
সাতক্ষীরা প্রতিনিধি : সুন্দরবন ধ্বংসে আন্তর্জাতিক চক্রান্ত চলছে ক্রমেই ছোট হচ্ছে সুন্দরবন, হুমকির মুখে জীববৈচিত্র্য আমাদের পরম প্রয়োজনীয় সুন্দরবন, এই সুন্দরবন বাঁচলে বাংলাদেশ ভালো থাকবে ইনশাআল্লাহ বাংলাদেশের ফুসফুস সুন্দরবনকে বাঁচাতে হবে।
সরকারের কর্তাব্যক্তিরা একের পর এক সুন্দরবন কেন্দ্র করে উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এর ফলে উপকারের চেয়ে ক্ষতিই হয়েছে বেশি। সুন্দরবনের বন, জীববৈচিত্র্য ও নদীগুলো একে একে ধ্বংসের পথে যাচ্ছে।
যা কখনই কাম্য না। মূলত: সুন্দরবনকে ধ্বংস করার জন্য আন্তর্জাতিক চক্রান্ত চলছে, সরকারকে এ চক্রান্ত থেকে বের হয়ে সুন্দরবন রক্ষা করতে হবে।
সুন্দরবন মায়ের মতো প্রতিটি বড় বড় ঘূর্ণিঝড়ের হাত থেকে দেশকে রক্ষা করছে। উপকূলের কোটি-কোটি মানুষকে নিরাপদ রাখতে ও তাদের জীবিকা নির্বাহে সুন্দরবন ব্যাপক ভূমিকা রাখে। অথচ বছরের পর বছর সেই সুন্দরবনই ভালো নেই। এর জন্য দায়ী আমরাই। ম্যানগ্রোভ এই বন জীববৈচিত্র্য ধ্বংসকারী চোরা শিকারি, পানিবায়ুর পরিবর্তনে পানির উচ্চতা বৃদ্ধি, পরিবেশ দূষণ ও কাঠ পাচারকারীদের কারণে এখন অস্তিত্ব সংকট।
সুন্দরবন দেশের মানুষের গর্ব, অহংকার। একে রক্ষা করার দায়িত্ব এদেশের মানুষেরই। ২৪ ঘণ্টায় ছয় বার প্রাকৃতিক রূপ বদলানো সুন্দরবনের মোট আয়তনের ৫২ ভাগই এখন ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের অংশ। এই বনের মোট আয়তনের ৩১ দশমিক ১৫ ভাগই হচ্ছে নীরাভূমি। বিশ্বের অন্যান্য ম্যানগ্রোভ বনের তুলনায় সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য অধিকতর সমৃদ্ধ। অথচ মানুষই সেই সম্পদ ধ্বংস করছে।
বন বিভাগ বলছে, পানিবায়ু পরিবর্তনের ফলেও বিরূপ প্রভাব পড়তে শুরু করেছে সুন্দরবনে। সমুদ্রে পানির উচ্চতা বাড়ায় প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছাড়াও পূর্ণিমা ও আমাবস্যার সুন্দরবনের অনেক উঁচু এলাকা তলিয়ে যাচ্ছে। পানিতে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বন্যপ্রাণীর ডিম। যাতে ব্যাহত হচ্ছে বণ্যপ্রাণীর বংশবিস্তার। উজান থেকে মিঠা পানির প্রবাহ না থাকায় মিঠা পানির স্বল্পতা দেখা দিচ্ছে।
সুন্দরবনের প্রাণপ্রকৃতি রক্ষায় সুন্দরবন থেকে পর্যটকদের চাপ কমানো, আশপাশে শিল্প কারখানা নির্মাণ বন্ধ করা, অভয়ারণ্য এলাকায় বনজীবীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা, বনজীবীদের বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা এবং বণ্যপ্রাণী শিকারি, কাঠপাচারকারী ও বনে আগুন দিয়ে সম্পদ লুটকারীদের দমন করা প্রয়োজন বলেও জানায় বন বিভাগ।
অভিজ্ঞমহল মনে করেন, ‘সুন্দরবন আমাদের সম্পদ। একে রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের। সুন্দরবন না বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে না, এই সম্পর্কে সন্দেহের অবকাশ নেই। ম্যানগ্রোভ বেঁচে থাকলে, তা শক্তিশালী দেয়াল হয়ে দাঁড়াতে পারবে ঘূর্ণিঝড়ের সামনে। এছাড়া পরিবেশকে সুরক্ষিত রাখতে এই বনকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। এজন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
‘একসময় এ বনে বাস করত ৪০০ প্রজাতির পাখি। কমতে কমতে এখন দাঁড়িয়েছে ২৭০ প্রজাতিতে। বিলুপ্ত হয়েছে ১৩০ প্রজাতির পাখি। পানিবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাড়ছে সাগর-নদীর পানির উচ্চতা ও লবণাক্ততা। তাই কমে যাচ্ছে কম লবণসহিষ্ণু সুন্দরীসহ অন্যান্য গাছ, কমছে বন্যপ্রাণীর বিচরণ ক্ষেত্রও।’
‘বাংলাদেশ অংশে সুন্দরবনের প্রায় ছয় হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এক হাজার ৮৭৪ বর্গকিলোমিটার পানিভাগ। এ বিস্তীর্ণ নদী ও খালে রয়েছে ১২০ প্রজাতির মাছ। জাহাজের প্রপেলারের আঘাতে ডলফিনের মৃত্যু ঘটছে প্রতিনিয়ত। এ ছাড়া রাতে চলাচলের সময় টর্চ লাইটের তীব্র আলো ও শব্দে হরিণ এবং নিশাচর প্রাণীসহ সুন্দরবনের পশু-পাখির জীবনচক্রের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে। কমছে সুন্দরবনের আয়তন ও
২০২০ সালে বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ১৯০৪-২৪ সালে সুন্দরবনের আয়তন ছিল ১১ হাজার ৯০৪ বর্গকিলোমিটার। ১৯৬৭ সালে তা কমে হয় ১১ হাজার ৬৬৩ বর্গকিলোমিটার। ২০২১ সালে আয়তন কমে দাঁড়ায় ১১ হাজার ৫০৬ বর্গকিলোমিটারে। ২০১৫-১৬ সালে আয়তন ছিল ১১ হাজার ৫০৬ বর্গকিলোমিটার। অর্থাৎ গত ১০০ বছরে সুন্দরবনের আয়তন ৪৫১ বর্গকিলোমিটার কমে গেছে।
জীববৈচিত্রের জন্যও সুন্দরবন অনন্য। বিশ্বব্যাংকের এই প্রতিবেদন অনুযায়ী, বনে ৫২৮ প্রজাতির বৃক্ষ ও লতাগুল্ম রয়েছে, রয়েছে ৩০০ প্রজাতির পাখি। ৫৮ প্রজাতির সরীসৃপ, ৪২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী এবং ৯ প্রজাতির উভচর প্রাণী সুন্দরবনে চড়ে বেড়ায়। সুন্দরবনের নদী-খালে ২৫০ প্রজাতির মাছ, বহু প্রজাতির কীটপতঙ্গ, কাঁকড়া, শামুক-ঝিনুক রয়েছে। রয়েছে নানা ধরনের ছত্রাক, শেওলা।
সম্প্রতি আন্তর্জাতিক এক গবেষণায় সুন্দরবন সংলগ্ন নদ-নদীতে ১৭ প্রজাতির মাছের দেহে মাইক্রো প্লাস্টিক পাওয়া গেছে। এসব মাছ খেলে মানুষের লিভার ক্ষতিগ্রস্ত হয়, আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা আছে প্রাণঘাতী ক্যানসারের।
অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি ও বন বিভাগের অসৎ কর্মকর্তাদের যোগসাজশে প্রতিনিয়ত সুন্দরবনের গাছ চুরি, অভয়াশ্রমে বিষ দিয়ে শিকার, বন্যপ্রাণী শিকার ইত্যাদি ধ্বংসাত্মক কর্মকা- পরিচালিত হচ্ছে।
প্রকৃতি সংরক্ষণ-বিষয়ক সংস্থাগুলোর আন্তর্জাতিক জোট আইইউসিএন, বাংলাদেশের একাধিক প্রতিবেদনে বিশ্বের অন্যতম জীববৈচিত্র্যপূর্ণ এলাকা হিসেবে সুন্দরবনের কথা বলা হয়েছে। প্রকৃতি ও বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞরা সুন্দরবনের সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্য সৃষ্টির প্রধান কারণ হিসেবে এর সৃষ্টিপ্রক্রিয়া ও ভৌগোলিক অবস্থানের কথা বলেছেন।
পর্যবেক্ষক মহল জানান, ‘এক দশকে বিশ্বের প্রাকৃতিক বিস্ময়াবলির অন্যতম সুন্দরবনের আয়তন অন্তত অর্ধেক কমে গেছে। এভাবে বন কমতে থাকার বিষয়টি উদ্বেগজনক। সুন্দরবনের পানিধার কমেছে। ২০১০ সালে যেখানে ছিল ৪৪৮ হেক্টর, ২০২০ সালে তা ৩২২ হেক্টরে এসে দাঁড়িয়েছে। কাঁকড়া বিচরণস্থল ৩ হাজার ১১৫ হেক্টরে থেকে কমে ১ হাজার ৬৩৪ হেক্টরে নেমে এসেছে। সুপার সাইক্লোন সিডরের আঘাতে সুন্দরবনের ১০ শতাংশ সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ‘বনের বাংলাদেশ অংশে জীববৈচিত্র্যের হটস্পট রয়েছে। আমরা ২০৩০ সালের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে কাজ করছি। এজন্য আমরা স্থানীয় লোকজনকে বন ব্যবস্থাপনায় সহযোগী হিসেবে গড়ে তুলছি। কুনমিং-মনট্রিল প্রোটোকল অর্জনে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সক্রিয় অংশগ্রহণ জরুরি।’
সুন্দরবনকে বাঁচাতে হলে প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে সমাধান খুঁজতে হবে। সুন্দরবনে পরিকল্পিতভাবে গোলপাতার গাছ রোপণ করে বড় হওয়ার সুযোগ দিতে হবে। এখানকার জেলেরা যেন নিয়ম মেনে মাছ ধরেন সেটাও নিশ্চিত করতে হবে। সব ধরনের মাছ ধরা যাবে না। যে মাছগুলো বিপন্ন সেগুলো ধরা থেকে জেলেদের বিরত রাখতে হবে। আর জেলেদের জালের ব্যবহারের ক্ষেত্রেও নিয়ম মেনে চলতে হবে।
পানিবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সুন্দরবনের মধ্যে নদীগুলোর পানির উচ্চতা বাড়ছে উদ্বেগজনক হারে। বিশ্বব্যাংকের ২০১৫ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই বৃদ্ধির হার বছরে ৩ থেকে ৮ মিলিমিটার। ইতিপূর্বে এ বন থেকে গ-ার, বনমহিষ, মিঠাপানির কুমির, এক প্রজাতির হরিণ, চিতা বাঘ ও ৪ প্রজাতির পাখি বিলুপ্ত হয়েছে। বিলুপ্ত হতে চলেছে ১৯ প্রকার মাছ।
দেশের জাতীয় অর্থনীতিতেও সুন্দরবনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এটি দেশের বনজ সম্পদের একক বৃহত্তম উৎস। এ বন কাঠের ওপর নির্ভরশীল শিল্পে কাঁচামাল জোগান দেয়। এছাড়া কাঠ, জ্বালানি ও ম-ের মতো প্রথাগত বনজ সম্পদের পাশাপাশি সুন্দরবন থেকে ঘর ছাওয়ার পাতা, মধু, মৌচাকের মোম, মাছ, কাঁকড়া ও শামুক-ঝিনুক ব্যাপকভাবে আহরণ করা হয়। বৃক্ষপূর্ণ সুন্দরবনের ভূমি একই সঙ্গে প্রয়োজনীয় আবাসস্থল, পুষ্টি উৎপাদক, পানি বিশুদ্ধকারক, পলি সঞ্চয়কারী, ঝড় প্রতিরোধক, উপকূল স্থিতিকারী, শক্তি সম্পদের আধার এবং পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গণ্য হয়ে থাকে।
ঘূর্ণিঝড়ের আঘাত থেকে দেশকে রক্ষা করতে প্রাকৃতিক প্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সুন্দরবন। সিডর, আইলা, ফণী, আম্ফান, বুলবুলসহ ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলায় ম্যানগ্রোভের প্রাচীর কতটা শক্তিশালী, তা সুন্দরবন বারবার জানান দিয়েছে। তবে প্রাকৃতিক দুর্যোগের পাশাপাশি মানবসৃষ্ট আঘাত পেতে পেতে এখন সুন্দরবন নিজেই বিপদের মুখে পড়েছে। এজন্য দেশের স্বার্থেই সুন্দরবনকে রক্ষা করতে হবে। সুন্দরবন হুমকির মুখে পড়লে বাংলাদেশের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে যাবে।
২০১৯ সালের ডিসেম্বরে জাতিসঙ্ঘের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান ইউনেস্কোর পক্ষ থেকে সুন্দরবনের জন্য ১০টি হুমকি চিহ্নিত করা হয়েছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাওয়া, দূষণ, অবৈধ তৎপরতা ও পশুর নদের খননকে অন্যতম চ্যালেঞ্জ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে
সুন্দরবনের মধ্যে ছোট-বড় অসংখ্য নদী ও খাল রয়েছে। এসব নদী-খাল দিনে দুবার জোয়ারের পানিতে ভরে যায়, আবার দুবারের ভাটায় পানি নেমে যায়। জোয়ার-ভাটার কারণে নদীর পাড় ভাঙে আবার গড়ে। তবে গত ১০০ বছরে দেখা গেছে, ভাঙনই বেশি, যা আজও ঠেকানো যায়নি।
সুন্দরবনের আয়তন দিন দিন কমে যাচ্ছে। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সুন্দরবনের প্রতিবেশ ব্যবস্থা। কমে আসছে গাছগালা, লতাগুল্ম ও প্রাণী। নানা প্রতিকূলতার মধ্যে সুন্দরবন দুর্বলও হয়ে পড়ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বনের ওপর আর নির্যাতন নয়, সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। তা না হলে এই বন এক সময় হারিয়ে যাবে, সেইসঙ্গে হুমকিতে পড়বে বাংলাদেশের অস্তিত্।
পৃথিবীর ফুসফুস বলা হয় আমাজন বনকে। আর বাংলাদেশের ফুসফুস বলা হয় সুন্দরবনকে। সুন্দরবন পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল। যা কিনা বিশ্বের বিস্ময়াবলির ঐতিহ্যের একটি অংশ। সুন্দরবন বাংলাদেশের খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট এবং দক্ষিণ-পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ চব্বিশ পরগনাজুড়ে বিস্তৃত। সুন্দবনের মোট আয়তন ১০,০০০ হাজার বর্গ কিলোমিটার। তার মধ্যে বাংলাদেশের অংশে পড়েছে প্রায় ৬২%-এর একটু বেশি
বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন যুগ যুগ ধরে উপকূলীয় মানুষের রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করছে। এই বন ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে উপকূলের মানুষকে আগলে রাখে।
সুন্দরবনের প্রতি এই ভালোবাসার স্বীকৃতি দিতে উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষ প্রতি বছর ১৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব ভালোবাসা দিবসকে ‘সুন্দরবন দিবস’ হিসেবে পালন করে আসছে। আজ পালিত হচ্ছে ২৫তম সুন্দরবন দিবস।
সুন্দরবনের ইমপ্যাক্ট জোন হিসেবে পরিচিত খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, পিরোজপুর ও বরগুনার ১৭টি উপজেলায় দিনব্যাপী নানা কর্মসূচি পালিত হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে সচেতনতামূলক শোভাযাত্রা, আলোচনা সভা, চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা, সাইকেল র্যালী, গণস্বাক্ষর অভিযান, মানববন্ধন, আলোকচিত্র প্রতিযোগিতা প্রভৃতি।
এই দিবসে এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় ‘বিশ্ব ভালোবাসা দিবসে সুন্দরবনকে ভালোবাসুন’।
সরকার সুন্দরবনের চারপাশের ১০ কিলোমিটার এলাকাকে ‘প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা’ (ইসিএ) ঘোষণা করলেও গত এক দশকে সেখানে গড়ে উঠেছে অন্তত ৬০টি ভারী শিল্পপ্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে রয়েছে সিমেন্ট কারখানা, এলপি গ্যাস প্লান্ট, অয়েল রিফাইনারি, খাদ্য গুদামসহ নানা স্থাপনা। এসব শিল্প-কারখানার বর্জ্য সুন্দরবনের পানি ও মাটিকে দূষিত করছে, যা জীববৈচিত্র্যের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কৃষি-শিল্প-পাট ও পরিবেশ রক্ষায় নাগরিক কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও পরিবেশ আন্দোলন কর্মী সুতপা বেদজ্ঞ বলেন, ‘সুন্দরবনে বিষ দিয়ে যারা মাছ শিকার করছে, তাদের দ্রুত আইনের আওতায় আনা প্রয়োজন। খুলনায় একটি পরিবেশ আদালত স্থাপন করতে হবে এবং পরিবেশবান্ধব পর্যটন নিশ্চিত করতে হবে। এ ছাড়া, সুন্দরবন রক্ষার গুরুত্ব বোঝাতে জাতীয়ভাবে “সুন্দরবন দিবস” ঘোষণা করা জরুরি।’
তিনি বলেন, ‘শুধু সচেতনতা নয়, কার্যকর আইন প্রয়োগ, পরিবেশবান্ধব পর্যটন, দখল ও দূষণ নিয়ন্ত্রণ এবং বন সংরক্ষণে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। তাহলেই সুন্দরবন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য টিকে থাকবে।’
গত কয়েক বছরে সুন্দরবনে পর্যটকদের আনাগোনা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। পর্যটন ব্যবসায়ীরা তাই এ খাতে বিনিয়োগ করছেন। গত ছয়-সাত বছরে বিলাসবহুল ২৯টি নতুন নৌযান যুক্ত হয়েছে, যার মধ্যে কয়েকটিতে সুইমিংপুলসহ তিন তারকা মানের সুবিধাও রয়েছে। পর্যটন ব্যবসায়ীদের তথ্য মতে, সুন্দরবনের পর্যটনে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন তারা।
সরকারিভাবে ২০১৪ সালে সুন্দরবন ভ্রমণ নীতিমালা প্রণয়ন করা হলেও তা মানা হচ্ছে না। এখন পর্যটন মৌসুমে প্রতিদিন গড়ে ৩০টির বেশি নৌযান সুন্দরবনের অভয়ারণ্যে অবস্থান করে। প্রকৃতিবান্ধব পর্যটনের পরিবর্তে চলছে উচ্চ শব্দে সংগীত বাজানো ও পিকনিকের আয়োজন। এতে বন্যপ্রাণীগুলো আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ছে এবং তাদের স্বাভাবিক আবাসস্থল ধ্বংসের মুখে পড়ছে। এসব নৌযান আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত। প্রায় প্রত্যেকটিতে ২০ থেকে ২৫টির বেশি এসি রয়েছে। নিয়ম-নীতি না মেনে রাতে এসব জলযানে উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন লাইট ব্যবহার করা হয়, যা সুন্দরবনের প্রাণীকুলের স্বাস্থ্যসম্মত আবাসনে বিরূপ প্রভাব ফেলছে।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মো. ওয়াসিউল ইসলাম বলেন, ‘অভয়ারণ্যে যত্রতত্র প্রবেশ বন্ধ করা দরকার। নিয়ন্ত্রিত পর্যটন নিশ্চিত করা গেলে বন ও বন্যপ্রাণীর ওপর নেতিবাচক প্রভাব কমবে। নৌযানের ইঞ্জিনের শব্দ ও হাইড্রোলিক হর্ন বন্যপ্রাণীর ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে। জলযানের পাখার আঘাতে ডলফিন মারা পড়ছে, আর তেল ও রাসায়নিক বর্জ্যে দূষিত হচ্ছে বনের পানি ও মাটি।’
বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, পশুর নদসহ সুন্দরবনের প্রধান নদীগুলো দিয়ে প্রতিদিন ৩৪৫টি দেশি-বিদেশি জাহাজ চলাচল করে। গত ১০ বছরে এসব নদ-নদীতে অন্তত ২৬টি জাহাজডুবির ঘটনা ঘটেছে। যার ফলে ফার্নেস অয়েল, কয়লা, সারসহ বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ ছড়িয়ে পড়েছে পানিতে। এতে শুধু জলজ প্রাণীরাই নয়, পুরো বনপ্রকৃতির ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে।
সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা এজেডএম হাসানুর রহমান বলেন, ‘বন্যপ্রাণী ও বনজ সম্পদ পাচার রোধে নদী-খালগুলোর মুখে টহল জোরদার করা হয়েছে। এখন স্মার্ট প্যাট্রোলিং ব্যবস্থা চালু রয়েছে এবং বন অপরাধীদের ধরতে র্যাব, পুলিশ ও কোস্টগার্ড যৌথভাবে কাজ করছে।’

