বেনাপোল : বেনাপোল-পেট্রাপোল নোম্যান্সল্যান্ডে বসেছে দুই বাংলার হাজার হাজার ভাষা প্রেমীদের মিলন মেলা। দুই বাংলার মানুষের ভাষা এক ভৌগলিক সীমারেখা ভুলে কেবলমাত্র ভাষার টানে দুই বাংলার মানুষ একই মঞ্চে তুলে ধরলেন বাংলা ভাষার জয়গান। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপন উপলে বেনাপোল আন্তর্জাতিক চেকপোস্ট নোম্যান্সল্যান্ডে মঙ্গলবার সকাল ১১ টা থেকে দুপুর পর্যন্ত এভাবেই কাটালেন দু‘দেশের বাংলা ভাষাপ্রেমী মানুষ। আমরা বাংলা ভাষায় কথা বলি বলে বাংলাদেশের মানুষের জন্য আমাদের প্রাণ কাঁদে। তাই তো বারবার ছুটে আসি বেনাপোল-পেট্রাপোল নোম্যান্সল্যান্ডে বাংলা ভাষা-ভাষী মানুষের পাশে। মৃর্তৃভাষা দিবস মিলিয়ে দিলো দু‘দেশের ভাষা প্রেমী মানুষদের। ভাষার টানে শহীদদের প্রতি সম্মিলিত শ্রদ্ধা জানালো ভারত-বাংলাদেশের নের্তৃবৃন্দ। ফুলে ফুলে ভরে গেলো সীমান্তের নোম্যান্সল্যান্ডে নির্মিত অস্থায়ী শহীদ বেদি। বেনাপোল চেকপোস্ট নোম্যান্সল্যান্ডে স্থাপিত অস্থায়ী শহীদ মিনারে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণের মধ্যদিয়ে প্রতি বছরের মতো এবারো ভাষা শহীদদের স্মৃতির প্রতি সম্মান জানানো হলো। মিষ্টি বিতরণ, আলোচনা আর গানে গানে মাতোয়ারা হলো দুই বাংলার একই আকাশ একই বাতাস। উভয় দেশের জনপ্রতিনিধিরা বলেন, সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির কথা। এ অনুষ্ঠানকে ঘিরে জড়ো হয়েছিল দু-দেশের হাজার হাজার ভাষাপ্রেমী মানুষ। উভয় দেশের বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো শতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নেয় এ অনুষ্ঠানে। দু‘দেশের জাতীয় পতাকা, নানা রং এর ফেস্টুন, ব্যানার, প্লেকার্ড, আর ফুল দিয়ে বর্ণিল সাজে সাজানো হয় নোম্যান্সল্যান্ড এলাকা। প্রতি বছর দুই বাংলার সীমান্তবর্তী মানুষেরা এক সঙ্গে মিলিত হয়ে দিবসটি মনের মাধুরি দিয়ে পালন করে আসছে। দু‘দেশেরঅধিবাসিদের মধ্যে আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়। একে অপরকে আলিঙ্গন করে সকল ভেদাভেদ যেন ভুলে যায় কিছু সময়ের জন্য। ফুলের মালা, মিস্টি ও জাতীয় পতাকা বিনিময় করে উভয় দেশের আবেগপ্রবণ অনেক মানুষ। বাঙালীর নাড়ির টানে একে অণ্য কে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলেন। দুই বাংলার মানুষের মাঝে বসে এক মিলন মেলা। এ সময় বেনাপোল-পেট্রাপোল চেকপোস্টে ঢল নামে হাজার হাজার মানুষের। ক্ষণিকের জন্য হলেও স্তব্ধ হয়ে যায় আন্তর্জাতিক সীমারেখা। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের, বিধায়ক শ্রী বিনা মন্ডল, বিধায়ক শ্রী বিশ^ জিৎ দাস, বনগাঁ পৌর প্রধান শ্রী গোপাল শেড, সাবেক সাংসদ মামতা ঠাকুরের নেতৃত্বে ভারত থেকে আসা শতশত বাংলা ভাষী মানুষদের ফুলের পাঁপড়ি ছিটিয়ে ও মিষ্টি বিতরণ করে বরণ করে নেয় একে অপরকে। নোমান্সল্যান্ডে অস্থায়ী শহীদ বেদীতে প্রথম ফুল দিয়ে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান উভয় দেশের জনপ্রতিনিধিসহ সরকারি কর্মকর্তারা। অনুষ্টানে প্রধান অতিথি স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্রাচার্য্য, বিশেষ অতিথি যশোর-১ আসনের সংসদ সদস্য শেখ আফিল উদ্দিন, বেনাপোল কাস্টমস কমিশনার আব্দুল হাকিম, জেলা প্রশাসক তাজিমুল ইসলাম খান, ৪৯ ব্যাটালিয়ন বিজিবির জি-আর্টিলারি পরিচালক লে. কর্নেল আহম্মেদ হাসান জামিল, জেলা পুলিশ সুপার প্রলয় কুমার জোয়াদ্দার, বেনাপোল বন্দরের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক আবদুল জলিল, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নারায়ন চন্দ্র পাল, নাভরণ সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার নিশাত আল নাহিয়ান ও ২১ উদযাপন কমিটির সভাপতি শার্শা উপজেলা চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল হক মঞ্জু ও সচিব শার্শা উপজেলা আওয়ামীলীগের যুগ্ন সাধারন সম্পাদক অধ্যক্ষ ইব্রাহিম খলিল, অনুষ্ঠানে উভয় দেশের বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো অংশ নেয়। দুই দেশের জাতীয় পতাকা উড়িয়ে হাজার হাজার ভাষাপ্রেমী মানুষ দিবসটি উদযাপন করে যৌথভাবে। এসময় ভাষার টানে বাঙালির বাঁধন হারা আবেগের কাছে মিলে মিশে একাকার হয়ে যায় দুই বাংলার মানুষ। উভয় দেশের মধ্যকার সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পকের্র ভিত্তি এখনো যে অটুট রয়েছে তাই বোঝা গেল অনুষ্ঠানে উপস্থিত দুই বাংলার অতিথিদের বক্তব্যে। ৫২-এর ভাষা আন্দোলন ও ৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের অবদানের কথা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে বক্তারা বলেন, এদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গণতন্ত্র বিকশিত হতে শুরু করেছে। জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদ আজ মাথা চড়া দিয়ে উঠেছে। দুই দেশের নেতৃত্বে এই জঙ্গিবাদ সন্ত্রাসবাদ নির্মূল করা হবে। তাদের ভাষা ও ভাষা শহীদদের আত্মত্যাগ আমাদের দুই দেশের মধ্যে উপস্থিত সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের ভিত কে আরো শক্ত করবে। একুশের মঞ্চে কবিতা আবৃতি, ছড়া, গীতিনাট্য, আলোচনা আর সংগীতানুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানে দুই বাংলার গুনি শিল্পীরা ২১ এর সংগীত পরিবেশন ও আবৃতি করেন। ভাষা শহীদদের স্মরণে দুই বাংলার মানুষের সম্পীতি আর ভালোবাসার বাধনকে আরো সুদৃঢ় করার প্রত্যয় নিয়ে শেষ হয় ভাষা প্রেমিদের মিলন মেলা। এঅনুষ্টানকে ঘিরে উভয় দেশের প্রশাসনের পক্ষ থেকে সীমান্তে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়। বিজিবি ও বিএসএফ অতিরিক্ত সন্য মোতায়েন করে। সীমান্ত টপকে যাতে কেউ অবৈধভাবে প্রবেশ করতে না পারে সে জন্য বিজিবি ও বিএসএফ বাঁশের বেষ্টনি দিয়ে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তোলে। ২০০২ সাল থেকে দেশের সর্ববৃহৎ স্থলবন্দর বেনাপোল চেকপোস্টের নোমান্সল্যান্ডে মাতৃভাষা দিবস পালন করে আসছে দুই বাংলার ভাষাপ্রেমী মানুষ। বনগাঁ পৌর প্রধান শ্রী গোপাল শেড বলেন, আপনারা ভাষার জন্য জীবন দিয়েছেন। স্বাধীনতার জন্য অকাতরে জীবন বিলিয়ে দিয়েছেন। ভাষা আর স্বাধীনতার জন্য এতো ত্যাগের নজির পৃথিবীতে অন্য কোনো দেশে নেই। এ জন্য আপনারা গর্বিত জাতি। ভাষার টানে আমরা বাংলাদেশে ছুটে এসেছি একুশ উদযাপন করতে। দুই বাংলার মানুষের মিলন মেলার মধ্যদিয়ে দুই দেশের বন্ধুত্ব আরো সুদৃঢ় হবে। আমার এসেছি অন্তরের টানে। বার বার ছুটে আসি। দেশ বিভক্তি হলেও ভাষার পরিবর্তন হয়নি। আমরা ওপারে থাকলেও শহীদ সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার সহ সকল ভাষা সৈনিকের প্রতি আমরা শ্রদ্ধাশীল। পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী স্বপনভট্রাচার্য্য বলেন, ৫২ এর ভাষা সংগ্রামের পথ ধরেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা এসেছে। আর এই স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারতের জনগণ ও সরকার আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিল। স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের সঙ্গে আমাদের আত্মার সম্পর্ক, নাড়ির সম্পর্ক। সে জন্য আমরা তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ। ১৯৪৮ সাল থেকে শুরু হয়েছে আমাদের এই ভাষা আন্দোলন।
