
সাতক্ষীরা প্রতিনিধি: একসময় যাকে বলা হতো ‘অন্তঃপুরবাসিনী’, সেই নারীই এখন হয়ে উঠছেন রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বের কাণ্ডারী। বাংলাদেশের নারীরা আজ শুধু গৃহিণী বা সংসারের সীমাবদ্ধতায় আটকে নেই। সমাজে নারীর ভূমিকার রূপান্তর কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়, এটি সময়ের পরিপক্বতায় অর্জিত এক সংগ্রামী পথচলা। আজ বাংলাদেশের প্রতিটি অগ্রগতির দৃশ্যে নারী অবিচ্ছেদ্য অংশ। প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে রয়েছে নারীর অবদান। তারা শুধু ঘরের দেয়ালে সীমাবদ্ধ নয়, বরং চ্যালেঞ্জিং, ঝুঁকিপূর্ণ ও শারীরিকভাবে ফবসধহফরহম পেশাগুলোতেও সমানতালে অংশ নিচ্ছেন। তারা পুরুষের সঙ্গে সমানভাবে দায়িত্ব পালন করছেন। কখনো সেনাবাহিনীর ক্যাডেট, কখনো পুলিশ অফিসার, সাংবাদিক, নিরাপত্তাকর্মী, আবার কখনো ট্রেন, বিমান বা জাহাজ চালক। একই সঙ্গে উপজেলা প্রশাসন থেকে শুরু করে উচ্চপদস্থ প্রতিটি দপ্তরেও রয়েছে নারীর সরব পদচারণা। নারীর এমন সাহসী অভিযাত্রা আজ কেবল অগ্রগতি নয়, বরং হয়ে উঠেছে এক অনুপ্রেরণার প্রতীক।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ক্যাডেট অফিসার ফাহিমা বিন রনি (ছদ্মনাম) ছিলেন একজন সাহসী উদাহরণ। কয়েক বছর আগে আফ্রিকার একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকায় শান্তিরক্ষা মিশনে অংশ নেওয়ার প্রস্তাব পান তিনি। পরিবারের আপত্তি ছিল প্রবল। যুদ্ধের ভয়াবহতা, অনিশ্চয়তা এবং প্রাণহানির আশঙ্কা পরিবারের মনে ভয় জন্মায়। কিন্তু ফাহিমা নিজের সিদ্ধান্তে অনড় থাকেন। অনেক বুঝিয়ে, যুক্তি দিয়ে রাজি করান পরিবারের সবাইকে। এরপর পাড়ি জমান দূর আফ্রিকায়, পেশাগত দায়িত্বের টানে। সফলভাবে মিশন শেষ করে বিজয়ীর বেশে ফিরে আসেন দেশের মাটিতে। এই গল্প কেবল একজন নারী সেনা কর্মকর্তার সাহসের দলিল নয়, এটি পরিবর্তিত বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি।
এমনই আরেক সাহসী নারীর নাম লাবন্য মাহমুদ। তিনি একজন পেশাদার সাংবাদিক। সাংবাদিকতা এমন একটি পেশা, যেখানে মুহূর্তেই বদলে যেতে পারে পরিস্থিতি। সংবাদ সংগ্রহের জন্য তাকে ছুটতে হয় হরতাল, আন্দোলন, সংঘর্ষ, দুর্ঘটনা কিংবা প্রাকৃতিক দুর্যোগের স্থানে। সাথে সামলাতে হয় ঘর, স্বামী ও সন্তানদেরও। লাবন্য বলেন, ‘আমি ছেলে-মেয়ে আলাদা করে দেখি না। ছেলেরা পারলে আমি কেন পারবো না? আমি অন্য দশজন পুরুষ সাংবাদিকের মতোই এ পেশায় কাজ করি। পেশায় চ্যালেঞ্জ বা ঝুঁকি থাকবেই। তাই বলে ঘরে বসে থাকবো? বিবেক বিবেচনা শিক্ষা, দক্ষতা ও কৌশলী হলে এ পেশায় সফল হওয়া কঠিন নয়। তার এই মনোভাবই প্রমাণ করে, নারী কেবল দায়িত্ব নিতে জানে না, বরং তা সফলভাবে পালন করতেও জানে।
বর্তমানে সাংবাদিকতা পেশাটি সারা বিশ্বেই ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, সংবাদকর্মীরা হুমকি, নিপীড়ন, এমনকি প্রাণনাশের মতো পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছেন।বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। তথাপি, এ পেশায় নারীর অংশগ্রহণ বেড়েই চলেছে। নারী সাংবাদিকরা শুধু দৈনন্দিন সংবাদ কাভারেজে নন, গবেষণা, অনুসন্ধান, যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলে রিপোর্টিং, মানবাধিকার কিংবা অপরাধ প্রতিবেদনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন। তবে জনপ্রিয় টিভি সাংবাদিক শাহনাজ মুন্নী আফসোস করে বলেন, টেলিভিশন সাংবাদিকতায় এখনও নারীর অংশগ্রহণ আশানুরূপ নয়। তিনি মনে করেন, এই পেশায় নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্।
নারীর অগ্রযাত্রার অন্যতম ক্ষেত্র পুলিশ বাহিনী। নারীরা আজ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় দক্ষতা, দায়িত্ববোধ ও সাহসিকতার অনন্য নজির স্থাপন করছেন। সীমান্তে বহিঃশত্রুর আক্রমণ প্রতিরোধে তারা অস্ত্র হাতে পাহারা দিচ্ছেন, যেখানে আগে কেবল পুরুষদের দেখা যেত। বন্দর দিয়ে আমদানি-রপ্তানি পণ্যের রেজিস্ট্রেশন, চেকপোস্টে পাসপোর্ট, যাত্রীদের তথ্য যাচাই এবং ব্যাগেজ তল্লাশির মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বেও নারীরা সমানতালে কাজ করছেন।
নারী চোরাচালানকারী কিংবা নারী অপরাধী শনাক্ত ও গ্রেফতারে নারী পুলিশ সদস্যদের ভূমিকা অপরিসীম। দিন-রাত রাষ্ট্রের নিরাপত্তায় তারা কাজ করছেন পুলিশ অফিসার হিসেবে, এবং এ সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। এটি শুধুমাত্র একটি সংখ্যাগত অগ্রগতি নয়, বরং জাতীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থায় নারীর দক্ষতা ও নির্ভরযোগ্যতার প্রমাণ।
বর্তমানে অপারেশনাল দায়িত্ব ছাড়াও পুলিশের প্রায় সব ইউনিটেই নারী সদস্যরা কর্মরত রয়েছেন। অনেক শিক্ষিত ও প্রশিক্ষিত নারী এখন এই চ্যালেঞ্জিং পেশায় যুক্ত হচ্ছেন এবং সফলতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছেন।স্বাধীন বাংলাদেশের শুরুর দিকে পুলিশে কোনো নারী সদস্য ছিল না। ১৯৭৪ সালে প্রথমবারের মতো পুলিশ বাহিনীতে ১৪ জন নারী সদস্য নিয়োগ পান। আজ বাংলাদেশ পুলিশে ১৫ হাজারেরও বেশি নারী সদস্য কাজ করছেন, যা মোট জনবলের ৭.৯ শতাংশ। নারী পুলিশ সদস্যরা কনস্টেবল থেকে শুরু করে সহকারী পুলিশ সুপার, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, পুলিশ সুপার, এমনকি ডিআইজি পদেও দায়িত্ব পালন করছেন। বর্তমানে নারী ডিআইজি রয়েছেন ২ জন, অ্যাডিশনাল ডিআইজি ৩ জন, পুলিশ সুপার ৭১ জন, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রয়েছেন ১০৯ জন ও সহকারী পুলিশ সুপার রয়েছেন ১০০ জন। এ ছাড়া নারী ইন্সপেক্টর রয়েছেন ১০৯, এসআই ৭৯৭, সার্জেন্ট ৫৮, এএসআই ১ হাজার ১০৯, নায়েক ২১১ এবং কনস্টেবল ১২ হাজার ৫৯৪ ।
পুলিশে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ানোর চেষ্টা চলছে বলে জানিয়েছেন পুলিশের আইজিপি। তিনি বলেন, ‘২০১৫ সালের মধ্যে নারী পুলিশ পুরো বাহিনীর ১৫ শতাংশে পৌঁছানোর লক্ষ্য ছিল। ছয় বছর পর ২০২১ সালে এসে পুলিশ বাহিনীতে নারী পুলিশের সংখ্যা এখন লক্ষ্যমাত্রার অর্ধেক (৭.৯ শতাংশ)।’ পুলিশ বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটে নারী সদস্যরা দায়িত্ব পালন করলেও আগে ট্রাফিক সার্জেন্ট পদে নারী সদস্যদের কাজ করতে দেখা যায়নি। ২০১৭ সালে প্রথমবার ২৮ জন নারী সার্জেন্ট ঢাকার রাজপথে দায়িত্ব পালন শুরু করেন। নারী সদস্যদের জন্য থানাগুলোতে আলাদা ডেস্ক খোলা হয়েছে, যাতে নারী ভুক্তভোগীরা সহজে ও নিরাপদে অভিযোগ জানাতে পারেন। পুলিশের বিশেষ শাখায় কর্মরত উপ-পরিদর্শক সাফিয়া আফরোজ জানান, নারী হিসেবে তিনি কোনো বাড়তি প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়েননি। বরং সহকর্মীদের সহযোগিতা পেয়েছেন।
নারীর অংশগ্রহণে নিরাপত্তা খাতেও এসেছে বৈচিত্র্য। ব্যাংক, শপিংমল, রেস্টুরেন্ট, পোশাক কারখানা, মাল্টি ন্যাশনাল অফিসে নারী নিরাপত্তাকর্মীদের উপস্থিতি বাড়ছে। একজন নিরাপত্তাকর্মী আয়েশা আক্তার বলেন, ‘এ কাজ করতে গিয়ে কখনো মনে হয়নি আমি নারী বলে কম গুরুত্ব পাচ্ছি। তবে দীর্ঘ সময় কাজ করতে হয়, ছুটি কম, মজুরি তুলনামূলক কম-এমন কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে।’ তবুও, আত্মমর্যাদার জায়গা থেকে তিনি গর্বের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন।
শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণও বেড়েছে উল্লেখযোগ্যভাবে। স্বাধীনতা-পরবর্তী ৫০ বছরে কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম সাফল্যগাথা। ১৯৭৪ সালে এ হার ছিল মাত্র ৪ শতাংশ।২০১৬-১৭ সালের শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, বর্তমানে এ হার ৩৬.৩ শতাংশ। এক কোটি ৮৭ লাখ নারী আজ কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতে কর্মরত। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডি-র গবেষণা বলছে, জিডিপিতে নারীর অবদান প্রায় ২০ শতাংশ। তবে গৃহস্থালি ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের মূল্যায়ন করলে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৪৮ শতাংশে।
শিক্ষা, চিকিৎসা, ব্যাংক, প্রশাসন, কূটনীতি, বাণিজ্য—প্রায় সব পেশায় নারীরা এখন দৃশ্যমান এবং কার্যকর ভূমিকা রাখছেন। নারী পাইলট, নাবিক, ট্রেনচালক, ম্যাজিস্ট্রেট, জেলা প্রশাসক, ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী, আইনজীবী, বিচারক, বিজ্ঞানী—সবখানেই নারী আজ সাফল্যের প্রতীক। এমনকি সীমান্ত পাহারায়, বন্দরে, কাস্টমস বিভাগে, বিদেশি শান্তিরক্ষা মিশনেও নারীরা দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছেন।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের সিনিয়র সহকারী সচিব আফরোজা আক্তার রিবার মতে, নারীরা এখন আর অবরোধবাসিনী নন। তাদের অংশগ্রহণ আজ শুধু সমতা প্রতিষ্ঠা নয়, বরং দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন ও অগ্রগতির চালিকাশক্তি। তিনি বলেন, "নারীদের অংশগ্রহণ এখন শুধু চাকরি বা ব্যবসার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, বরং ঝুঁকিপূর্ণ এবং চ্যালেঞ্জিং পেশাগুলোতেও তারা দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছেন।
বাংলাদেশের নারী জাগরণ আজ আর স্লোগানে সীমাবদ্ধ নয়। এটি এখন বাস্তবতা। ঘর সামলে বাইরের পৃথিবীতে নিজেদের যোগ্যতায় স্থান করে নিচ্ছেন নারীরা। পেশাগত লিঙ্গবৈষম্য যতই থাকুক না কেন, তা নারীর অগ্রযাত্রাকে আর থামাতে পারছে না। বরং প্রতিটি চ্যালেঞ্জকে তারা রূপান্তর করছেন সম্ভাবনায়। একজন নারী আজ শুধুই মা, বোন বা স্ত্রী নন-তিনি একজন লড়াকু পেশাজীবী, দেশপ্রেমিক সৈনিক এবং অর্থনীতির অন্যতম চালকশক্তি।
বাংলাদেশের ১৯টি জেলা উপকূলীয় অঞ্চল হিসেবে বিবেচিত। এর মধ্যে সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, পটুয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, বরগুনা, ভোলা, নোয়াখালী ও কক্সবাজার বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এই অঞ্চলে ঘন ঘন ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও বন্যা দেখা দিচ্ছে। একই সঙ্গে ভূগর্ভস্থ পানিতে লবণাক্ততা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, অনেক স্থানে পানযোগ্য পানি পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে নারীর মৌলিক চাহিদার ওপর। পরিবারে পানির যোগান, রান্না, সন্তান লালন-পালন ও দৈনন্দিন গৃহকর্মে প্রধান ভূমিকা পালন করে নারীরা। ফলে পানির সংকট, খাদ্যাভাব বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের অভিঘাত তারা সরাসরি বহন করে। বিশেষজ্ঞদের মতে, উপকূলীয় অঞ্চলে দীর্ঘদিন লবণাক্ত পানি পান করার ফলে উচ্চ রক্তচাপ, প্রসূতি জটিলতা, ত্বকজনিত রোগ ও কিডনি সমস্যা দেখা দিচ্ছে। গবেষণায় দেখা গেছে, উপকূলীয় অঞ্চলের গর্ভবতী নারীদের মধ্যে উচ্চ রক্তচাপের প্রবণতা সমভূমির নারীদের তুলনায় দ্বিগুণ বেশি। গর্ভাবস্থায় অতিরিক্ত লবণাক্ত পানি পান করলে প্রি-এক্লাম্পসিয়া ও এক্লাম্পসিয়ার মতো প্রাণঘাতী রোগ দেখা দিতে পারে, যা মা ও নবজাতকের জন্য মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। এছাড়া লবণাক্ত পানিতে গোসল করার কারণে অনেক নারীর ত্বক পুড়ে যায়, চুল পড়ে যায় এবং চুলকানিসহ নানা চর্মরোগে ভোগেন।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উপকূলে কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। লবণাক্ত মাটি ও পানির কারণে ধান, শাকসবজি ও ফলমূল উৎপাদন কমে গেছে। ফলে খাদ্যে বৈচিত্র্য হারিয়ে যাচ্ছে, বাড়ছে অপুষ্টি। অপুষ্টি নারীর রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে রক্তশূন্যতা ও অকাল বার্ধক্য দেখা দিচ্ছে। উপকূলীয় অঞ্চলে নিরাপদ পানির অভাব এখন একটি বড়ো স্বাস্থ্যঝুঁকি। লবণাক্ত পানির কারণে টিউবওয়েল ও পুকুরের পানি প্রায় অযোগ্য হয়ে পড়ছে। নারীরা প্রতিদিন কয়েক কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে মিষ্টি পানি সংগ্রহ করে। এই পরিশ্রমজনিত ক্লান্তি, শরীরিকচাপ এবং ভারি জলের পাত্র বহন করার ফলে কোমর ব্যথা, পিঠ ব্যথা, এমনকি গর্ভপাতের মতো জটিলতা দেখা দেয়। এছাড়া, ঘূর্ণিঝড় বা জলোচ্ছ্বাসের পর যখন আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিতে হয়, তখন পর্যাপ্ত টয়লেট ও স্যানিটেশন না থাকায় নারীদের স্বাস্থ্য ও মর্যাদা দুটিই হুমকির মুখে পড়ে। অনেক সময় মেয়েরা রাতে টয়লেট ব্যবহারের ভয়ে পানি না খেয়ে থাকে, ফলে তাদের প্রস্রাবের সংক্রমণ ও কিডনি সমস্যা দেখা দেয়।
জলবায়ু বিপর্যয়ে নারীরা শারীরিক ও মানসিক দু’দিক থেকে বড়ো আঘাত পায়। ঘূর্ণিঝড় সিডর, আইলা, রোয়ানু বা আম্পানের পর বহু নারী তাদের ঘরবাড়ি, সম্পদ ও প্রিয়জন হারিয়েছে এবং দুর্যোগে বহু পুরুষ শহরমুখী শ্রমবাজারে চলে যায়, ফলে তখন তাদের কাঁধে পড়ে পরিবার টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব। এ চাপ, দারিদ্র্য ও অনিশ্চয়তার কারণে অনেক নারী হতাশায় ভোগে। গবেষণায় দেখা গেছে, উপকূলীয় অঞ্চলের নারীদের মধ্যে ডিপ্রেশন, অ্যাংজাইটি ও ট্রমাজনিত মানসিক ব্যাধির হার ক্রমবর্ধমান। কিন্তু এখনো মানসিক স্বাস্থ্যসেবা গ্রামীণ পর্যায়ে প্রায় অনুপস্থিত। সামাজিক কাঠামো ও লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্যের কারণে নারীরা পুরুষদের তুলনায় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দুর্যোগের সময় আশ্রয়কেন্দ্রে নিরাপত্তাহীনতা, স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চনা ও আর্থিক অস্বচ্ছলতা তাদের সংকটে ফেলে। ঘূর্ণিঝড়ের সময় অনেক নারী সংস্কার বা লজ্জা-সংকোচে আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে চান না, ফলে প্রাণহানির ঝুঁকি বাড়ে। এছাড়া পরিবারে সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারীর অংশগ্রহণ কম থাকায় জলবায়ু অভিযোজন প্রক্রিয়ায় তাদের মতামত প্রায়শই উপেক্ষিত হয়।
বাংলাদেশ সরকার জলবায়ু পরিবর্তনের এই প্রভাব মোকাবিলায় নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। ২০০৯ সালে প্রণীত এবং ২০২০ সালে হালনাগাদ করা Bangladesh Climate Change Strategy and Action Plan (BCCSAP), দেশের জলবায়ু অভিযোজন কার্যক্রমের মূল ভিত্তি। এই পরিকল্পনার লক্ষ্য জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠী, বিশেষত নারী ও শিশুর স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করা। লবণাক্ততার কারণে টিউবওয়েল ও পুকুরের পানির সমস্যার সমাধানে সরকার জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের মাধ্যমে একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে। বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে গ্রামাঞ্চলে ট্যাংক ও সংরক্ষণাগার স্থাপন করা হচ্ছে। আর্সেনিক ও লবণমুক্ত গভীর নলকূপ স্থাপন করা হচ্ছে উপকূলীয় ইউনিয়নগুলোতে। স্কুল ও আশ্রয়কেন্দ্রে নারীবান্ধব টয়লেট ও স্যানিটেশন সুবিধা বাড়ানো হয়েছে। Safe Water Supply in Coastal Belt Project নামে একটি বিশেষ প্রকল্প বর্তমানে খুলনা, সাতক্ষীরা, ভোলা ও পটুয়াখালী জেলায় চলমান। স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয় উপকূলীয় এলাকায় Climate Resilient Health System গড়ে তোলার কার্যক্রম শুরু করেছে। সাইক্লোনপ্রবণ অঞ্চলে মোবাইল মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে, যারা দুর্যোগ-পরবর্তী সময়ে মাঠপর্যায়ে চিকিৎসা প্রদান করে। প্রতিটি উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে নারী ও শিশুবান্ধব স্বাস্থ্যক্যাম্প পরিচালিত হচ্ছে। প্রসূতি ও জরুরি চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে দক্ষ ধাত্রী নিয়োগ ও প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া স্বাস্থ্য অধিদপ্তর স্থানীয় কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে জলবায়ু অভিযোজন নির্দেশিকা চালু করেছে, যাতে স্বাস্থ্যকর্মীরা পরিবেশ-সম্পর্কিত রোগ সঠিকভাবে নির্ণয় করতে পারেন।
সরকার জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ২০১১ ও Gender Action Plan on Climate Change অনুসারে নারী ক্ষমতায়নমূলক বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে, যেমন উপকূলীয় নারীদের জলবায়ু সহনশীল কৃষি প্রশিক্ষণ, লবণ-সহনশীল ধান, সবজি চাষ ও হাঁস-মুরগি পালন। স্থানীয় পর্যায়ে নারীদের নেতৃত্বে কমিউনিটি সচেতনতা দল (Women Climate Forum) গঠন। মাতৃত্বকালীন ভাতা, বিধবা ভাতা ও খাদ্য সহায়তা কর্মসূচির আওতায় উপকূলীয় নারীদের অগ্রাধিকারভিত্তিক অন্তর্ভুক্তি। এনজিও ও সরকারি সংস্থার যৌথ উদ্যোগে নারী উদ্যোক্তা সহায়তা তহবিল, যা জলবায়ু-সহনশীল জীবিকা গড়ে তুলতে সাহায্য করছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় তার Standing Orders on Disaster (SOD)-এ নারীর নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য সেবা বিষয়ক নির্দেশনা যুক্ত করেছে। প্রতিটি আশ্রয়কেন্দ্রে নারীস্বাস্থ্য কর্ণার চালু করা হয়েছে, যেখানে নারী চিকিৎসক ও ধাত্রী দায়িত্ব পালন করেন। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে স্যানিটারি সামগ্রী ও প্রয়োজনীয় ওষুধ সরবরাহের ব্যবস্থা রয়েছে। দুর্যোগ-পরবর্তী সময় মোবাইল ক্লিনিক ও ফিল্ড হাসপাতাল স্থাপন করা হয়, যেখানে নারীদের বিনামূল্যে চিকিৎসা ও পুষ্টি পরামর্শ দেওয়া হয়। জলবায়ু বিপর্যয়ের কারণে অনেক নারী পরিবার ও সম্পদ হারিয়ে মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে। এ সমস্যা মোকাবেলায় সরকার সম্প্রতি Community Mental Health Programme চালু করেছে। উপকূলীয় জেলা হাসপাতালগুলোতে মানসিক স্বাস্থ্য কর্নার স্থাপন এবং ট্রমা–ভুক্তভোগী নারীদের কাউন্সেলিং সেবা দেওয়া হচ্ছে।
সরকার জলবায়ু-স্বাস্থ্য অভিযোজনে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করছে। UNDP, WHO I FAO–এর সহায়তায় চলছে Health Adaptation to Climate Change in Bangladesh প্রকল্প। Green Climate Fund (GCF) I World Bank–এর অর্থায়নে উপকূলীয় এলাকায় জলবায়ু সহনশীল হাসপাতাল ও ক্লিনিক নির্মাণ হচ্ছে। Coastal Embankment Improvement Project (CEIP)–এর মাধ্যমে উপকূলীয় জনগণের জীবন ও স্বাস্থ্যসুরক্ষা জোরদার করা হয়েছে। নারী ও পরিবার পর্যায়ে জলবায়ু সচেতনতা গড়ে তুলতে সরকার একাধিক কর্মসূচি পরিচালনা করছে—কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে নারীস্বাস্থ্য, নিরাপদ পানি ও পুষ্টি বিষয়ে স্বাস্থ্য শিক্ষা সেশন চালু। স্কুল পাঠ্যক্রমে পরিবেশ ও জলবায়ু শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যাতে মেয়েরা ছোটোবেলা থেকেই সচেতন হয়। স্থানীয় রেডিও ও টেলিভিশনে নারীস্বাস্থ্য ও জলবায়ু সচেতনতা বার্তা সম্প্রচার করা হচ্ছে। জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি ২০১১-তে জলবায়ুজনিত স্বাস্থ্য ঝুঁকি মোকাবিলার নির্দেশনা যুক্ত হয়েছে। অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (২০২১-২৫) নারী ও শিশুর স্বাস্থ্যসেবা উন্নয়নে জলবায়ু অভিযোজনকে অন্যতম কৌশল হিসেবে উল্লেখ করেছে। জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা (NAP ২০২৩) উপকূলীয় নারীদের নিরাপদ পানি, স্বাস্থ্যসেবা ও সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিতে স্পষ্ট দিকনির্দেশনা দিয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (SDGs) অর্জনে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় নারীকেন্দ্রিক নীতি অপরিহার্য। নারী কেবল ভুক্তভোগী নয়, বরং পরিবর্তনের চালিকাশক্তি। তাদের অংশগ্রহণ ছাড়া কোনো অভিযোজন কৌশল সফল হতে পারে না।
জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত একটি কঠিন বাস্তবতা। এর প্রভাব সবচেয়ে স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশের উপকূলীয় নারীদের জীবনে। তারা প্রতিদিন লড়ছে দারিদ্র্য, লবণাক্ততা, অপুষ্টি, সুপেয় পানির সংকটের সাথে, অন্যদিকে বারবার প্রাকৃতিক দুর্যোগ তাদের মানসিক ও শারীরিকভাবে বিপর্যস্ত করছে। তবে, নারীরাই আবার ঘুরে দাঁড়ানোর প্রতীক। যতদিন তারা দৃঢ় মনোবলে সংগ্রাম চালিয়ে যাবে, ততদিন উপকূল টিকে থাকবে জীবনের আশায়। এই সংগ্রামকে টেকসই করতে হলে সরকারের পাশাপাশি স্থানীয় প্রশাসন, নাগরিক সমাজ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আরও নিবিড় সহযোগিতা প্রয়োজন।
একসময় চিংড়ি নিয়ে স্বপ্ন দেখানো হয়েছিল। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর প্রণোদনা আর সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় হাজার হাজার হেক্টর ধানক্ষেত রূপান্তরিত হয়েছিল চিংড়ির ঘেরে। রপ্তানি আয় বাড়ার লোভনীয় হাতছানিতে লবণাক্ত পানি সচেতনভাবে প্রবেশ করানো হয় মিঠা পানির অঞ্চলে। স্থানীয় প্রভাবশালী ও রাজনৈতিক চক্রের ছত্রছায়ায় কৃষকের ইচ্ছার বিরুদ্ধে এই আগ্রাসন চলে। যে জমিতে একসময় সোনার ধান ফলত তা ধীরে ধীরে বন্ধ্যা হয়ে পড়ে। এর সামাজিক প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। ক্ষমতা আর অর্থের জোরে কৃষকের জমি দখল হয় এবং একটি ভূমিহীন শ্রেণির জন্ম হয়। এই সামাজিক ভাঙনের প্রথম এবং সবচেয়ে বড় শিকার হয় নারী ও শিশুরা। যে চিংড়িকে ভাবা হয়েছিল আশীর্বাদ, তা-ই উপকূলীয় জনজীবনে পরিণত হয় অভিশাপে। এই পরিবর্তিত বাস্তবতার সাথে খাপ খাওয়াতে গিয়ে সবচেয়ে বেশি মূল্য দিতে হচ্ছে নারীদের।
উপকূলীয় অঞ্চলে সুপেয় পানির তীব্র অভাব। একটি ওয়াটার ট্যাংক হয়তো একটি গ্রামের পানির চাহিদা মেটাতে পারে, কিন্তু যখন পুরো একটি অঞ্চলের ভূগর্ভস্থ পানি লবণাক্ত হয়ে যায়, তখন প্রয়োজন হয় সমন্বিত এবং বৃহৎ আকারের পরিকল্পনার। এর অভাবে সবচেয়ে সমস্যায় পড়তে হয় নারীদের। কারণ, এখানকার প্রায় সব পরিবারের খাবার পানি নারীদেরই সংগ্রহ করা লাগে।
খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার ফাতেমা বেগমের কথাই ধরা যাক। তার দিন শুরু হয় ভোরের আলো ফোটার আগে। পরিবারের সবাই যখন ঘুমে, তাকে ছুটতে হয় নিরাপদ পানির সন্ধানে। প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরের একটি পুকুর থেকে তাকে পানি বয়ে আনতে হয়। লবণাক্ততার কারণে গ্রামের বেশিরভাগ নলকূপ আর পুকুর এখন ব্যবহারের অযোগ্য। কাঁখে ভারী কলসি আর পায়ে কাদা মেখে এই পথ পাড়ি দেওয়া তার প্রতিদিনের রুটিন। তার এই যাত্রায় সঙ্গী হয় গ্রামের অন্যান্য বাড়ির নারীরা। পানি এনেই শেষ নয়, এখানকার অনেক নারীকেই ছুটতে হয় নদীতে অথবা চিংড়ির ঘেরে। সেখানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা নোনা পানিতে চিংড়ির পোনা ধরে সেগুলো ঘেরে ছাড়া বা মাছের খাবার দেওয়ার কাজ করতে হয়। পায়ের আঙুলের ফাঁকে লবণাক্ত পানির কারণে ঘা হয় অনেকেরই। এছাড়া অন্যান্য শারীরিক সমস্যা তো লেগেই থাকে। তীব্র যন্ত্রণা হলেও কাজ থামানোর উপায় নেই। কারণ, তাদের আয়ের ওপর সংসারের অনেকটা নির্ভর করে। দিনশেষে বাড়ি ফিরে আবার রান্নাবান্না আর সংসারের হাজারো কাজ। নিজের শরীরের দিকে তাকানোর ফুরসতটুকুও তার মেলে না। এই গল্প কোনো বিচ্ছিন্ন গ্রামের ঘটনা নয়, এটিই উপকূলের অনেক গ্রামের হাজারো নারীর প্রাত্যহিক জীবনের প্রতিচ্ছবি।
উপকূলীয় নারীর জীবন এক অনন্ত সংগ্রামের নাম। দিনের বড় একটি সময় লবণাক্ত পানিতে নেমে কাজ করতে হয় বলে তাদের স্বাস্থ্যের অবস্থা মারাত্মক। লবণাক্ত পানির আগ্রাসন শুধু মাটির গভীরে নয়, নারীর শরীরের গভীরেও পৌঁছেছে। চর্মরোগ, খোসপাঁচড়া এবং চুলকানি একটি সাধারণ সমস্যায় পরিণত হয়েছে। এর চেয়েও ভয়াবহ হলো জরায়ুর সংক্রমণ। অপরিষ্কার ও লবণাক্ত পানি ব্যবহারের ফলে বহু নারী মাসিকের সময় জটিলতায় ভোগে এবং জরায়ুর ইনফেকশনসহ দীর্ঘস্থায়ী রোগে আক্রান্ত হয়। সামাজিক লজ্জা এবং দারিদ্র্যের কারণে তারা সহজে চিকিৎসকের কাছে যেতে পারে না। এই প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের অভাব এবং স্বাস্থ্যকেন্দ্রের অপ্রতুলতা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। ফলে একটি নিরাময়যোগ্য রোগও দীর্ঘস্থায়ী ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এই শারীরিক সংকট কেবল নারীদের একার নয়, এটি প্রভাব ফেলে পরবর্তী প্রজন্মের ওপরও। অসুস্থ মায়েদের সন্তানেরা প্রায়শই অপুষ্টি আর নানা জটিলতা নিয়ে জন্মায়।
তবে উপকূলের এই নারীরা শুধু পরিস্থিতির শিকার হয়ে বসে থাকেনি। পরিবারের পুরুষ সদস্যরা কাজের সন্ধানে শহরে পাড়ি জমালে সংসারের পুরো দায়িত্ব এসে পড়ে নারীর ওপর, যা তাদের জীবন সংগ্রামকে আরও কঠিন করে তোলে। তারা এই লবণাক্ততাকে সঙ্গী করেই খুঁজে নিয়েছে নতুন পথের দিশা। প্রতিকূলতাকে শক্তিতে রূপান্তর করে তারা হয়ে উঠেছে একেকজন সফল উদ্যোক্তা। যে লবণাক্ততা তাদের ধান চাষ কেড়ে নিয়েছে, সেই নোনা পানিতেই তারা শুরু করেছে কাঁকড়া চাষ। পরিবারের পুরুষ সদস্যের পাশাপাশি কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এই নারীরা কাঁকড়া মোটাতাজাকরণ প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়েছে। এর মাধ্যমে অর্জিত অর্থ পরিবারের অর্থনৈতিক মুক্তির পথ দেখাচ্ছে। অনেক নারীই এখন চিংড়ি ঘেরের কাজের পাশাপাশি বাড়ির উঠোনে ছোট খাঁচায় কাঁকড়া চাষ করছে।
এর পাশাপাশি গৃহস্থালির সার্বিক দায়িত্বও তারা সামলায়। বাড়ির উঠোনে হাঁস-মুরগি পালন কিংবা গবাদি পশু চরানো তাদের দৈনন্দিন কাজের অংশ। এসব থেকে যা আয় হয় তা দিয়ে সন্তানের পড়াশোনার খরচ বা পরিবারের ছোটখাটো চাহিদা মেটানো হয়। অনেকে আবার হস্তশিল্পের মতো সৃজনশীল কাজেও নিজেদের যুক্ত করেছে। নকশিকাঁথা বোনা বা স্থানীয় উপকরণ দিয়ে শোপিস তৈরি করে তারা বাড়তি আয়ের সংস্থান করছে। এই অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা তাদের শুধু আত্মবিশ্বাসী করে তুলছে না, পরিবারে তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতাও বাড়িয়ে দিচ্ছে। যে নারী আগে নিজের মতামত প্রকাশ করতে পারত না, সে-ই আজ পরিবারের একজন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত প্রণেতা।
জলবায়ু পরিবর্তনের সংকটে সরকারি এবং বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। অনেক এলাকায় বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের জন্য বড় ট্যাংক স্থাপন করা হয়েছে। লবণাক্ততা-সহনশীল ধানের জাত উদ্ভাবন ও তা চাষে কৃষকদের উৎসাহিত করা হচ্ছে। বিভিন্ন এনজিও নারীদের দক্ষতা উন্নয়নে সেলাই ও অনেক বিকল্প পেশার প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। এই উদ্যোগগুলো প্রশংসার যোগ্য হলেও প্রয়োজনের তুলনায় তা নিতান্তই অপ্রতুল। উপকূলীয় অঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকায় লক্ষ লক্ষ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত। বিচ্ছিন্নভাবে নেওয়া প্রকল্পগুলো অনেক সময়ই সঠিক মানুষের কাছে পৌঁছায় না অথবা দীর্ঘমেয়াদে টেকসই হয় না। নারীদের জন্য নেওয়া প্রশিক্ষণগুলোও অনেক সময় বাজারজাতকরণের অভাবে পুরোপুরি সফল হতে পারে না। ফলে এসব নারীদের টিকে থাকতে হয় মূলত নিজেদের অদম্য ইচ্ছাশক্তির ওপর ভর করেই। তাদের এই সংগ্রাম কেবল বেঁচে থাকার জন্য নয়। এটি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি বাসযোগ্য পরিবেশ নিশ্চিত করার লড়াই। তারা নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকে শিখেছে কীভাবে লবণ-সহনশীল সবজির চাষ করতে হয়। বাড়ির পাশে ছোট্ট এক টুকরো জমিতে তারা পুঁইশাক, লাউ বা ঢেঁড়সের মতো সবজি ফলিয়ে পরিবারের পুষ্টির জোগান দেয়।
উপকূলের এই হার না মানা নারীরা শুধু টিকে থাকার যোদ্ধা নয়, তারা জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে সম্মুখসারির পথিকৃৎ। তাদের জীবনগাঁথা কেবল বঞ্চনা আর কষ্টের নয়, বরং সাহস আর ঘুরে দাঁড়ানোর এক জীবন্ত দলিল। বড় বড় আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যখন জলবায়ু ন্যায্যতা নিয়ে আলোচনা হয়, তখন উপকূলের এই নারীরা তাদের দৈনন্দিন সংগ্রামের মাধ্যমে সেই ন্যায়ের বাস্তব রূপটি দেখিয়ে দেয়।
প্রধান সম্পাদক: লে. কমান্ডার (অব.) রাশেদ ইকবাল, প্রকাশক আসিফ কবীর কর্তৃক জন্মভূমি প্রকাশনী লি: ১১০/২,সাংবাদিক হুমায়ুন কবীর বালু সড়ক, খুলনা থেকে মূদ্রিত ও প্রকাশিত