এখনো সরকার কোনো উদ্যোগ নেয়নি। তেমন কোনো উদ্যোগ দেখাও যাচ্ছে না।
সংগঠনটির অন্যতম নেতা শাকিল নেওয়াজ বলেন, আমরা তো আন্দোলন করতে পারি না। এমন প্রশিক্ষণ আমাদের দেওয়া হয়নি। এভাবে যদি একটি শ্রেণিকে প্রমোশন দেওয়া হয় এবং আরেকটি শ্রেণিকে বঞ্চিত করা হয়, তবে সমাজে বৈষম্য সৃষ্টি হবে। একটি শ্রেণি ওপরে থাকবে আরেকটি শ্রেণি নিচে থাকবে। যদি সুবিধা দেন সবাইকে দেন, না দিলে কাউকে দেবেন না। আমরা অতিসত্বর সরকারকে এবিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য দাবি জানাচ্ছি।
ছয় সামরিক সদস্যকে তুলে নিয়ে হয়রানির বিচার দাবি
গত ৯ নভেম্বর দুইজন নৌ অফিসার ও চারজন সেনা সদস্যকে ট্রাস্ট শর্মা নামে খিলক্ষেতের একটি রেস্টেরেন্ট থেকে ডিজিএফআই পরিচয়ে তুলে নেওয়া হয়। পরে তাদের ২৪ ঘণ্টা থানায় আটকে রাখা হয়। যদিও জাস্টিস ফর কমরেডস ও সাবেক সামরিক কর্মকর্তাদের হস্তক্ষেপে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। কিন্তু কেন তাদের তুলে নেওয়া হয়েছিল, এর কোনো ব্যাখ্যা এখনো দেওয়া হয়নি।
এ বিষয়ে সংবাদ সম্মেলনে শাকিল নেওয়াজ বলেন, ছয় সামরিক সদস্যকে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে বরখাস্ত করায় তাদের জীবনে নেমে এসেছে দুর্বিসহ কষ্ট। তারা সেই রেস্টুরেন্টে বসেছিল। কিন্তু সেখান থেকে তাদের ডিজিএফআই ও র্যাবের গোয়েন্দা পরিচয়ে বেআইনিভাবে আটক করা হয়। যার জন্য আমরা আন্দোলন করেছি। সেই ঘটনা ৫ আগস্টের পর কীভাবে হয় তা আমাদের মাথায় আসে না। আমরা একটি সুন্দর কমিশন গঠন করে এর আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানাই। কারা এভাবে কাজ করে অন্তবর্তীকালীন সরকার ও সেনাপ্রধানকে বিব্রত করার চেষ্টা করছে, তাদের খুঁজে বের করতে হবে।
শাকিল নেওয়াজ বলেন, জাস্টিস ফর কমরেডস নামের সংগঠনটি সাবেক সামরিক অফিসারদের একটি ছাতার তলে সংঘবদ্ধ করার কারণে ফ্যাসিস্ট হাসিনার দোসররা এটি পরিকল্পিতভাবে করেছে। তাদের খুঁজে বের করে শাস্তির আওতায় আনতে হবে। না হলে দেশের সার্বভৌমত্ব থাকবে না। সেনাপ্রধানকে বিব্রত করতেই ছয়জন সামরিক অফিসার ও সদস্যকে তুলে নিয়ে এমন কাজ করা হয়েছে।
ভুক্তভোগী মেহেদী যা বললেন
এসময় ভুক্তভোগী লে. ক. (অব.) মেহেদী হাসান বলেন, আমাদের তুলে নেওয়ার পর থানায় নিয়ে রাখা হয়। সেখানে কোনো খাবারও দেওয়া হয়নি। এমনকি পানিও না। আমি বারবার তাদের বলেছি আমাদের অপরাধ কী আপনারা বলেন। কিন্তু তারা কোনো জবাব দেয়নি। উল্টো আমাদের হয়রানি করেছে। এমন আচরণ আমরা তাদের কাছ থেকে প্রত্যাশা করিনি।
তিনি অভিযোগ করেন, সেই সময় লেফটেন্যান্ট কর্নেল মাহবুব সেনাবাহিনীর ৫৭তম দীর্ঘমেয়াদি কোর্সের আর্টিলারি কোরের একজন অফিসার, তিনি উপস্থিত থেকে এতে নেতৃত্ব দেন। আমরা এ বিষয়ে গত ১৬ নভেম্বর খিলক্ষেত থানায় জিডি করতে গেলেও পুলিশ তা গ্রহণ করেনি। এখন আমাদের ওপর বিভিন্ন রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপের দায় চাপিয়ে দিয়ে অপরাধী বানিয়ে নিজেদের অপরাধ ঢাকার চেষ্টা করছেন। এমনকি আমাদের পুনরায় তুলে নিয়ে গিয়ে অনির্দিষ্টকালের জন্য গুম করা হতে পারে বলেও আমরা আশঙ্কা করছি।
বিডিআর হত্যাসহ সব গুম-খুনের বিচার চান সাবেক সামরিক কর্মকর্তারা
Leave a comment