
জন্মভূমি ডেস্ক : সম্প্রতি নানা সংকটে ভোজ্যতেল আমদানি কমলেও পণ্যটির সরবরাহে ঘাটতি নেই। খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভোজ্যতেল ব্যবহারে ভোক্তা পর্যায়ে কৃচ্ছ্রসাধনের ফলে চাহিদা কমেছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই প্রান্তিকে ভোজ্যতেল আমদানি আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১ লাখ ১৪ হাজার ১৬১ টন কম ছিল। উল্লেখযোগ্য পরিমাণে আমদানি কমলেও রোজা সামনে রেখে বাজারে পণ্যটির সরবরাহ চেইনে ঘাটতি নেই। এক্ষেত্রে বাড়তি দামের কারণে ভোক্তা পর্যায়ে চাহিদা কমতে পারে বলে মনে করছেন আমদানিকারক, পাইকার ও খুচরা ব্যবসায়ীরা।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্যমতে, ২০২৩ সালের জুলাই-জানুয়ারি পর্যন্ত ছয় মাসে দেশে অপরিশোধিত ভোজ্যতেল আমদানি হয়েছে ১২ লাখ ১১ হাজার ৩৩৩ টন। ২০২২ সালের একই সময়ে আমদানি হয়েছিল ১৩ লাখ ২৫ হাজার ৪৯৪ টন। এক লাখ টনেরও বেশি আমদানি কমার পরও বাজারে এর তেমন প্রভাব দেখা যায়নি।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, নিত্যপণ্যের মধ্যে অত্যাবশ্যকীয় হিসেবে ভোজ্যতেল ব্যবহার হয়। কয়েক বছর ধরে পণ্যটির দাম প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যাওয়ায় ধীরে ধীরে এর ব্যবহার কিছুটা কমেছে। অন্যান্য নিত্যপণ্য ক্ষেত্রবিশেষে ব্যবহার জরুরি হলেও সাধারণ মানুষের মধ্যে ভোজ্যতেল ব্যবহার কমিয়ে আনা সম্ভব। মূলত কয়েক বছর আগে লিটারপ্রতি ১০৪ থেকে ২০৭ টাকায় দাম উঠে যাওয়ার কারণে পণ্যটির ব্যবহার কমতে শুরু করে। পাইকারি বাজার ও পরিশোধনকারী মিলগুলোয় গত এক বছরের পণ্য ক্রয়ের আদেশ পর্যালোচনার ভিত্তিতে এ ধারণা করছেন মিল মালিক, ট্রেডিং প্রতিষ্ঠান, খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা।
কাস্টমসের তথ্যে দেখা গেছে, গত ডিসেম্বর পর্যন্ত ছয় মাসে দেশে অপরিশোধিত সয়াবিন তেল আমদানি হয়েছে ২ লাখ ৫৯ হাজার ৮৫২ টন। ২০২২ সালের একই সময়ে আমদানি হয়েছিল ৪ লাখ ৩২ হাজার ৮৬৯ টন। অন্যদিকে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ছয় মাসে অপরিশোধিত পাম অয়েল আমদানি হয়েছিল ৯ লাখ ৫১ হাজার ৪৮১ টন। ২০২২ সালের একই সময়ে পাম অয়েল আমদানি হয়েছিল ৮ লাখ ৯২ হাজার ৬২৫ টন। সব মিলিয়ে প্রায় ১ লাখ ১৫ হাজার টন ভোজ্যতেল আমদানি কম হয়েছে। সয়াবিনের পরিবর্তে পাম অয়েলের ব্যবহার বেড়েছে।
ব্যবসায়ী ও বাজারসংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে ভোগ্যপণ্যের বাজারে পণ্যের চাহিদা কমপক্ষে ১০ শতাংশ কমেছে। পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ও দীর্ঘ সময় ধরে ঊর্ধ্বমুখী অবস্থায় দাম স্থির থাকায় একই সুবিধাসম্পন্ন কম দামের বিকল্প পণ্যের চাহিদা বেড়েছে। বাজারে সয়াবিনের তুলনায় পাম অয়েলের দাম লিটারপ্রতি ৩৫-৪০ টাকা কম। এতে সয়াবিন তেল আমদানি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমলেও পাম অয়েল আমদানি কিছুটা বেড়েছে।
বাংলাদেশ পাইকারি ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি গোলাম মাওলা বলেন, ‘মূল্যস্ফীতির হার বাড়ায় মানুষের মধ্যে ভোগের পরিমাণ কমেছে। নিম্নবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত এমনকি মধ্যবিত্তরা তুলনামূলক কম কিনছেন। দাম বাড়ায় সয়াবিনের পরিবর্তে পাম অয়েলের ব্যবহার বেড়েছে। দেশের বিভিন্ন জেলা শহর থেকে ভোজ্যতেল ক্রয়ের চাহিদা আগের তুলনায় কম আসায় মিলগেটেও চাপ নেই।’
মিল মালিক ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, রোজার এক মাস আগে দেশে ভোজ্যতেলের চাহিদা বেড়ে যায়। আগে এ সময়ে মিলগেটে দীর্ঘ লাইন ছাড়াও এসও (সাপ্লাই অর্ডার) নিয়ে মিলগেটে যাওয়ার কয়েক দিন পর পণ্য সরবরাহ করা হতো। বর্তমানে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভোজ্যতেল সংগ্রহ করতে পারছেন ক্রেতারা। স্থানীয় পর্যায় থেকে আগের মতো চাহিদা না থাকায় মিল ও পাইকারি বাজারে চাপ কমেছে। একইভাবে বেকারি, রেস্তোরাঁ কিংবা খাদ্যপণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে আগের মতো চাহিদা না থাকায় পাইকারি বাজারেও এর প্রভাব পড়েছে।
দেশে ভোজ্যতেলের বার্ষিক চাহিদা ২৪ লাখ টনের কাছাকাছি। এর মধ্যে প্রায় তিন লাখ টন পাওয়া যায় দেশীয় উৎস থেকে। আমদানি হওয়া ২০-২১ লাখ টন ভোজ্যতেলের দুই-তৃতীয়াংশ পাম অয়েল মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া থেকে আমদানি হয়। অন্যদিকে আমদানি চাহিদার এক-তৃতীয়াংশ সয়াবিন তেল আসে আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিল থেকে। বাসাবাড়িতে রান্নার কাজে সয়াবিন তেলের চাহিদা থাকলেও দেশে খাদ্যপণ্য তৈরি, হোটেল-রেস্তোরাঁয় পাম অয়েল ব্যবহার বেশি হয়।
খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, কভিড-১৯ মহামারী-পরবর্তী বিশ্ববাজারে ভোজ্যতেলের বুকিং দর বেড়ে যাওয়া, বাড়তি জাহাজ ভাড়া ও দেশে ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে ২০২২-২৩ মৌসুমে ভোজ্যতেলের দাম রেকর্ড পরিমাণ বেড়ে যায়। বর্তমানে বিশ্ববাজারে দাম ২০২১ সালের পর্যায়ে নামলেও অভ্যন্তরীণ সংকটের কারণে দেশের বাজারে সেভাবে এর প্রভাব পড়েনি।
ভোজ্যতেল আমদানি ও পরিশোধনকারী প্রতিষ্ঠান সিটি গ্রুপের পরিচালক (করপোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স) বিশ্বজিৎ সাহা বলেন, ‘আমদানি ও ডলার সংকটসহ বিভিন্ন কারণে দাম বেশি হওয়ায় সাধারণ মানুষের মধ্যে ভোজ্যতেলের ভোগ কমে যাওয়া স্বাভাবিক। এসব সত্ত্বেও মিল পরিচালনা ও সরবরাহ চেইন স্বাভাবিক রাখতে রোজার আগে পর্যাপ্ত পরিমাণে আমদানি করেছি।’ মজুদ স্বাভাবিক থাকলেও মিল পর্যায় থেকে ক্রেতাদের ভিড় নেই বলে স্বীকার করেছেন তিনি।
পাইকারি বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে মণপ্রতি (৩৭ দশমিক ৩২ কেজি) পাইকারি সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে ৬ হাজার টাকায়। অন্যদিকে পাম অয়েল বিক্রি হচ্ছে ৫ হাজার টাকায়। যদিও পাম অয়েল ও সয়াবিন ট্রেডিং পর্যায়ে পাইকারি দামের চেয়ে মণে ১৫০-২০০ টাকা কমে লেনদেন হচ্ছে। রোজায় সয়াবিনের তুলনায় পাম অয়েলের চাহিদা বেশি থাকলেও বর্তমান দাম কয়েক সপ্তাহ ধরে স্থিতিশীল বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।