কালবেলার লেখক বিলীন হয়ে গেলেন কালপুরুষ নক্ষত্রম-লীতে। প্রধানত ভারতের পশ্চিমবঙ্গের জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হলেও বাংলাদেশেও তিনি সমান জনপ্রিয়। সোমবার সন্ধ্যায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন কলকাতার একটি হাসপাতালে। খ্যাতনামা ঔপন্যাসিকের মৃত্যুকালে বয়স হয়েছিল ৮১ বছর। দীর্ঘদিন অসুস্থ থেকে ধরাধাম থেকে বিদায় নিয়েছেন অগণিত পাঠককে শোক সাগরে ভাসিয়ে। কলকাতার পাশাপাশি ঢাকা থেকেও তার বেশ কয়েকটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে। প্রায় নিয়মিত আসতেন বাংলাদেশ সফরে। প্রতিবছর ঈদ সংখ্যায় তার একাধিক গল্প-উপন্যাস প্রকাশিত হতো বিভিন্ন পত্রিকায়।
বাংলা সাহিত্যের রাজধানী হবে ঢাকা- এ কথা বলতেনও জোরেশোরে। লেখকের যথাযথ মর্যাদা, রয়েলটি তথা সম্মানীর সপক্ষে সর্বদা ছিলেন সোচ্চার। রাজনীতির বিষয়ে ছিলেন নিরপেক্ষ, যদিও নক্সালসহ বাম আন্দোলনের প্রতি ছিলেন সহানুভূতিশীল। পশ্চিমবঙ্গের নক্সাল আন্দোলন অবলম্বনে তার অমর ট্রিলজি বা ত্রয়ী উপন্যাসÑ উত্তরাধিকার, কালবেলা ও কালপুরুষ যখন ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতে থাকে, তখন সেগুলো প্রবল জনপ্রিয়তা অর্জনে সক্ষম হয়। রাতারাতি তারকা লেখকে পরিণত হন সমরেশ মজুমদার। লেখকের মৃত্যুতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শোকবার্তা প্রেরণ করেছেন।
জন্ম পশ্চিমবঙ্গে হলেও সমরেশ মজুমদারের শৈশব কেটেছে ডুয়ার্সের চা-বাগানে। কেউ কেউ তাকে আরবান বা নাগরিক লেখক বললেও শৈশব-কৈশোরে চা-বাগানের জীবন, চা-শ্রমিকদের শোষণ-বঞ্চনা-আন্দোলন-সংগ্রাম, রাজনৈতিক পরিস্থিতি এমন কি ব্রিটিশ বেনিয়াদের খলচরিত্র তিনি বিভিন্ন ছোটগল্প ও উপন্যাসে ফুটিয়ে তুলেছেন অনবদ্য ভাষা ও মহিমায়, যা একইসঙ্গে হয়ে উঠেছে হৃদয়গ্রাহী, মানবিক ও শিল্পোত্তীর্ণ। কালবেলার মাধবীলতা-অনিমেষের মতো রোমান্টিক ধাঁচের চরিত্র বাঙালি পাঠক মনে রাখবে চিরদিন। অন্যদিকে সাতকাহনের দীপাবলী বাঙালি নারীর কাছে এখনো অনুসরণীয় চরিত্র। নশ্বর দেহ পঞ্চভূতে বিলীন হলেও নিজের সাহিত্যকীর্তির জন্য সমরেশ মজুমদার চিরদিন বেঁচে থাকবেন বাঙালি পাঠকের হৃদয়ে ও মনে।
১৯৭৫ সালে প্রথম উপন্যাস দৌড় প্রকাশিত হলে পাঠকমহলে সাড়া পড়ে যায়। বাঙালি পাঠক বুঝতে পারেন যে, বাংলা কথাসাহিত্যে আবির্ভাব ঘটেছে নতুন এক তারকার। তখন কথাসাহিত্য ও ছোটগল্পে দোর্দ-প্রতাপে রাজত্ব করছেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সমরেশ বসু, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, রমাপদ চৌধুরী, বিমল কর প্রমুখ। এসব প্রখ্যাতনামার পাশে নিজের একটি শক্তপোক্ত অবস্থান প্রতিষ্ঠা করা মোটেও সহজসাধ্য ছিল না। সমরেশ মজুমদার তা পেরেছিলেন সাবলীল দক্ষতা ও আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে। দিনে দিনে নিজের শক্তিশালী অবস্থানকে পাকাপোক্ত করে নিয়েছেন তিনি। একজন লেখকের কৃতিত্ব ও মহিমা নিহিত রয়েছে এখানেই। অর্জন করেছেন সাহিত্য একাডেমিসহ অসংখ্য পুরস্কার। বাংলা কথাসাহিত্য ও ছোটগল্প অত্যন্ত সমৃদ্ধ এবং আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন।
বাংলা সাহিত্যে অত্যুজ্জ্বল নক্ষত্রদের পাশে নিজের অবস্থানটি নিজস্ব মৌলিক দক্ষতায় সুচিহ্নিত ও সুনিশ্চিত করেছেন কথাশিল্পী সমরেশ মজুমদার। নিজেকে নিয়ে গেছেন এমন এক উচ্চতায়Ñ অনন্ত নক্ষত্রবীথিতে, যেখানে বাঙালি পাঠক তাকে স্মরণে রাখবে চিরদিন- অমলিন মহিমায়।