জন্মভূমি ডেস্ক : ভারতের আগরতলায় বাংলাদেশ সহকারী হাইকমিশনে হামলার ঘটনায় তীব্র ক্ষোভ ও বিক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। হিন্দু সংঘর্ষ সমিতির ব্যানারে কয়েকশ বিক্ষোভকারী বাংলাদেশি পতাকা নামিয়ে ছিঁড়ে ফেলেছে এবং হাইকমিশনের সাইনবোর্ডে আগুন দিয়েছে। এ হামলার প্রতিবাদে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এক রাতে বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। সীমান্ত এলাকায় ভারতীয় বিক্ষোভকারীরা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে, পণ্য পুড়িয়ে এবং আমদানি-রফতানি বন্ধ করে দেয়। বাংলাদেশ সরকার হামলাটিকে দুঃখজনক বলে উল্লেখ করলেও, ভারত এখনও এ ঘটনায় দায়ীদের বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের ঘোষণা দেয়নি।
বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশন একটি সার্বভৌম সম্পদ এবং ভিয়েনা সনদ অনুযায়ী ভারতকে এই প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা দিতে বাধ্য। গতকাল ভারতীয় আগরতলায় বাংলাদেশ সহকারী হাইকমিশনে হামলা হয়েছে, যা দক্ষিণ এশিয়ায় গত পাঁচ দশকের মধ্যে প্রথম কোনো দেশের কূটনৈতিক স্থাপনায় হামলার ঘটনা। হামলার পরেও বাংলাদেশে ভারতীয় কূটনৈতিক স্থাপনাগুলোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা বাড়ানো হয়েছে। খুলনায় বিক্ষোভের খবর পেয়ে পুলিশ ও সেনাবাহিনী ভারতীয় সহকারী হাইকমিশনের সামনে অবস্থান নেয়। এদিকে, পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভায় রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নিপীড়নের অভিযোগ তুলে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী মোতায়েনের দাবি জানিয়েছেন। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা, বিএনপি মহাসচিবসহ অন্যান্য রাজনৈতিক নেতারা তার এই বক্তব্যের প্রতিবাদ করেছেন। সরকার, বিএনপি, জামায়াতসহ প্রায় সব রাজনৈতিক দল এবং ছাত্র নেতৃত্ব হামলার প্রতিবাদ জানালেও, আওয়ামী লীগের প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর মমতার বক্তব্যকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
গতকাল শুধু আগরতলায় নয়, মুম্বাইয়ে বাংলাদেশের উপ-হাইকমিশনের সামনে বিক্ষোভ করেছে ভারতীয় বিশ্ব হিন্দু পরিষদ। একই দিনে, চট্টগ্রামে ভারতের উপ-হাইকমিশনে স্মারকলিপি প্রদান করেছে হেফাজতে ইসলাম, তবে তাদের কর্মসূচি ছিল শান্তিপূর্ণ।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ভারতীয় আগরতলায় বাংলাদেশ সহকারী হাইকমিশনে হামলার ঘটনায় তীব্র ক্ষোভ জানিয়েছে। একটি বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, হামলাটি ছিল পরিকল্পিত। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন এক ব্রিফিংয়ে বলেন, দেশ-বিদেশে সাম্প্রদায়িক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির চেষ্টা চলছে এবং ভারতের মিডিয়া সংখ্যালঘু ইস্যু নিয়ে অপপ্রচার চালাচ্ছে। তিনি আরও বলেন, যারা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করবে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
গুজব ছড়িয়ে হামলা
৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা ভারতে আশ্রয় নেওয়ার পর থেকেই বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের মধ্যে টানাপোড়েন শুরু হয়। জুলাই মাসে সংঘটিত গণহত্যায় হাজার হাজার প্রাণহানির জন্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দায়ী করেছে অন্তর্বর্তী সরকার, রাজনৈতিক ও ছাত্র নেতৃত্ব। শেখ হাসিনাকে দিল্লিতে আশ্রয় দেওয়ায় ভারতীয়দের মধ্যে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। ভারতের কিছু গণমাধ্যম ৫ আগস্টের পর বাংলাদেশের অভ্যুত্থানকে ‘ইসলামী চরমপন্থি’দের উত্থান হিসেবে আখ্যা দিয়েছে এবং বাংলাদেশের সংখ্যালঘু নিপীড়নকে অতিরঞ্জিত করে প্রচার করছে, যা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভুল তথ্য হিসেবে উঠে এসেছে।
গত ২৫ নভেম্বর বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে গ্রেফতার করা হয়। তার মুক্তি দাবিতে বিজেপি এবং তার অনুসারী সংগঠনগুলো প্রতিবাদ জানাচ্ছে এবং এটি তারা সংখ্যালঘু নিপীড়নের অংশ হিসেবে দেখছে। তাদের দাবি, ৫ আগস্টের পর শতশত হিন্দু নিহত হয়েছে, তবে বাংলাদেশের হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের মতে নিহতের সংখ্যা ৯। যদিও এ তালিকায় জুলাইয়ের অভ্যুত্থানে নিহত ব্যক্তিদের নাম রয়েছে। ফ্যাক্টচেকাররা জানিয়েছেন, একাধিক হত্যাকাণ্ডে সাম্প্রদায়িকতার কিছু যোগসূত্র পাওয়া গেছে।
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, চিন্ময় কৃষ্ণের মুক্তি দাবিতে ২ ডিসেম্বর আগরতলায় হিন্দু সংঘর্ষ সমিতি সমাবেশ করেছে। তারা বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনের সামনে একটি স্মারকলিপি দেওয়ার জন্য হাইকমিশন কার্যালয়ে যাওয়ার সময়, বাইরে থাকা গেরুয়া ঝান্ডাধারী কিছু যুবক হাইকমিশনে ঢুকে বাংলাদেশের পতাকা নামিয়ে ছিঁড়ে ফেলে এবং হাইকমিশনের সাইনবোর্ডে আগুন দেয়।
হামলার ভিডিওতে দেখা যায়, পতাকা নামানোর পর ত্রিপুরা পুলিশ হামলাকারীদের বের করার চেষ্টা করে, তবে কাউকে আটকাতে দেখা যায়নি। ঘটনাস্থলে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন, কিন্তু তারা নিষ্ক্রিয় ছিল। পরে ত্রিপুরা সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সহকারী হাইকমিশনে গিয়ে আশ্বস্ত করেন, এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে না।
এদিকে, গত শনিবার ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় শ্যামলী পরিবহনের একটি বাস দুর্ঘটনায় পড়ে। ত্রিপুরার পরিবহনমন্ত্রী ও ভারতের কিছু গণমাধ্যম একে হামলা বলে দাবি করলেও, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এসপি মোহাম্মদ জাবেদুর রহমান এবং বাস চালক আসাদুল হক নিশ্চিত করেছেন, এটি কোনো হামলা ছিল না। বাসটি একটি অটোভ্যানকে ধাক্কা দেয়, যার পর স্থানীয়দের সঙ্গে ভারতীয় যাত্রীদের কোনো ধরনের বাগ্বিতণ্ডা হয়নি।
ভারতীয় গণমাধ্যমের দাবি অনুযায়ী—ত্রিপুরার পরিবহনমন্ত্রী সুশান্ত চৌধুরী তার এক্স অ্যাকাউন্টে বাসটির ছবি পোস্ট করে লিখেছেন, একটি পণ্যবাহী ট্রাক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বাসটিকে ধাক্কা দিয়েছে এবং স্থানীয়রা ভারতীয় যাত্রীদের হুমকি দিয়েছে। টিভিনাইন সংবাদমাধ্যম “আর কত নামবে? বাংলাদেশে আক্রান্ত কলকাতাগামী বাস, ভারতীয়দের প্রাণে মেরে ফেলার হুমকি” শিরোনামে খবর প্রকাশ করে। এর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে আগরতলায় বাংলাদেশ সহকারী হাইকমিশনে হামলা হয়। এসব ঘটনার পর বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যে উত্তেজনা আরও বৃদ্ধি পায়, এবং পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে ওঠে।
ক্ষোভ-বিক্ষোভের এক রাত
ভারতের আগরতলায় অবস্থিত বাংলাদেশ সহকারী হাইকমিশনে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনার তীব্র প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। সোমবার (২ ডিসেম্বর) রাত সোয়া ৯টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে জড়ো হয়ে মিছিলটি বের করেন।
এ সময় শিক্ষার্থীরা নানা স্লোগান দিতে থাকেন, যেমন ‘গোলামী না আজাদি, আজাদি আজাদি’; ‘আপস না সংগ্রাম, সংগ্রাম সংগ্রাম’; ‘দিল্লী না ঢাকা, ঢাকা ঢাকা’; ‘ভারতীয় আগ্রাসন, রুখে দাও জনগণ’; ‘হাইকমিশনে/আগরতলায় হামলা কেন, দিল্লি তুই জবাব দে’; ‘দালালি না রাজপথ, রাজপথ রাজপথ’ ইত্যাদি।
বিক্ষোভ সমাবেশে শিক্ষার্থীরা বলেন, “ভারত আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ, তাদের সঙ্গে আমাদের কূটনৈতিক সম্পর্ক থাকবে এবং প্রতিবেশী হিসেবে ভালো সম্পর্ক থাকবে, কিন্তু তা কখনোই রাজা-প্রজার সম্পর্ক হতে পারে না।” তারা আরও দাবি করেন, “ভারতে অবস্থিত বাংলাদেশের হাইকমিশনে হামলার জন্য ভারতকে অবশ্যই ক্ষমা চাইতে হবে।”
তারা আরও বলেন, “ভারতকে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিতে চাই, এ দেশে আর আওয়ামী লীগের ক্ষমতা নেই। তাই তারা যেন আগের মতো করে আমাদের দেশে আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা না করে। দিল্লিকে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলতে চাই, শরীরে এক ফোঁটা রক্ত থাকলেও আমরা ভারতের আধিপত্য মেনে নেব না।” তারা দাবি করেন, “যেভাবে আমরা হাসিনাকে পালাতে বাধ্য করেছি, ঠিক সেভাবেই দিল্লির আগ্রাসনও রুখে দেব।”
একই ঘটনায় প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ করেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) শিক্ষার্থীরাও। সোমবার (২ ডিসেম্বর) রাত ১০টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে ঢাকা রাজশাহী মহাসড়ক অবরোধ করে এই কর্মসূচি পালন করে তারা।
এ সময় শিক্ষার্থীরা, ‘ভারতের দাদাগিরি, থুথু মারি থুথু মারি’, ‘ভারতের দালালেরা, হুঁশিয়ার সাবধান’, ‘আমার দেশের অপমান, সইবে না রে জনগণ’, ‘মোদির কালো হাত ভেঙে দাও গুড়িয়ে দাও’, ‘ভারতের দাদাগিরি’ চলবে না চলবে না’, ‘ভারতের বন্দিশালায়, লাথি মার ভাঙরে তালা’, ‘ভারতের তাল বাহানা, এই বাংলায় চলবে না’, ‘হিন্দু মুসলিম ভাই ভাই, দাঙ্গাবাজের ঠাঁই নাই’, ‘দূতাবাসে হামলা কেন, মোদি জবাব দে’, ‘ভারতের পণ্য, বয়কট বয়কট’ ইত্যাদি স্লোগান দেন।
রাত সোয়া ৯টার দিকে মশাল মিছিল করেছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) শিক্ষার্থীরা। মিছিলে শিক্ষার্থীদের ‘দিল্লি না ঢাকা, ঢাকা ঢাকা’, ‘ভারতীয় আগ্রাসন, ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও’, ‘দূতাবাসে হামলা কেন, মোদি তুই জবাব দে’, ‘তুমি কে আমি কে, বাংলাদেশ বাংলাদেশ’, ‘দালালি না রাজপথ, রাজপথ রাজপথ’, ‘মোদির দুই গালে, জুতা মারো তালে তালে’, ‘মমতার দুই গালে, জুতা মারো তালে তালে’ ইত্যাদি স্লোগান দিতে দেখা যায়।
সোমবার রাতে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) ভাস্কর্য চত্বরে এ বিক্ষোভ-পরবর্তী সমাবেশ করেন শিক্ষার্থীরা। এ সময় তারা ‘বাংলাদেশের অ্যাকশন, ডাইরেক্ট অ্যাকশন’, ‘আধিপত্যের বিরুদ্ধে, ডাইরেক্ট অ্যাকশন’, ‘দিয়েছি তো রক্ত, আরও দেবো রক্ত’ ইত্যাদি স্লোগান দেন।
বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশন প্রাঙ্গণে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনার প্রতিবাদে খুলনায় বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীরা। সোমবার (২ ডিসেম্বর) রাতে নগরীর শামসুর রহমান রোডে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেন তারা।
সমাবেশে বক্তারা বলেন, ভারতে বাংলাদেশের হাইকমিশনে হামলার প্রতিবাদে আমরা এখানে একত্রিত হয়েছি। দেশের বিরুদ্ধে সব ষড়যন্ত্র আমরা রুখে দেব। স্বৈরাচারের দালালরা আর কিছুই করতে পারবে না।
তারা আরও বলেন, ৫ আগস্টের পর পরিবর্তনশীল বাংলাদেশ গঠনে আমরা উদ্যোগ নিয়েছি। ছাত্র-জনতা আজ এক। দেশ ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে আমরা একত্রিত। আমরা সবাই হাতে-হাত রেখে লড়াই করব। আমরা আর কারও দাসত্ব করতে চাই না।
একই ঘটনার প্রতিবাদে চট্টগ্রাম নগরের বিক্ষোভ সমাবেশ ও মিছিল করেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রআন্দোলন। সোমবার (২ ডিসেম্বর) দিবাগত রাতে নগরের পাঁচলাইশ থানার ষোলশহর রেলওয়ে স্টেশন এলাকায় এ কর্মসূচি পালন করা হয়।
সমাবেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রআন্দোলন কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য রাসেল আহমেদ বলেন, মমতা ব্যানার্জি বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা রক্ষায় জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের সদস্য নিয়োজিত করা পরামর্শ দিয়েছেন। অথচ ভারত সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তায় ব্যর্থ হয়েছে। আগরতলায় বাংলাদেশের উপ-হাইকমিশনে হামলা করা হয়েছে। এটি কূটনৈতিক সম্পর্ক অবনতির নিকৃষ্ট উদাহরণ।
বাংলাদেশ সহকারী হাইকমিশনে হামলা ও পতাকা পোড়ানোর প্রতিবাদে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির ব্যানারে রংপুরে বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা। সমাবেশ থেকে ভারতীয় পণ্য ও মিডিয়া বর্জনের ডাক দেওয়ার পাশাপাশি ভারত ষড়যন্ত্র বন্ধ না করলে বাংলাদেশের সব ভারতীয় দূতাবাস বন্ধ করে দেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তারা।
সোমবার (২ ডিসেম্বর) রাতে প্রেসক্লাবের সামনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের রংপুর জেলা ও মহানগর কমিটি এবং বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদ সমাবেশ থেকে ভারতকে এ হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়।
উত্তাল সামাজিক মাধ্যম
বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি তীব্র উত্তেজনার মধ্যে রয়েছে। শেখ হাসিনার পতনের পর ভারত বাংলাদেশে তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ভারতীয় গণমাধ্যমে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডা প্রচারের মাধ্যমে দেশটির অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিষয়গুলোতে প্রভাব ফেলার চেষ্টা চলছে। বিশেষ করে, ৫ আগস্টের পর থেকে ভারতের কিছু মিডিয়া সংখ্যালঘু নিপীড়ন এবং বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক অস্থিতিশীলতা নিয়ে অতিরঞ্জিত প্রতিবেদন প্রকাশ করছে, যা দেশের জনগণের মধ্যে ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে।
এছাড়া, সামাজিক মাধ্যমেও এই বিষয়টি নিয়ে তীব্র আলোচনা চলছে। অনেকেই মনে করছেন, ভারতের এই ধরনের কার্যকলাপ বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের শামিল। নানা বিতর্কিত মন্তব্য এবং প্রতিবাদের মধ্যে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ এই পরিস্থিতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে। ফলে সামাজিক মাধ্যমের প্ল্যাটফর্মগুলোতে নানা ধরনের ক্ষোভের প্রকাশ ঘটছে।
দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব, বিশেষ করে বিরোধী দলগুলোও ভারতের এই আচরণের তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। তারা দাবি করছে, বাংলাদেশে ভারতের এই হস্তক্ষেপ শুধু রাজনৈতিক নয়, এটি দেশের নিরাপত্তা এবং জাতীয় স্বার্থের জন্য হুমকি সৃষ্টি করছে।
হাইকমিশনে হামলার ঘটনায় ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছেন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল। তিনি এই ঘটনাকে ‘ন্যক্কারজনক’ আখ্যা দিয়েছেন। ফেসবুক পোস্টে আইন উপদেষ্টা লিখেছেন– ভারতকে বলি, আমরা সমমর্যাদা আর সমানাধিকারভিত্তিক বন্ধুত্বে বিশ্বাসী। শেখ হাসিনার সরকার বিনা ভোটে ক্ষমতায় থাকার লোভে ভারত-তোষণ নীতিতে বিশ্বাসী ছিল। তবে ভারতকে বুঝতে হবে– এটা শেখ হাসিনার বাংলাদেশ নয়। এই বাংলাদেশ স্বাধীন, সার্বভৌম ও আত্মমর্যাদাশীল। এই বাংলাদেশ নির্ভীক একটি তরুণ সম্প্রদায়ের।
যুব ও ক্রীড়াবিষয়ক উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া রাত ১০টায় ফেসবুকে এক পোস্টে লিখেছেন– যদি ভারতের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বাংলাদেশ হাইকমিশনের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়, তাহলে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনীর সহায়তা চাইতে পারে। সে ক্ষেত্রে শান্তিরক্ষা মিশনে সৈন্য সহায়তা বাড়িয়ে সহযোগিতা করবে বাংলাদেশ।
এছাড়া সবশ্রেণি-পেশার মানুষ বিষয়টি নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে সোচ্ছার রয়েছেন। বেশির ভাগ মানুষকে ভারতের এমন কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করে পোস্ট করতে দেখা গেছে।
সীমান্তে বিশৃঙ্খলা, বাণিজ্য বন্ধের হুমকি
গতকাল বাংলাদেশের বিভিন্ন সীমান্তে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে ভারতীয়রা। অভিযোগ রয়েছে, বেশ কয়েকজন বিক্ষোভকারী শূন্যরেখা অতিক্রম করেছেন। পশ্চিমবঙ্গের বিরোধী দলের নেতা শুভেন্দু অধিকারীর নেতৃত্বে পেট্রাপোলে সীমান্তে একটি বিক্ষোভ সমাবেশ হয়। এরপর, তারা মিছিল করে জিরো পয়েন্টে এসে বাংলাদেশবিরোধী স্লোগান দেয়। শুভেন্দু অধিকারী বলেন, “পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী, সোমবার সকাল ৬টা থেকে মঙ্গলবার সকাল ৬টা পর্যন্ত কোনো পণ্যবাহী ট্রাক বাংলাদেশে প্রবেশ করতে পারবে না। এটি শুধু একটি সতর্কতা, পরে আমরা আগামী বছর পুরোপুরি বাণিজ্য বন্ধ করে দেব। তখন আমরা দেখাবো, বাংলাদেশ কীভাবে আলু ও পেঁয়াজ খাবে।”
এদিকে, সীমান্ত বন্ধের শঙ্কায় সোমবার সকালে অনেক মানুষ বাংলাদেশে ফিরে যেতে শুরু করে। ভারতের শ্রীভূমি (করিমগঞ্জের) সনাতনী ঐক্য মঞ্চের বিক্ষোভকারীরা শুল্ক স্টেশন বন্ধ করে দেয়, যার ফলে আমদানি-রফতানির সব ধরনের বাণিজ্যিক কার্যক্রম স্থগিত হয়ে যায়। সোমবার দুপুরে তারা “চল বাংলাদেশ” কর্মসূচির অংশ হিসেবে ভারতের শ্রীভূমি শুল্ক স্টেশন অবরোধ করে।
এর আগে, প্রায় ছয় টন কমলা আসার পর শুল্ক স্টেশন দিয়ে আমদানি-রফতানি বন্ধ হয়ে যায়। ব্যবসায়ীদের এলসি করা পণ্যবাহী গাড়ি দুই পার থেকে ফিরিয়ে নেয়া হয়, এ তথ্য নিশ্চিত করেন জকিগঞ্জ শুল্ক স্টেশনের রাজস্ব কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর হোসেন।
এছাড়া, সুতারকান্দি শুল্ক স্টেশন থেকে ভারতে রফতানি হওয়া আলু, কেকসহ কিছু পণ্য সনাতনী ঐক্য মঞ্চের সদস্যরা করিমগঞ্জে পুড়িয়ে ফেলেছে। তারা বাংলাদেশি পণ্য বর্জনের ঘোষণা দেয়।
ফেনীর পরশুরামের বিলোনিয়া স্থলবন্দরের ভারত অংশেও বাংলাদেশবিরোধী বিক্ষোভ হয়েছে। সেখানেও ভারতীয় নাগরিকরা বাংলাদেশ সরকার ও পণ্য বর্জনের স্লোগান দেয়। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) জানিয়েছে, ৫০ থেকে ৬০ জন ভারতীয় নাগরিক সীমান্তের ওপারে জড়ো হয়ে বিভিন্ন স্লোগান দেয়। তারা বাংলাদেশের বিদ্যুৎ ও ভারতীয় পণ্য রফতানি বন্ধের দাবি জানায়।
ভারত কী বলছে?
১৯৬১ সালের ভিয়েনা সনদ অনুযায়ী, বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশন একটি সার্বভৌম সম্পদ, যেখানে ভারতের আইন প্রযোজ্য নয়। কূটনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে এখানে থাকা কর্মীদের জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও সরাসরি হস্তক্ষেপ করতে পারে না। তবে, ভারত এখনও এই হামলার বিষয়ে বিস্তারিত কোনো ব্যাখ্যা দেয়নি।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঘটনার দুই ঘণ্টার মধ্যে এক বিবৃতিতে জানায়, আগরতলায় বাংলাদেশ সহকারী হাইকমিশনে হামলার ঘটনাটি দুঃখজনক এবং এটি সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য। মন্ত্রণালয় আরও বলেছে, কূটনৈতিক ও কনস্যুলার সম্পত্তি কখনোই হামলার লক্ষ্য হতে পারে না।
এছাড়া, বিবৃতিতে বলা হয় যে, ভারতীয় সরকার নয়াদিল্লি এবং বিভিন্ন শহরে বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনগুলোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও জোরদার করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছে।