জি এম ফিরোজ, ডুমুরিয়া : বিগত বর্ষায় তলিয়ে যাওয়া ‘বিল ডাকাতিয়া’র কয়েক হাজার চিংড়ি ঘের ভেসে যাওয়ায় চাষিরা মারাত্মক ক্ষতির শিকার হন। তার ৩ মাস পরও আসন্ন বোরো মৌসুমে ধান চাষের জমি জেগে না ওঠায় কৃষকদের পথে বসার উপক্রম হয়েছে।
খুলনা-যশোর জেলার ডুমুরিয়া-ফুলতলা-অভয়নগর-কেশবপুর-মনিরামপুর উপজেলার ২ লক্ষাধিক একর আয়াতনের ‘দেশ-খ্যাত বিল ডাকাতিয়া’য় ১৯৯০ সালের পর থেকে স্থায়ী জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। তখন থেকে আওয়ামী লীগ নেতা গাজী আবদুল হাদী ও কৃষক সংগ্রাম সমিতি নেতা সুলতান মল্লিক’র যৌথ-নেতৃত্বে ভুক্তভোগী কৃষক ও অসহায় মানুষের ব্যাপক আন্দোলন-সংগ্রামের চুড়ান্ত পর্যায়ে বিক্ষুব্ধ জনতা দৌলতপুর-চুকনগর সড়কের শলুয়া গেটের পাশে, সন্ধ্যার খাল, আমভিটা নামক স্থানে কেঁটে দিলে বিল থেকে অনেক পানি বেরিয়ে যায়। তারপর পানি উন্নয়ন বোর্ড ৬৩ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘কেজেডিআরপি’ প্রকল্প হাতে নিয়ে শলুয়া স্লুইচ গেটের মুখ থেকে কৈয়া পর্যন্ত নদী ও কয়েকটি খাল খনন, শোলমারি নদীর মুখে বাধ দিয়ে ১০ ভেন্টের স্লুইজ গেট তৈরি-সহ কয়েকটি কালভার্টও নির্মান করে। আর সে কারণে বিগত ২২-২৩ বছর ধরে বিল ডাকাতিয়া এলাকার মানুষ জেগে যাওয়া বিলে খন্ড খন্ড জমিতে নিজের মতো করে ভেড়ি-বাধ দিয়ে মাছ চাষের পাশাপাশি বোরো মৌসুমে ধান ও ভেড়িতে নানা প্রকার সবজি চাষ করে ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়ে বেশ আনন্দেই জীবন-যাপন করছিলেন। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে শোলমারী নদীতে পলি জমে জমে অনেকাংশে ভরাট হয়ে যাওয়ার পাশাপাশি গেটের ভেতরে কৈয়া’র সংযোগ নদীতেও পলি জমে ভরাট হওয়ায় বিল ডাকাতিয়ার তলদেশ অনেক নিচু হওয়ায় ধীরে ধীরে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হতে থাকে। আর বিগত মৌসুমের অতি বর্ষণে সমগ্র বিলের চিংড়ি ঘেরগুলো তরিয়ে যাওয়ায় সব মাছ বের হয়ে যাওয়ার পাশাপাশি ভেড়ির সকল সবজি নষ্ট হয়ে যাওয়ায় চাষিরা চরম ক্ষতির শিকার হন। আর তখন থেকেই ডুমুরিয়া উপজেলার রংপুর ও রঘুনাথপুর ইউনিয়নের জনপ্রতিনিধিদের উদ্যোগে ভুক্তভোগি জনগণ পানি নিষ্কাশনের আশায় আগষ্ট-সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাস জুড়ে প্রতিদিন ’শ ’শ কৃষক কৈয়া এলাকার শোলমারী ১০ ভেন্টের গেটের কাছে এসে সামনের নদীতে নেমে স্বেচ্ছাশ্রমে পলি অপসারণ করেছেন। ডুমুরিয়া-ফুলতলা’র সংসদ সদস্য ও ডুমুরিয়া উপজেলা চেয়ারম্যানের সার্বক্ষণিক তদারকি ও পানি উন্নয় বোর্ডের সহায়তায় ২ মাসেও অধিক সময় ধরে স্লুইচ গেটের বাইরে বা ভেতরে পলি অপসারণ কাজ চলে। কিন্তু নদীর তলদেশ থেকে বিলের তলদেশ অনেক নিঁচু হওয়া ডাকাতিয়া থেকে আশানুরুপ পানি বের হয়নি। ওইসব চেষ্টায় পলি অপসারণের ২ মাস পার হলেও বিল ডাকাতিয়া থেকে মাত্র ১-দেড় ফুট পানি নেমে গেছে। আর তাতে চিংড়ি-মাছের ঘেরের ভেড়ি বাধটা সামান্যই জেগেছে। চলতি বোরো মৌসুমের শুরুতে ঘেরের মধ্যে এখনও ৩ থেকে ৪ ফুট পানি থাকায় আর ১ মাসেও ধান রোপনের কোনো সুযোগ তৈরি হবে না। তবে গ্রাম লাগোয়া কিছু পরিমান উচু জমিতে ধান হতে পারে।
এ প্রসঙ্গে ডুমুরিয়া উপজেলা কৃষি অফিসার ইনসাদ ইবনে আমিন বলেন, বিল ডাকাতিয়ায় ডুমুরিয়া উপজেলা অংশে জলাবদ্ধতার পরিমান দিনে-দিনে কমে আসছে। আশাকরি বোরো আবাদে সমস্যা হবে না। কিন্তু ডাকাতিয়া বিলের কৃষকরা সম্পূর্ণ ভিন্নমত পোষণ করে বলেন, গত ২ মাসে বিলে মাত্র ১ থেকে দেড় ফুট পানি কমায় শুধুমাত্র চিংড়ি ঘেরের বেড়ি-বাধটিই দেখা যাচ্ছে। তবে ঘেরের মধ্যে এখনও ৩-৪ ফুট পানি রয়েছে। কি ভাবে ধান চাষ সম্ভব ? হারি নিয়ে ১৬ বিঘা জমিতে ধান-মাছ চাষি নিউটন বাড়ই বলেন, ডুমুরিয়া উপজেলার টোলনা, পাকুড়িয়া, কোমরাইল, আন্দুলিয়া, দেড়লী, শাহপুর, কৃষ্ণনগর, থুকড়া, রুপরামপুর, গজেন্দ্রপুর, রামকৃষ্ণপুর, ঘোনা, শলুয়া, পাহাড়পুর, সাড়াভিটা, বটবেড়া, বারানসি, মুজারঘুটা, বসুরাবাদ, ধামালিয়া, রঘুনাথপুর ও রংপুর এলাকার ১ লক্ষাধিক মানুষ এই বিল ডাকাতিয়ার ‘মাছ-ইরি-গরু-তরকারি’ চাষের ওপরই আমরা নির্ভরশিল। এসব এলাকার কোথাও ধান চাষের মতো অবস্থা হয়নি। অবিনাশ বালা বলেন, জলাবদ্ধতার কারণে আমাদের এলাকার ঠাকুরঝি পুকুর মহাশ্মশানে যাওয়ার ১ কিলোমিটর রাস্তা দিয়েও চলাচল করা যাচ্ছে না বলে, অন্য এলাকায় নিয়ে আমাদের মরদেহ সৎকার করতে হচ্ছে। ইতোমধ্যে আমাদের ঘের তলিয়ে মাছ-তরকারি শেষ, আসন্ন বোরো মৌসুমে ধান চাষ করতে না পারলে আমাদের পথে বসতে হবে। তাছাড়া জমির হারি দেবো কী করে বা আমরা কী খাবো ? অনুপ বসাক বলেন, কিছুদিন আগে বিল ডাকাতিয়ার তরকারি নিয়ে ঢাকার বাজার ভরতো। এখন আমাগে খাওয়ার তরকারিও নেই। এখন ধান করতি না পারলি আমাগে মরা ছাড়া কোনো উপায় নেই।
ডুমুরিয়া উপজেলা পানি কমিটির সম্পাদক শেখ সেলিম আকতার স্বপন বলেন, বিল ডাকাতিয়া’র তলদেশ থেকে নদী উচু হয়ে যাওয়ায় নদীর পলি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বিল ডাকাতিয়ার ভেতরে পলি ফেলে উচু করার দাবিতে পানি সম্পদ মন্ত্রী’র কাছে আমাদের উপজেলা চেয়ারম্যান, ২ ভাইস-চেয়ারম্যান ও ১৪ ইউনিয়নের সকল চেয়ারম্যান স্বাক্ষরিত একটি আবেদন করেছি। সব থেকে ক্ষতিগ্রস্থ রংপুর ইউপি চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ সমরেশ মন্ডল বলেন, বিল-কে ধান লাগানোর উপযোগী করতে এলাকার কৃষকদের নিয়ে পলি অপসারণ-সহ পানি উন্নয়ন বোর্ডে দেন-দরবার করেই চলেছি। জলনিষ্কাশনে বিশেষ তৎপর ডুমুরিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান গাজী এজাজ আহমেদ বলেন, জলাবদ্ধতার কারণে সকল মাছের ঘের ভেসে গেছে। এখন ধান চাষ করতে গেলে, অবিলম্বে উচ্চ ক্ষমতার পাম্প মেশিনের মাধ্যমে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে।
খুলনা’র পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আবদুর রহমান তাজকিয়া বলেন, বিগত বর্ষার সময় ১০ ভেন্টের সংযোগ খালের পলি অপসারণ করা হয়েছে। কিন্তু তারপরও বিলের তলদেশ নিচু হওয়ায় আশানুরুপ পানি বের হচ্ছে না। তাই আমরা ভবদহ’র মতো উচ্চ ক্ষমতার পাম্প মেশিন বসিয়ে পানি নিষ্কাশনের জন্য উচ্চ পর্যায়ে প্রস্তাব পাঠিয়েছি। সাবেক মন্ত্রী তথা খুলনা- ৫ সাংসদ নারায়ণ চন্দ্র চন্দ বলেন, আশু পানি সরানোর চেষ্টা অব্যাহত আছে। তবে নদী ভরাট হয়ে যাওয়ায় স্থায়ী সমাধানের জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা দরকার।
‘বিল ডাকাতিয়া’য় কৃষকদের পথে বসার উপক্রম
Leave a comment