ড. মো. আবু তাহের : হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাংলাদেশের স্থপতি ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম ও আন্দোলনে ধারাবাহিকভাবে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে ১১ বছর জেলে মানবেতর জীবন কাটিয়েছেন। সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য নিজে পাননি, পরিবারকেও দিতে পারেননি। তথাপি স্বাধীনতার লক্ষ্য থেকে একচুলও বিচ্যুত হননি। তিনি বাঙালির অনেক বছরের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিয়েছেন। স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টিতে অনবদ্য ভূমিকা রেখেছেন। এ জাতির জন্য একটি স্বাধীন ভূখণ্ড উপহার দিয়েছেন। তাই কোনো বাঙালির রাজনৈতিক পরিচয় যাই থাক না কেন, বঙ্গবন্ধুকে অসম্মান করতে পারে না কেউ। আর যাঁরা বঙ্গবন্ধুকে অসম্মান করে কাণ্ডজ্ঞানহীন বক্তব্য দেবে তারা অতীতের ন্যায় আগামীতেও ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হবে। এখনো সময় আছে, গর্বিত অতীতের আলোয় উজ্জীবিত হয়ে আগামীকে বিনির্মাণ করি সঠিক ইতিহাসের কল্যাণীয় ধারা। বঙ্গবন্ধুর প্রতি যথার্থ সম্মান প্রদর্শনের মাধ্যমে নিজেরাও সম্মানিতবোধ করি।
তৎকালীন বিশ্বনেতৃবৃন্দ বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিত্বের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। ফিদেল ক্যাস্ট্রো বলেন, ‘আমি হিমালয় দেখিনি তবে বঙ্গবন্ধুকে দেখেছি। বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিত্ব ও সাহস হিমালয়ের সমান।’ হেনরি কিসিঞ্জার বলেন, ‘শেখ মুজিবের মতো তেজী ও গতিময় নেতা এশিয়া মহাদেশে আগামী কয়েকশ’ বছরে আর জন্ম নেবে না।’ অথচ ভাবতেও অবাক লাগে, যে স্বাধীনতার জন্য বঙ্গবন্ধু নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছেন, যে পাকিস্তানের কারাগার বঙ্গবন্ধুকে আটকে রাখতে পারেনি, মৃত্যুদণ্ড দিয়েও কার্যকর করতে সাহস পায়নি, অথচ তাঁর স্বপ্নের স্বাধীন দেশে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের কারণে মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট স্বাধীনতার মহান নায়ক বঙ্গবন্ধুকে নিজ বাসভবনে সপরিবারে হত্যা করা হলো।
এ বেদনাবিধুর ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত সহকারী আ. ফ. ম.মুহিতুল ইসলাম। ২০১৪ সালে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে ডেপুটেশনে ট্রেজারার হিসেবে কর্মরত অবস্থায় জাতীয় শোক দিবসের অনুষ্ঠানে জনাব মুহিতুলকে প্রধান অতিথি হিসেবে আমরা আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম। আমাদের আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে তিনি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাতের ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে প্রায় এক ঘণ্টা বক্তব্য রেখেছিলেন। মুহিতুল সাহসী মানুষ। তিনি বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার চেয়ে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট লালবাগ থানায় মামলা করার সুযোগ না পেলেও দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে ২ অক্টোবর মামলা দায়ের করার সুযোগ পান। যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ায় খুনিদের বিচার হয়েছে। ইতোমধ্যে ৬ জনের সাজা কার্যকর হয়েছে এবং আরও ৫ জন খুনি পলাতক রয়েছে।
খুনিরা যেখানেই থাকুক না কেন, তাদের ধরে নিয়ে এসে অনতিবিলম্বে সাজা কার্যকর করার জন্য বর্তমান সরকারের কাছে জোর দাবি জানাই। আরও একটি কথা মনে রাখতে হবে, এটি একটি নিছক হত্যাকাণ্ড নয়। এ হত্যাকা-ের পিছনে যারা ষড়যন্ত্র ও মদদ যুগিয়েছে, তাদের মুখোশ উন্মোচনের জন্য একটি উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিশন গঠন এখন সময়ের দাবি। তাহলে বাঙালি জাতির বুকভাঙ্গা দীর্ঘদিনের দুঃখ-বেদনার কিছুটা হলেও অবসান ঘটবে।
ঋঁষনৎরমযঃ ঋবষষড়ংিযরঢ় নিয়ে যখন টঝঅ- এর ঞবীধং অ ্ গ টহরাবৎংরঃু-তে আমি যখন পড়তে গেলাম, তখন আমার সুপারভাইজার চৎড়ভ. এধৎু গপষবধহ এবং বিভাগীয় প্রধান চৎড়ভ. ঋ.গ. ঘধভঁশযড় একটি গাড়ি করে বিশাল বিশ্ববিদ্যালয়টি ঘুরে দেখান। এক পর্যায়ে তারা আমাকে এবড়ৎমব ইঁংয ঈবহঃৎধষ খরনৎধৎু-এর ঐধষষ ড়ভ ঋধসব- এ নিয়ে বলেন, মি. তাহের, তুমি কি এই লোকটিকে চেনো। উত্তরে বললাম, চিনি। তিনি বাঙালি জাতির পিতা। পরের প্রশ্ন, কেন তাঁকে হত্যা করা হলো? উত্তরে বললাম, কিছু বিপথগামী সেনা কর্মকর্তা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে। তবে হত্যাকারীদের কেন তৎকালীন সরকার কর্তৃক পুরস্কৃত করা হলো? বিষয়টি সেখানে আমি বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছি। ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি, বিজয়ের আনন্দ ক্ষণস্থায়ী; আর পরাজয়ের গ্লানি দীর্ঘস্থায়ী। বাঙালি জাতিকে আজীবন এ কলংকের তিলক ও গ্লানি বহন করে যেতে হবে।
বঙ্গবন্ধু যেমন ছিলেন সহজ সরল দৃঢ়চেতা, তেমনি তাঁর রাজনৈতিক দর্শন ছিল অত্যন্ত সাদামাটা। তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, ‘কারাগারের রোজনামচা’ ও ‘আমার দেখা নয়া চীন’ পড়লে তা সহজেই বোঝা যায়। আরও একটি বিষয় পৃথিবীর কোনো রাজনৈতিক নেতাকে নিয়ে এত বই, প্রবন্ধ, গল্প ও কবিতা প্রকাশিত হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই। এমনকি কোনো রাজনৈতিক নেতাকে নিয়ে গোয়েন্দা সংস্থার এত নজরদারিও ছিল না। পাকিস্তানের ইন্টালিজেন্স ব্রাঞ্জ ১৯৪৮-৭০ পর্যন্ত প্রতি মুহূর্ত বঙ্গবন্ধুর সামগ্রিক কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ করত এবং তা সঙ্গে সঙ্গে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অবহিত করা হতো। এ ফাইলটির নম্বর ছিলো চ. ঋ. (চবৎংড়হধষ ঋরষব) ৬০৬-৪৮।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ফাইলগুলো সংগ্রহ করা হয় এবং ফটোকপি করে ডকুমেন্টগুলো গোয়েন্দা সংস্থার নিকট ফেরত দেওয়া হয়। ডকুমেন্টগুলো গোপনীয় দলিল হওয়ায় তা পরে উব-পষধংংরভরবফ করা হয়। বর্তমানে গোয়েন্দা সংস্থার হুবহু ডকুমেন্টগুলো ‘ঝবপৎবঃ উড়পঁসবহঃং ড়ভ ওহঃবষষরমবহপব ইৎধহপয ড়হ ঋধঃযবৎ ড়ভ ঃযব ঘধঃরড়হ ইধহমধনধহফযঁ ঝযবরশয গঁলরনঁৎ জধযসধহ’ শীর্ষক ১৪টি খণ্ডে প্রকাশিত হচ্ছে। মুখবন্ধে বঙ্গবন্ধু কন্যা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন-
‘বাংলাদেশের মানুষের অধিকার অর্জন, দেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলা এবং বাঙালি রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তি অর্জনের লক্ষ্যে অত্যন্ত সুনির্দিষ্ট কর্মপন্থা নিয়ে রাজনীতি করেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। তাঁর কৌশলী পদক্ষেপের কারণেই বাংলাদেশ আজ স্বাধীন-স্বার্বভৌম রাষ্ট্র। বাঙালি জাতির অধিকার আদায়ের সংগ্রামে তিনি কখনো আপোস করেননি। একটি জনগোষ্ঠীকে স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে সংগ্রাম, অসহযোগ আন্দোলন এবং সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বিজয় এনে দিয়েছেন। জাতি হিসেবে বাঙালি বিশ্ব দরবারে মর্যাদা পেয়েছে, স্বাধীন জাতি রাষ্ট্র অর্জন করেছে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট যদি বাঙালি জাতির জীবনে কালো দিবসটি না আসত তবে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা অর্জনের দশ বছরের মধ্যে বাংলাদেশকে ক্ষুধামুক্ত-দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে দিয়ে যেতেন। বাংলাদেশের মানুষ সুখে শান্তিতে বসবাস করতো। বিশ্বসভায় মাথা উঁচু করে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হতো। বাঙালির অধিকারের কথা বলতে গিয়েই বারবার নির্যাতন ভোগ করেছেন। আর বাঙালির বিজয় মেনে নিতে পারেনি বলে হত্যা করে পরাজয়ের প্রতিশোধ নিয়েছে পাকিস্তানপ্রেমীরা। তারা বাঙালির অগ্রযাত্রাকে অনেকাংশে ব্যাহত করেছে।’
মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জাতীয় জীবনের শ্রেষ্ঠ অর্জন ও অহংকার। দুর্ভাগ্যের বিষয়, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু ও তাঁর বিশ্বস্ত ৪ সহকর্মী জাতীয় নেতা সকলেই শহীদ হয়েছেন। কিন্তু স্বাধীনতার মাধ্যমে অর্জিত মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনাগুলো স্বাধীনতা ও বাঙালির সেকুলার অস্তিত্বের শত্রুপক্ষ আজও ধ্বংস করতে পারেনি। তারা একের পর এক হত্যাকা- চালিয়ে স্বাধীনতার মূল স্তম্ভগুলোকে ভেঙে ফেলে বাংলাদেশকে আবারও পাকিস্তান/তালেবাদ রাষ্ট্র বানাতে চেয়েছে। সাময়িক সাফল্য শত্রুপক্ষ অর্জন করলেও চূড়ান্ত সংগ্রামে তারা পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে। বর্তমানে তারা স্বাধীনতার মিত্রের মুখোশ ধারণ করে পুনরায় মানুষের মধ্যে গুজব ও বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে জনগণকে দ্বিধাবিভক্ত করার চেষ্টা চালাচ্ছে। তাই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সকল রাজনৈতিক দল, মত ও জনগণকে আগামীতে আরও সতর্ক থাকতে হবে।
সঙ্গে সঙ্গে আজকের শোককে শক্তিতে পরিণত করে বঙ্গবন্ধুর আরদ্ধ সাধনা অসাম্প্রদায়িক, ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠাসহ গরিব-দুঃখী মানুষের আর্থ-সামাজিক মুক্তির লক্ষ্যে যে কোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য সর্বোচ্চ সততা, নিষ্ঠা, আন্তরিকতা ও দেশপ্রেমের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে যেতে হবে। এ সংগ্রামে সারথী হিসেবে পেয়েছি আমরা বঙ্গবন্ধু কন্যা দেশরত্ন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে, যাঁর দূরদর্শী নেতৃত্বে বর্তমানে যে অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রা অব্যাহত রয়েছে, তা পৃথিবীর কোনো শক্তি আর থামাতে পারবে না। জয় আমাদের সুনিশ্চিত।
বঙ্গবন্ধু চলে গেছেন বহুদূরে। রেখে গেছেন তাঁর অমর সৃষ্টি স্বাধীন, স্বার্বভৌম ও মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ। আর কেউ কোনোদিন বঙ্গবন্ধুও হতে পারবে না। বাঙালির হৃদয়ে বঙ্গবন্ধু ছিলেন-আছেন-থাকবেন অনন্তকাল। যতদিন এ বাংলায় চন্দ্র সূর্য উদয় হবে, যতদিন এ জনপদে পাখির কলরব থাকবে, নদীর কলতান থাকবে, সাগরের গর্জন থাকবে, বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশ নামে দেশ থাকবে, ততদিন বেঁচে থাকবেন বঙ্গবন্ধুও।
লেখক : অধ্যাপক ও সদস্য
বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন