বৃহস্পতিবার ফুলতলা উপজেলার মশিয়ালী গ্রামে এলাকায় আধিপত্য বিস্তার ও এতিমখানার সভাপতি হওয়াকে কেন্দ্র করে জাকারিয়া-জাফরিন গ্রæপের গুলির ঘটনায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে চারজন হয়েছে। অপরদিকে গ্রামবাসীর গণপিটুনিতে জাকারিয়া জাফরিনের চাচাতো ভাই জিহাদ নিহত হয়েছে। এলাকায় চলছে শোকের মাতম। পুলিশ এ ঘটনায় জাহাঙ্গীর হোসেন নামের একজনকে গ্রেফতার করেছে।
খানজাহান আলী থানাধীন মশিয়ালী গ্রামে খানজাহান আলী থানা আওয়ামী লীগের সহ-প্রচার সম্পাদক শেখ জাকারিয়া তার ভাই মহানগর ছাত্রলীগের বহিষ্কৃত সহ-সভাপতি শেখ জাফরিন হাসান এবং অস্ত্র মামলার সাজাপ্রাপ্ত আসামী শেখ মিল্টন হাসান বাহিনীর হামলার গুলিবিদ্ধ গুরুতর আহত সাইফুল শেখ (২২) খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এবং গ্রামবাসীর হামলায় রাতে জাকারিয়ার চাচাতো ভাই জিহাদ (৩০) মারা গেছে। এর আগে বৃহস্পতিবার সংঘর্ষে গুলিবৃদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থল মিল শ্রমিক নজরুল ইসলাম (৫৫) ও রাজমিস্ত্রীর হেলপার গোলাম রসুল (৩৫) নিহত হয়। মোট মৃতের সংখ্যা দাড়াল ৪জন। হত্যাকাÐের পর বিক্ষুব্ধ উত্তেজিত গ্রামবাসী জাকারিয়া, জাফরিন, মিল্টন, জিহাদ, জাহাঙ্গীর, সাগর ও রাজুর বাড়ি ভাংচুর করে আগুন দিয়ে জ¦ালিয়ে দিয়েছে। ঘটনার জন্য গ্রামবাসী প্রশাসনকে দায়ী করে বলছে সরকারি দলের নাম ভাঙ্গিয়ে থানা পুলিশকে ব্যবহার করে নিরীহ মানুষকে মিথ্যা মামলা হামলা অত্যাচার করে অতিষ্ঠ করে তুলেছিল। এই ঘটনায় জাফরিন শেখের সহযোগী জাহাঙ্গীরকে পুলিশ যশোরের অভয়নগরের নওয়াপাড়া থেকে গ্রেফতার করেছে।
জানাগেছে, গত রোজায় মশিয়ালী গ্রামের তুহিনের সাথে জাফরিনের দ্ব›দ্ব হয় এর জের ধরে ঈদুল ফিতরের দিন জাফরিন বাহিনীর সাথে গ্রামবাসী মুখোমুখি অবস্থানে পুলিশের হস্থক্ষেপে উভয় পক্ষ পিছু হটে যায়। ঐ ঘটনার সুত্র ধরে কয়েক দফা গ্রামের কয়েক ব্যক্তি তাদের হামলার শিকার হলে শুরু হয় জাকারিয়া-জাফরিন-মিল্টন বাহিনীর সাথে শত্রæতা। এরই জের ধরে বৃহস্পতিবার খানজাহান আলী থানা পুলিশ আলিম জুট মিলের শ্রমিক মুজিবর শেখ (৪৫) কে গোলাবারুদসহ আটক করে। এলাকাবাসী বলছে মিল শ্রমিককে পূর্বশত্রæতায় ষড়যন্ত্র করে জাকারিয়া গোলাবারুদ দিয়ে পুলিশের কাছে ধরিয়ে দেয়। খবর পেয়ে মুজিবরের স্বজন ও গ্রামের কয়েকজন তাকে ছাড়াতে যায় কিন্তু পুলিশ তাকে আটক করে থানায় নিয়ে যায়। তারা রাত ৮টায় মশিয়ালীর হাড়াতলার মোড়ে আসলে তিন সহোদর জাকারিয়া-জাফরিন-মিল্টন, তাদের চাচাতো ভাই জিহাদ, সহযোগী আলমগীর, জাহাঙ্গীর, আরিফ, আজিমসহ ১০/১২জন তাদের উপর অতরকৃতভাবে হামলা চালায়। তারা বৃষ্টির মতো গুলিবর্ষ এবং ককটেল বোমা নিক্ষেপ করে। এ সময় ঘটনাস্থলে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায় আলিম জুট মিলের শ্রমিক নজরুল ইসলাম (৫৫) ও রাজমিস্ত্রীর হেলাপার গোলাম রসুল (২৫)। গুলিবিদ্ধ গুরুতর আহত আফসার শেখ (৬০), শামিম (২৭), রবি (৪০), খলিল (৩০) রানা (২২), আফছার শেখ (৩৪), সাইফুল (২২)সহ ৯ জনকে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শুক্রবার গুলিবিদ্ধ সাইদুল শেখের পুত্র কৃষক সাইফুল শেখ (২২) ও সৌর শেখের পুত্র কৃষক আফসার শেখ (৬০) মারা যায়।
এ দিকে মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে বিক্ষুব্ধ উত্তেজিত গ্রামবাসী জাকারিয়া, জাফরিন, মিল্টনের বাড়ি, অফিস ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং জিহাদ, জাহাঙ্গীর, সাগর ও রাজুর বাড়ি ভাংচুর করে আগুন লাগিয়ে দেয়। এ সময় হামলাকারী জাকারিয়ার চাচাতো ভাই জিহাদ (৩০) গ্রামবাসীর গণপিটুনিতে নিহত হয়। এই ঘটনায় তিন সহোদর জাকারিয়া, জাফরিন ও মিল্টনের আলিশান ভবনে রাতভর গ্রামবাসী আগুন দিয়ে জ¦ালিয়ে দেয়।
গতকাল শুক্রবার সকালে যেয়ে দেখাযায় মশিয়ালীর এই আালিশান রাজমহলের প্রতিটি কক্ষ এবং ভবনের মধ্যে থাকা একটি প্রাইভেট জিপ গাড়ি, দুটি মটরসাইকেলসহ সকল আসবাপত্র আগুনে পুড়ে দাউদাউ করে জ¦লছে। শতশত গ্রামবাসী বাড়িগুলোর মধ্যে ঢুকে মোবাইলে ভিডিও করছে উপস্থিত প্রতিটি মানুষের মুখে একটি কথা এই সন্ত্রাসী বাহিনী এবং প্রশাসনের কর্তা ব্যক্তিসহ এদের মদদদাতা সকলকে আইনের আওতায় এনে কঠোর শাস্তি দিতে হবে। মিল্টনের বাড়ির সামনে একটি গুপ্ত ঘরের দিকে উৎসুক জনতার ভিড় দেখে এগিয়ে যেয়ে দেখা যায় সেখানে একটি কক্ষের ফ্লোরের নিচে আন্ডারগ্রাউন্ড অস্ত্র রাখার একটি ড্রাম পোতা আছে। সেখানে এই বাহিনীর সকল অবৈধ অস্ত্র, গালারারুদ, মাদকদ্রব্য রাখা হতো বলে এলাকাবাসী দাবি করছে।
এলাকার সত্তরোর্ধ শেখ তমিজ বলেন, শেখ মিল্টন একটি অস্ত্র মামলায় সাজাাপ্রাপ্ত আসামী। এছাড়া তার ভাই জাকারিয়া ও জাফরিন ক্ষমতাসীন দলের নাম ভাঙ্গিয়ে থানা পুলিশের ভয় দেখিয়ে এলাকায় সন্ত্রাসী রাজত্ব কায়েম করে আসছিল। এলাকায় বহিরাগত অস্ত্রধারী নিয়ে আসতো যা মাঝেমধ্যে এলাকাবাসী আটক করে পুলিশের হাতে ধরিয়ে দিতো সম্প্রতি দুজনকে পুলিশে দেওয়া হয়। তাদের বাহিনীর সদস্যদেরকে গ্রামবাসী ধরিয়ে দেয়ায় তাদের ক্ষোভ, সেই ক্ষোভ থেকে তারা এই হত্যাকান্ডের মতো ঘটনা ঘটিয়েছে। এ সময় উপস্থিত জনতা বলেন তাদের আলিশান ভবনের মতো ভবন খুলনা বিভাগে কারো নেই, এ সব আসে কোথা থেকে তা প্রশাসনকে ক্ষতিয়ে দেখতে হবে। তারা বলে তাদের বিষয়ে থানা পুলিশকে অভিযোগ দিতে গেলে অভিযোগ নেওয়া হয়না, উল্টা অভিযোগকারীকে প্রশাসন দিয়ে হয়রানি করা হয়।
মশিয়ালী গ্রাম জুড়ে থমথমে অবস্থা বিরাজ করলেও পরিস্থিতি শান্ত রয়েছে। এলাকায় তিন প্লাটুন পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষনে এসে সকালে ডিসি নর্থ মোল্লা মো. জাহাঙ্গীর আলম, অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার সোনালী সেন, দৌলতপুর জোনের সহকারি পুলিশ কমিশনার বায়জিত ইবনে আকবরসহ পুলিশের উর্ধতন কর্মকর্তাগণ গ্রামবাসীর সাথে কথা বলেন এবং ঘটনায় দায়িদের দৃষ্টান্তমূলক শস্তি নিশ্চিতের আশ^াস প্রদান করেন। এ সময় উপস্থিত এলাকাবাসী পুলিশের উর্ধতন কর্মকর্তাদেরকে এই ঘটনার দায়ী বাহিনীকে আশ্রয় প্রশ্রয় দ্বাতা প্রশাসন কর্তা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থার দাবি জানায়। ঘটনার পর খানজাহান আলী থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ আবিদ হোসেন, জেলা পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান মো. সাজ্জাদুর রহমান লিংকনসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে নিহতদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে শান্তনা দেন।
এদিকে বিকালে নিহত মিল শ্রমিক নজরুল ইসলাম (৫৫) ও রাজমিস্তীর হেলাপার গোলাম রসুল (৩৫) ও কৃষক সাইফুলের লাশ গ্রামে আনা হলে গ্রাম জুড়ে শোকের ছায়া নেমে আসে। স্বজন আর গ্রামবাসীর কান্নায় এলাকার বাতাসভারী হয়ে ওঠে। এ সময় নিহতদের স্বজনরা বারবার মুর্ছা যায়। নিহত তিনজনকে এক সাথে জানাযা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। সংঘর্ষে নিহতের ঘটনায় সন্ত্রসী কার্যকালাপে জড়িত থাকায় খানজাহান আলী থানা আওয়ামী লীগের সহ-প্রচার সম্পাদক শেখ জাকারিয়াকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। এদিকে সংঘর্ষের ঘটনায় জাফরিন শেখের সহযোগী জাহাঙ্গীরকে গতকাল শুক্রবার পুলিশ যশোরের অভয়নগরের নওয়াপাড়া থেকে গ্রেফতার করেছে।
এলাকাবাসী, পুলিশ, শ্রমিক নেতা আ: হামিদ সরদার, এলাকার সাবেক চেয়ারম্যান শেখ জাহাঙ্গীর হোসেন, নিহত রসুলের মাতা জাহানারা ও নিহত নজরুল ইসলামের ভাইপো শেখ জাহাঙ্গীর হোসেন জানান, মশিয়ালী গ্রামের মৃত অধ্যাপক হাসান শেখ এর ৪ পুত্র জাফরিন, জাকারিয়া, মিল্টন ও কবির দীর্ঘদিন এলাকায় মাদক ও চড়াসুদে ঋণদান ব্যবসার সাথে জড়িত থাকায় এলাকাবাসী তাদের বিরোধিতা কারণে বিভিন্ন সময় দ্ব›েদ্বর সৃষ্টি ও পরবর্তীতে মামলা পর্যন্ত গড়ায়। সম্প্রতি মুজিবর শেখ নামের এক গ্রামবাসী এলাকার এতিমখানার সভাপতি হওয়ার ক্ষেত্রে প্রকাশ্যে জাকারিয়ার বিরোধিতা করায় সর্বশেষ বৃহস্পতিবার জাফরিন গ্রæপ পরিকল্পিতভাবে দেশীয় অস্ত্রসহ মুজিবর শেখ নামের ঐ ব্যাক্তিকে পুলিশে ধরিয়ে দেয়। ওই ঘটনার বিষয়ে গ্রামবাসী জাফরিনদের কাছে বিস্তারিত জানতে গেলে জাফরিন গ্রæপ উত্তেজিত হয়ে এক পর্যায়ের গ্রামবাসীর উপর অবৈধ অস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
নিহত রসুলের মাতা জাহানারা বেগম আরও জানান, আমার দুটি সন্তানকে ভিক্ষা করে মানুষ করেছি তাদের মধ্যে একজন প্রতিবন্ধী আর অন্য সন্তানকে আজ ওরা গুলি করে মেরে ফেললো। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত থানায় মামলার প্রস্তুতি চলছিল।