সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দেশে ভুল চিকিৎসায় মৃত্যুর ঘটনা নতুন নয়। ভুল চিকিৎসায় কতজনের মৃত্যু ঘটছে এর সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বৈশ্বিক মৃত্যু ও প্রতিবন্ধিতার প্রধান ১০টি কারণের অন্যতম অনিরাপদ চিকিৎসাসেবা। প্রতি বছর নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে ভুল চিকিৎসায় ১ কোটি ৩৪ লাখ দুর্ঘটনা ঘটে। এতে ২৬ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়। এই পরিসংখ্যান উদ্বেগজনক। সর্বশেষ গত ১৩ মার্চ খুলনার একটি বেসরকারি হাসপাতালে সিস্ট অপারেশনের জন্য ভর্তি হন গৃহবধূ শায়লা শারমিন। ১৫ মার্চ দুপুরে তাকে অপারেশনের জন্য অচেতন ইনজেকশন দেওয়া হয়। কিন্তু অচেতন অবস্থা থেকে আর জ্ঞান ফেরেনি শারমিনের। ১১ দিন অচেতন অবস্থায় থাকার পরে ২৬ মার্চ সকালে তার মৃত্যু হয়। রোগীর স্বজনের অভিযোগ, ভুল চিকিৎসায় তার মৃত্যু হয়েছে। এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত জরুরি বলে মনে করি।
মানুষের মৌলিক অধিকারের মধ্যে অন্যতম একটি হলো স্বাস্থ্যসেবা। দেশের মোট জনসংখ্যার বড় অংশই গ্রামে বসবাস করে। গ্রামের কৃষক ও হতদরিদ্র মানুষ তাদের চিকিৎসার জন্য নির্ভর করেন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোর ওপর। কিন্তু এগুলো চিকিৎসকসহ নানা রকম সংকট ও অনিয়ম-অব্যবস্থাপনায় আক্রান্ত। তাই গ্রামীণ দরিদ্র মানুষগুলো প্রতিনিয়তই বঞ্চিত হচ্ছেন কাঙ্খিত চিকিৎসাসেবা থেকে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে বড় সংকট হলো লোকবল ও চিকিৎসা সরঞ্জামাদির। আবার যে সরঞ্জামাদি আছে তারও সদ্ব্যবহার হয় না, যে লোকবল নিয়োজিত আছে তাদেরও কর্মস্থলে যথাযথ দায়িত্ব পালন নিশ্চিত হচ্ছে না। ভুল চিকিৎসা বা চিকিৎসায় অবহেলার শিকার ব্যক্তির স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল ও ক্লিনিক শাখা এবং বাংলাদেশ মেডিকেল এন্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) কাছে অভিযোগ জানানোর সুযোগ রয়েছে। তবে এ বিষয়টি জানা নেই অনেকের, নেই সচেতনতা। দুঃখজনক বাস্তবতা হলো- যারা অভিযোগ করেন, বিচারের আশায় তাদের কেটে যায় দীর্ঘ সময়। বিএমডিসিতে এ বিষয়ে অভিযোগের তালিকা দীর্ঘ হলেও নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে দেখা যায় ধীর গতি।
বিএমডিসি সূত্রে জানা যায়, গত ৫ বছরে ১২৭টি অভিযোগ জমা পড়লেও নিষ্পত্তি হয়েছে মাত্র ৩১টির। এর মধ্যে অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে ৭টির। এক্ষেত্রে শাস্তি হিসেবে বিভিন্ন মেয়াদে চিকিৎসকের নিবন্ধন স্থগিত করা হয়েছে। মাঝপথে টাকার বিনিময়ে সমঝোতা হয়েছে ১৪টির। চিকিৎসকের অবহেলায় মৃত্যুর অভিযোগেও সর্বোচ্চ শাস্তির নজির নেই। বিশেষজ্ঞদের মতে, সঠিক রোগ নির্ণয় ও দক্ষতার অভাবেই সাধারণত ভুল চিকিৎসা হয়ে থাকে। কখনো কখনো ভুল ওষুধ সেবন, ক্ষতিকর ওষুধের মাত্রাতিরিক্ত ও দীর্ঘমেয়াদি ব্যবহার, নিম্নমানের ওষুধ, ভুল অস্ত্রোপচার এবং প্রতারকের খপ্পরে পড়ার ঘটনাও গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়ে আসছে। স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত করতে সরকার ‘স্বাস্থ্য সেবা ও সুরক্ষা আইন, ২০২২’ প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছে। এরই মধ্যে খসড়াটি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে বলে জানা গেছে। জনস্বার্থে এই আইনের প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন জরুরি মনে করি। এ বিষয়ে অবিলম্বে সরকারকে পদক্ষেপ নিতে হবে। স্বাস্থ্য খাতে অনিয়ম-অব্যবস্থাপনা রোধ করতে ঊর্ধ্বতন মহলের নজরদারি দরকার। স্বাস্থ্য খাতের রূপরেখা নিয়ে এখনই ভাবতে হবে। অবহেলা বা ভুল চিকিৎসায় কোনো মৃত্যু দেখতে চাই না।