
ডেস্ক রিপোর্ট : বাংলাদেশে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের ‘লকডাউন’ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে বৃহস্পতিবার ব্যাপক নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশ। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ নেতারা দাবি করছেন, পরিস্থিতি যাই হোক না কেন, তারা এ কর্মসূচির মাধ্যমে ঢাকাকে বিচ্ছিন্ন করে দেবেন।
এর আগে গত কয়েকদিনে ঢাকাসহ বিভিন্ন জায়গায় ককটেল বিস্ফোরণ ও বাসে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আওয়ামী লীগকে দায়ী করছে। পুলিশ বলছে, এসব ঘটনার মাধ্যমে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ও আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। তবে আওয়ামী লীগ নেতারা এ অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, ‘সরকার তাদের মদদপুষ্ট সাম্প্রদায়িক শক্তিকে এগুলো করাচ্ছে আওয়ামী লীগের ঘাড়ে দোষ চাপানোর জন্য।’
ঢাকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গত ২৩ অক্টোবর জানায়, ২০২৪ সালের আগস্টে সংঘটিত ‘মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায়’ সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার রায় ঘোষণার তারিখ ১৩ নভেম্বর নির্ধারণ করা হবে। এ ঘোষণার পর থেকেই ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে ককটেল বিস্ফোরণ ও বাসে আগুন দেওয়ার ঘটনায় জনমনে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করছে পুলিশ।
বিদেশে অবস্থানরত আওয়ামী লীগ নেতা আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাসিম ও দলটির মুখপাত্র মোহাম্মদ আলী আরাফাত জানিয়েছেন, ‘ক্যাঙ্গারু কোর্ট বানিয়ে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ভুয়া রায় দেয়ার চেষ্টার বিরুদ্ধেই’ তারা লকডাউন কর্মসূচি পালন করতে যাচ্ছেন।
ঢাকার পুলিশ কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী জানিয়েছেন, গত ১১ দিনে ১৫টি স্থানে ১৭টি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটেছে এবং গত দুই দিনে ৯টি যানবাহনে আগুন দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, ‘১৩ নভেম্বর নিয়ে আশঙ্কার কোনো কারণ নেই। ঢাকার মানুষ, সেনাবাহিনী, বিজিবি, পুলিশসহ আমরা সবাই মিলে এটি রুখে দেবো। ব্যাপক নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, আওয়ামী লীগ তাদের নেত্রীর মামলার বিষয়টিকে অনেকটা চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছে। ‘এতে তাদের খুব একটা সুবিধা হবে না। তবে রাজনৈতিক মীমাংসা না হলে এ ধরনের পরিস্থিতি বারবার ঘটবে, যা মোকাবেলার সামর্থ্য পুলিশের নেই,’ তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন।
গণঅভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বিভিন্ন সময়ে ঝটিকা মিছিল ও সামাজিক মাধ্যমে সরব ছিল আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থকরা। চলতি বছরের মে মাসে আওয়ামী লীগ এবং এর অঙ্গ, সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনগুলোর কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ ঘোষণা করার পর দলটির সভানেত্রীর ভার্চুয়াল বক্তৃতা ও বিচ্ছিন্ন কিছু ঝটিকা মিছিল ছাড়া আর তেমন তৎপরতা দেখা যায়নি। এর আগে গত নভেম্বরে ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল সরকার।
তবে শেখ হাসিনার মামলার রায় ঘোষণার তারিখ নির্ধারণের পর সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক প্রচারের পাশাপাশি প্রথমবারের মতো ঢাকাকেন্দ্রিক কর্মসূচি ঘোষণা করে দলটি। আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর এক সদস্যের ভিডিও বার্তায় ১০ থেকে ১৩ নভেম্বর পর্যন্ত বিক্ষোভ ও ১৩ নভেম্বর ‘ঢাকা লকডাউন’ কর্মসূচির আহ্বান জানানো হয়। এতে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখায় সরকার ও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো। বিএনপিসহ বিভিন্ন দল এর প্রতিবাদে মিছিল-সমাবেশ করেছে। জামায়াতে ইসলামী সমর্থিত নেতাদের সমন্বয়ে গঠিত ‘জুলাই ঐক্য’ মঞ্চ থেকেও আওয়ামী লীগের কর্মসূচি প্রতিরোধের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।
এরই মধ্যে ঢাকাসহ বিভিন্ন জায়গায় একের পর এক ককটেল বিস্ফোরণ ও বাসে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটছে। রোববার সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আইনশৃঙ্খলাসংক্রান্ত কোর কমিটির বৈঠকে ১৩ নভেম্বরের কর্মসূচি ঠেকাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়। বৈঠকে জানানো হয়, কয়েকটি জেলা থেকে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ইতিমধ্যে ঢাকায় এসেছে।
বৈঠকের পর স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, ১৩ নভেম্বর নিয়ে কোনো শঙ্কা নেই। তবে এরপরও সোমবার ও মঙ্গলবার ঢাকায় বাসে আগুন ও ককটেল বিস্ফোরণের আরও কয়েকটি ঘটনা ঘটে। এমনকি মঙ্গলবার ধানমন্ডিতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার কার্যালয়ের সামনেও ককটেল বিস্ফোরণ ঘটে।
একই দিন এক সংবাদ সম্মেলনে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জানান, সরকার সতর্ক আছে এবং কোনো ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড সহ্য করা হবে না। এর কিছুক্ষণ পর ঢাকার পুলিশ কমিশনার শেখ সাজ্জাত আলী সংবাদ সম্মেলনে এসে বলেন, ‘কিছুদিন ধরে কার্যত নিষিদ্ধ একটি দল অপপ্রচারের মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলা অবনতির চেষ্টা করছে, বিশেষ করে ঢাকা শহরে। ককটেল নিক্ষেপ ও যানবাহনে অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে জনমনে আতঙ্ক ছড়ানোর চেষ্টা চলছে। তবে ১৩ তারিখ নিয়ে আশঙ্কার কারণ নেই, আমরা ব্যাপক নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেব।’
যদিও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাসিম ও মুখপাত্র মোহাম্মদ আলী আরাফাত এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। মি. আরাফাত বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার সুযোগ নিয়ে সরকারের প্রশ্রয় পাওয়া সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলো এ ধরনের নাশকতা করতে পারে। আওয়ামী লীগ শান্তিপূর্ণভাবে তাদের কর্মসূচি পালন করবে।’
শেখ হাসিনার মামলার রায় কবে হবে সেটি ১৩ই নভেম্বর জানাবে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল
নাশকতার দায় অস্বীকার
আওয়ামী লীগের নেতারা জানাচ্ছেন, সভানেত্রী শেখ হাসিনা নিজে তৃণমূল নেতাদের সঙ্গে কথা বলছেন এবং দলের সিনিয়র নেতারাও কর্মসূচি বাস্তবায়নে কাজ করছেন। যদিও বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মী আত্মগোপনে বা দেশের বাইরে থাকায় এ ধরনের কর্মসূচি সফল করা তাদের পক্ষে কতটা সম্ভব, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
তবে মুখপাত্র মোহাম্মদ আলী আরাফাতের দাবি, ‘দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনা নিজেই এ লকডাউনের ঘোষণা দিয়েছেন এবং দেশবাসীকে তা সফল করার আহ্বান জানিয়েছেন। আওয়ামী লীগ ও স্বাধীনতার পক্ষের মানুষ কর্মসূচি সফল করবে। ঢাকাকে পুরো বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করা হবে।’
কিন্তু এই কর্মসূচি ঘোষণার পর থেকে ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে বাসে আগুন দেওয়ার ঘটনায় আওয়ামী লীগকে দায়ী করছে সরকার। সরকারের অভিযোগ, আওয়ামী লীগই নাশকতার পথ বেছে নিয়েছে।
নাশকতার দায় আওয়ামী লীগ নিচ্ছে কি না—এ প্রশ্নে মি. আরাফাত বলেন, ‘আওয়ামী লীগ এই রাজনীতি করে না।’ আর বাহাউদ্দিন নাসিম বলেন, ‘জনপ্রিয় দল হিসেবে আমরা জনমতকে শ্রদ্ধা করি। কথিত আদালতের নামে শেখ হাসিনাকে সাজা দেওয়ার নাটক সৃষ্টি করেছে সরকার। লকডাউন কর্মসূচির মাধ্যমে সেই জনমতেরই প্রতিফলন ঘটবে।’
সরকার ও পুলিশ জানিয়েছে, কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের যেকোনো তৎপরতা কঠোরভাবে দমন করা হবে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমেদ মনে করেন, শেখ হাসিনার মামলার রায়কে ঘিরে বিচ্ছিন্ন সহিংসতায় মানুষের আতঙ্কিত হওয়া স্বাভাবিক। ‘রায় হলে আওয়ামী লীগ ব্যাকফুটে যাবে। তাই তারা এটিকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছে। কিন্তু আতঙ্ক তৈরি করতে চাইলে সেটি ঠেকানো কঠিন। ২০১৩-১৪ সালেও এমন ঘটেছে। ৫ আগস্টের পর রাজনৈতিক মীমাংসার পথে দুই পক্ষের পুনর্মিলন না হলে এ সমস্যা চলবে, যা পুলিশ দিয়ে সমাধান করা সম্ভব নয়,’ তিনি বলেন।
প্রধান সম্পাদক: লে. কমান্ডার (অব.) রাশেদ ইকবাল, প্রকাশক আসিফ কবীর কর্তৃক জন্মভূমি প্রকাশনী লি: ১১০/২,সাংবাদিক হুমায়ুন কবীর বালু সড়ক, খুলনা থেকে মূদ্রিত ও প্রকাশিত