জন্মভূমি ডেস্ক: স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশে পণ্য আমদানিতে ভারতের নিষেধাজ্ঞাকে বাণিজ্য প্রতিশোধ হিসাবে দেখছে গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ট্রেড রিসার্চ ইনিশিয়েটিভ (জিটিআরআই)। ভারতের বৈদেশিক বাণিজ্য অধিদপ্তর (ডিজিএফটি) শনিবার এক প্রজ্ঞাপনে স্থলপথে বাংলাদেশি তৈরি পোশাক আমদানি নিষিদ্ধের পাশাপাশি আরও কিছু বিধি-নিষেধ আরোপ করে। নয়া দিল্লির এই পদক্ষেপ বিশ্লেষণ করে জিটিআরআই বলছে, বাংলাদেশ থেকে ভারতের আমদানি বাণিজ্যের ৪২ শতাংশের ওপর এর প্রভাব পড়বে। বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান বাণিজ্য বাধা এবং চীনের দিকে ঢাকার কূটনৈতিক মনোযোগের সরাসরি প্রতিক্রিয়া বলে প্রতীয়মান হচ্ছে এই পদক্ষেপ, জিটিআইআর মূল্যায়ন তুলে ধরে এক প্রতিবেদনে বলেছে ইকোনমিক টাইমস। ভারতের এমন সিদ্ধান্তে বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। অর্থনীতিবিদরাও শোনাচ্ছেন হতাশার কথা। খবর সকাল সন্ধ্যা।
বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন বলেছেন, ভারতের পদক্ষেপের বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে জানার পর আলোচনা করে সমাধানের চেষ্টা করা হবে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত বছর আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে বাংলাদেশ-ভারত কূটনৈতিক সম্পর্কে টানাপড়েন চলছে। তারপর গত মার্চ মাসে চীন সফরকালে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের এক বক্তব্যে নয়াদিল্লি থেকে তীব্র প্রতিক্রিয়া আসে। এরপর বিমসটেক সম্মেলনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে ড. ইউনূসের বৈঠক হলেও শীতলতা কাটেনি।
ওই বৈঠকের পরই ট্রান্সশিপমেন্টের মাধ্যমে ভারতের বন্দর ব্যবহার করে তৃতীয় দেশে বাংলাদেশের পণ্য যাওয়ার ব্যবস্থা প্রত্যাহার করে ভারত সরকার। তার এক মাস পর এখন স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশি পণ্য আমদানি সীমিত করা হলো। রবিবার প্রকাশিত ইকোনমিক টাইমসের প্রতিবেদনে জিটিআরআইকে উদ্ধৃত করে বলা হয়, বাংলাদেশ থেকে ভারতের আমদানি বাণিজ্যের প্রায় ৭৭ কোটি ডলার পণ্যে এই সিদ্ধান্তের প্রভাব পড়বে, এটি বাংলাদেশ থেকে মোট আমদানির প্রায় ৪২ শতাংশ। এই সিদ্ধান্তের ফলে তৈরি পোশাক, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য এবং প্লাস্টিক সামগ্রীর মতো বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বাংলাদেশি পণ্য এখন কেবল নির্দিষ্ট সমুদ্রবন্দর দিয়ে ভারতে পাঠাতে হবে। যেমন ভারত বাংলাদেশ থেকে যে ৬১ কোটি ডলারের পোশাক আমদানি করে, তা এখন কেবল কলকাতা এবং মুম্বাই সমুদ্রবন্দর দিয়েই আমদানি করা যাবে। ফলে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি ক্ষতির মুখে পড়বে।
জিটিআরআই-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতের এই বিধিনিষেধ বিচ্ছিন্ন কোনও পদক্ষেপ নয়। এগুলো ভারতীয় পণ্যের ওপর বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান বাণিজ্য বাধা এবং চীনের দিকে ঢাকার মনোযোগ ফেরানোর সরাসরি প্রতিক্রিয়া হিসাবেই দেখা যাচ্ছে। ড. ইউনূসের চীন সফরে ২শ’ ১০ কোটি ডলারের বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি পায় বাংলাদেশ, যা বেইজিংয়ের সঙ্গে ঢাকার ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের ইঙ্গিত দেয়। বাংলাদেশে পালাবদলের পর চীনের দিকে ঢাকার মনোযোগকে ভারত চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছে।
ভারতে রপ্তানির বেশির ভাগই হয় বেনাপোল স্থল বন্দর দিয়ে। ভারতীয় পণ্যের ওপর বাংলাদেশের বাণিজ্য বিধি-নিষেধের বিষয়ে ইকোনকিম টাইমসের প্রতিবেদনে গত এপ্রিলে স্থলবন্দর দিয়ে ভারতীয় সুতা আমদানি নিষিদ্ধ করা, চাল রপ্তানির ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ, কাগজ, তামাক, মাছ ও গুড়ো দুধ আমদানি নিষিদ্ধ করার কথা বলা হয়। সেই সঙ্গে ভারতীয় ট্রানজিটের পণ্যের ওপর প্রতি টন প্রতি কিলোমিটারে ১ দশমিক ৮ টাকা ফি আরোপের কথাও বলা হয় প্রতিবেদনে। ভারতীয় এক কর্মকর্তা বলেন, “বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের শর্তাবলী কেবল নিজের সুবিধার জন্য বা ভারতের বাজার প্রবেশাধিকারকে স্বাভাবিক ধরে নিতে পারে না।”
নয়া দিল্লির পদক্ষেপে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বাংলাদেশি পণ্য যাওয়া এখন কঠিন হয়ে পড়ল। রাজ্যগুলো হলো- আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা, মিজোরাম ইত্যাদি। ভারতের এই অঞ্চলে বাংলাদেশি পণ্য রপ্তানিকারক প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের পরিচালক (বিপণন) কামরুজ্জামান কামাল বলেন, নয়া দিল্লির পদক্ষেপে তারা বড় ক্ষতির মুখে পড়বেন। এদিকে, ভারতের কর্মকর্তারা বলছেন-স্থানীয় উৎপাদন উৎসাহিত করার লক্ষ্যে এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
নয়া দিল্লির সিদ্ধান্তের বড় প্রভাব পড়বে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের ওপর। বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাক ভারতে রপ্তানি করে গত ১০ মাসে ৫৬ কোটি ৩৮ লাখ ডলার আয় হয়েছে, যা গত অর্থ বছরের একই সময়ের চেয়ে ১৮ দশমিক ৮৫ শতাংশ বেশি। এখন নয়া দিল্লির পদক্ষেপে বিজিএমইএর সাবেক পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল বলছেন, এতে ভারতে পোশাক রপ্তানি কমে যাবে। বাংলাদেশের পোশাক স্থলপথে রপ্তানি নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত নিয়ে ইকোনমিক টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এটি আংশিকভাবে স্থলবন্দর দিয়ে ভারতীয় সুতা আমদানির ওপর বাংলাদেশের নিষেধাজ্ঞার প্রতিশোধ।
বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন ভারতের সঙ্গে আলোচনায় সমাধানের আশা করছেন বলে এক তথ্য বিবরণিতে জানানো হয়েছে। তিনি রবিবার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, “ভোক্তা এবং ব্যবসায়ীদের স্বার্থে ভারত ও বাংলাদেশের ব্যবসা চলমান থাকবে। ভারতের পদক্ষেপের বিষয়ে আমরা এখনও অফিসিয়ালি কিছু জানি না। আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে জানার পর ব্যবস্থা নিতে পারব। যদি সমস্যা দেখা দেয় বা তৈরি হয়, তাহলে উভয়পক্ষ আলোচনা করে সমাধানের চেষ্টা করব।” (সংক্ষেপিত)।
ভারত কি বাণিজ্য প্রতিশোধ নিচ্ছে?

Leave a comment