জন্মভূমি ডেস্ক : টি-শার্ট, নারীদের পোশাক, ট্রাউজার কিংবা শার্ট- বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হয়েছে এমন হরেক রকম গার্মেন্ট পণ্য। গন্তব্য ছিল সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, কাতার, সৌদি আরব, নাইজেরিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ। অথচ দেশে আসেনি একটি টাকাও।
জাল-জালিয়াতিতে জড়িত এমন ১০টি প্রতিষ্ঠানের নাম প্রকাশ করেছে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। এই ১০ প্রতিষ্ঠান ১ হাজার ২৩৪টি চালানে রপ্তানি করে ৯ হাজার ১২১ মেট্রিক টন পণ্য। যা থেকে দেশে আসার কথা ছিল ৩ কোটি ৫৩ লাখ ৬৬ হাজার ১১৮ মার্কিন ডলার বা প্রায় ৩০০ কোটি টাকা।
গোয়েন্দা সংস্থাটি বলছে, পোশাক রপ্তানির আড়ালে ৩০০ কোটি টাকা পাচার করেছে ১০টি প্রতিষ্ঠান। তবে অধিকাংশ ঠিকানায় গিয়ে অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠান বা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে পাওয়া যায়নি। বেশির ভাগ ঠিকানাই ভুয়া। বলা হচ্ছে, বিল অব এক্সপোর্ট জালিয়াতির মাধ্যমে অভিযুক্তরা অন্য রপ্তানিকারকের ইএক্সপি ব্যবহার করেছে। বিদেশে নমুনা পাঠানোর কথা বলে বিল অব এক্সপোর্টের ২৪ নম্বর কলামে ব্যবহার করেছে টু-জিরো কোড। এ ক্ষেত্রে কোনো অর্থ দেশে প্রত্যাবাসিত না হয়ে পুরো চালানের রপ্তানি মূল্য বাবদ অর্থ বিদেশে পাচার হয়েছে। ইএক্সপি হচ্ছে ‘এক্সপোর্ট পারমিশন’ বা রপ্তানির অনুমতি, যা অনুমোদিত ডিলার ব্যাংক জারি করে থাকে।
পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএর পরিচালক খসরু চৌধুরী বলেন, এটা গার্মেন্ট খাতের জন্য অশুভসংকেত। বাইরের দেশে ভাবমূর্তি নষ্ট হবে- এ ধরনের কাজে যারা জড়িত তাদের আইনের আওতায় আনা উচিত। বিজিএমইএ থেকেও পদক্ষেপ নেয়া হবে। রপ্তানির ক্ষেত্রে তদারকি আরও বাড়াতে হবে। রপ্তানি করার আগেই এগুলো ধরা যায় কি না সে বিষয়ে খেয়াল রাখা জরুরি। তদারকি বাড়াতে বিজিএমইএ পর্ষদ একটা মনিটরিং সেল গঠন করবে।
আশুলিয়ার প্রজ্ঞা ফ্যাশন ৩৯১টি চালানে ৯২ কোটি টাকা, গুলশানের ফ্যাশনট্রেড ২৪৬ চালানে ৬৮ কোটি, উত্তরার এমডিএস ফ্যাশন ১৮২ চালানে ৪৪ কোটি, টঙ্গীর হংকং ফ্যাশনস ১৫৬ চালানে ৪০ কোটি, বনানীর থ্রি স্টার ট্রেডিং ১২০ চালানে ২৫ কোটি, মিরপুরের ফরচুন ফ্যাশন ৫৯ চালানে ১২ কোটি, কচুক্ষেতের অনুপম ফ্যাশনওয়্যার ৪২ চালানে সাড়ে ৭ কোটি, টঙ্গীর পিক্সি নিটওয়্যারস ২০ চালানে ৫ কোটি, শাহবাগের স্টাইলাইজ বিডি ১০ চালানে ২ কোটি ও খিলক্ষেতের ইডেন স্টাইলটেক্স ৮ চালানে ১ কোটি ৬৪ লাখ টাকা পাচার করে বলে জানায় শুল্ক গোয়েন্দা অধিদপ্তর। চলছে, আইনি ব্যবস্থা নেয়ার প্রক্রিয়া।
অনুসন্ধানে উঠে আসে, কথিত রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো বিল অব এক্সপোর্ট জালিয়াতির মাধ্যমে অন্য রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের ইএক্সপি ব্যবহার করে। বিদেশে নমুনা পাঠানোর কথা বলে ব্যবহার করে টু-জিরো কোড। অভিযুক্ত ১০ প্রতিষ্ঠানের একটি উত্তরার এমডিএস ফ্যাশনস। উত্তরার ঠিকানা ব্যবহার করে ৪৪ কোটি টাকা পাচার করা হয়। অথচ এই নামে কোনো প্রতিষ্ঠানই নেই এখানে।
শাহবাগের স্টাইলাইজ বিডির পরিচালক শহিদুল ইসলাম জানান, এখন আর ওই প্রতিষ্ঠান নেই। করোনার আগেই গুটিয়ে গেছে কর্মকাণ্ড। প্রতিষ্ঠানের এমডিও এখন লাপাত্তা। তার নামে একাধিক মামলা চলমান রয়েছে। তিনি জানান, তার বিদেশ যাওয়ার ক্ষেত্রেও নিষেধাজ্ঞা আছে।
ওভার ইনভয়েসিং, আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে অর্থ পাচারের বিষয়টি ব্যাপকভাবে আলোচিত হলেও নীরবেই ঘটে গেছে, রপ্তানির আড়ালে কোনো টাকা না আসায় এত এত ঘটনা।
কাস্টমস গোয়েন্দারা জানান, প্রজ্ঞা ফ্যাশন লিমিটেড ২০১৯ সালে ৩৮৩টি এবং ২০২০ সালে ৮টিসহ ৩৯১টি রপ্তানি চালানের মাধ্যমে অর্থ পাচার করেছে। এসব রপ্তানিকৃত পণ্য চালানগুলোতে ৩০৮০ মেট্রিক টন টি-শার্ট, প্যান্ট, ট্যাংক-টপ, পাজামা প্রভৃতি পণ্য সংযুক্ত আরব আমিরাত ও মালয়েশিয়া প্রভৃতি দেশে রপ্তানি করা হয়েছে। যার মূল্য প্রায় ১ কোটি ৮ লাখ ৪১ হাজার ৬৯৯ মার্কিন ডলার বা ৯২ কোটি ৪ লাখ ৬০ হাজার ২৪৫ টাকা। এ জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত রয়েছে চট্টগ্রামের বেশ কয়েকটি সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট।
ফ্যাশন ট্রেড ২০২০ সালে ৭৩টি, ২০১৯ সালে ১১৬টি, ২০১৮ সালে ৫৭টিসহ ২৪৬টি রপ্তানি চালানে জালিয়াতি করেছে। রপ্তানিকৃত পণ্যচালানগুলোতে ১৭৭৯ মেট্রিক টন টি-শার্ট, প্যান্ট, ট্যাংক-টপ, পাজামা প্রভৃতি পণ্য সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, ফিলিপাইন, নাইজেরিয়া, সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া, থাইল্যান্ড, সুদান ও মালয়েশিয়া প্রভৃতি দেশে রপ্তানি করা হয়েছে। পণ্যের মূল্য প্রায় ৮০ লাখ ৫১ হাজার ৬৪০ মার্কিন ডলার বা ৬৮ কোটি ৩৫ লাখ ৮৪ হাজার ২৩৬ টাকা।
এমডিএস ফ্যাশন ২০২০ সালে ১৮২টি রপ্তানি চালানে জালিয়াতি করেছে। পণ্য চালানগুলোতে ১৩৭৬ মেট্রিক টন টি-শার্ট ছিল। মূল্য প্রায় ৫১ লাখ ৮২ হাজার ৫৮৬ মার্কিন ডলার বা ৪৪ কোটি টাকা প্রায়। হংকং ফ্যাশনস লিমিটেড ২০১৮, ২০১৯ এবং ২০২০ সালে ১৫৬টি রপ্তানি চালানে জালিয়াতি করেছে। পণ্য চালানগুলোতে ১১৬১ মেট্রিক টন টি-শাট রপ্তানি করেছে। মূল্য প্রায় ৪৭ লাখ ৮৯ হাজার ৬০৬ মার্কিন ডলার বা ৪০ কোটি ৬৬ লাখ ৩৭ হাজার ৫৮৬ টাকা। থ্রি-স্টার ট্রেডিং ২০২০ সালে ১২০টি রপ্তানি চালানে ৮১৬ মেট্রিক টন টি-শার্ট রপ্তানি করেছে। রপ্তানিকৃত পণ্যের মূল্য ৩০ লাখ ৫৩ হাজার ১০৮ মার্কিন ডলার বা ২৫ কোটি ৯২ লাখ ৮ হাজার ৮৬৯ টাকা। ফরচুন ফ্যাশন ২০১৮ এবং ২০১৯ সালে ৫৯টি রপ্তানি চালানে ৪৩৫ মেট্রিক টন টি-শার্ট রপ্তানি করেছে। পণ্যের মূল্য প্রায় ১৫ লাখ ২৪ হাজার ৮১৩ মার্কিন ডলার বা ১২ কোটি ৯৪ লাখ ৫৬ হাজার ৬২৩ টাকা।
অনুপম ফ্যাশন ওয়্যার লিমিটেড ২০২০ সালে ৪২টি রপ্তানি চালানের মাধ্যমে ১৯৫ মেট্রিক টন টি-শার্ট রপ্তানি করেছে, যার মূল্য প্রায় ৮ লাখ ৭৭ হাজার ৪৭০ মার্কিন ডলার বা ৭ কোটি ৪৪ লাখ ৯৭ হাজার ২০৩ টাকা।
পিক্সি নিট ওয়্যারস লিমিটেড ২০২০ সালে ২০টি রপ্তানি চালানে ১৭০ মেট্রিক টন টি-শার্ট রপ্তানি করেছে। মূল্য প্রায় ৫ লাখ ৯৬ হাজার ২৮২ মার্কিন ডলার বা ৫ কোটি ৬ লাখ ২৪ হাজার ৩৪১ টাকা।
স্টাইলাইজ বিডি লিমিটেড ২০২০ সালে ১০টি রপ্তানি চালানে ৬৬ দশমিক ৮ মেট্রিক টন টি-শার্ট রপ্তানি করেছে। এসব পণ্যের মূল্য প্রায় ২ লাখ ৫৫ হাজার ৬২৯ মার্কিন ডলার বা ২ কোটি ১৭ লাখ টাকা।
ইডেন স্টাইল টেক্স ২০২০ সালে ৮টি রপ্তানি চালানে জালিয়াতি করেছে। রপ্তানিকৃত পণ্য চালানগুলোতে ৪২ মেট্রিক টন টি-শার্ট রপ্তানি করেছে। যার মূল্য প্রায় ১ লাখ ৯৪ হাজার ৮৫ মার্কিন ডলার বা প্রায় ১ কোটি ৬৪ লাখ ৭৭ হাজার ৮১৬ টাকা।
কাস্টমস গোয়েন্দা আরও জানায়, অধিকাংশ ক্ষেত্রে রপ্তানিকৃত পণ্য হলো টি-শার্ট এবং প্রতি পিসের ওজন দেখানো হয়েছে ৫০০/৮০০/১০০০ গ্রাম বা তারও বেশি। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে প্রতি কেজি নিট ফেব্রিক্স দিয়ে কমপক্ষে ৩ থেকে ৬টি লং স্লিভ টি এল সাইজ টি-শার্ট হয়ে থাকে। এ অবস্থায় প্রতিটি টি-শার্টের গড় ওজন ন্যূনতম ২৫০ গ্রাম ধরে রপ্তানিকৃত টি-শার্টের সংখ্যা হিসাব করা হয়েছে।
এছাড়া কিছু পণ্য চালানে রপ্তানি পণ্যের মূল্য খুবই কম ঘোষণা করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে সমসাময়িক রপ্তানি চালানের সমজাতীয় পণ্যের মূল্য বিবেচনায় নিয়ে সম্ভাব্য রপ্তানিমূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে। রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান ও সংশ্লিষ্ট সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট বিল অব এক্সপোর্টে অন্য রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের ইএক্সপি ব্যবহার করেছে। আরও জানা যায়, সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট এবং রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো পারস্পরিক সহযোগিতা ও যোগসাজশে জাল-জালিয়াতির এ ঘটনা ঘটেছে। প্রতিষ্ঠাগুলোর বিরুদ্ধে যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের প্রক্রিয়া চলমান।
এ ঘটনার সঙ্গে যুক্ত সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টরা হলো- এমএজে শিপিং করপোরেশন, এঅ্যান্ডজে ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, জিআর ট্রেডিং করপোরেশন, এনএইচ করপোরেশন, কেআরএস সিঅ্যান্ডএফ লিমিটেড, প্যান বেঙ্গল এজেন্সি, পরাগ এসএমএস লিমিটেড, রিয়াঙ্কা ইন্টারন্যাশনাল এবং মেসার্স একে এন্টারপ্রাইজ।