রিপন চন্দ্র মল্লিক, মাদারীপুর : এক সময়ের জাতীয় পার্টির নেতা মনোয়ার হোসেন শরীফ ওরফে মন্টু শরীফ। পরে আওয়ামীলীগে যুক্ত হয়ে গড়ে তুলেছেন অপরাধের এক রাজত্ব। বিশেষ করে কারো জমির উপর নজর পড়লেই ভয়-ভীতি, হামলা-মামলা দিয়ে দখল করছে অন্যের সম্পদ। এরই মধ্যে তার বিরুদ্ধে ভূমি দলখের অভিযোগে একাধিক মামলা চলছে। যারা দীর্ঘ দিন মন্টু শরীফের ভয়ে মুখ খুলেনি, তারাই ৫ আগস্ট স্বৈরাচার পতনের পর মুখ খুলতে শুরু করেছে। ভূক্তভোগিরা মন্টু শরীফের শাস্তি দাবী করছেন।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানা গেছে, মাদারীপুরে আওয়ামীললীগের নেতাদের ছত্র-ছায়ায় ও পুলিশ-প্রশাসন ম্যানেজ করে পৌরসভা ১ নম্বর ওয়ার্ডের কলেজ রোড এলাকার একাধিক ব্যক্তির জমি দখলের অভিযোগ উঠেছে শরীফ মনোয়ার হোসেন ওরফে মন্টু শরীফের বিরুদ্ধে। অভিযোগ রয়েছে, ভুয়া দলিল বানিয়ে নিজের ভাড়া করা সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে জমির মালিকদের ভয়-ভীতি দেখিয়ে ও মারধর করে জোর করে জমি দখল করার। শেখ হাসিনার পতনের পর এ বিষয়ে দুই একজন মুখ খুললেও অধিকাংশ ভুক্তভোগীরা এখনো ভয়ে আতঙ্কে মুখ খুলছেন না। মুখে বললেও তাঁরা ক্যামেরার সামনে কথা বলতে রাজি নন। অথচ মন্টু শরীফের বিরুদ্ধে জমি সংক্রান্ত ও হত্যা মামলা চলছে।
সরেজমিন ঘুরে জানা গেছে, ভূমিদস্যুখ্যাত মন্টু শরীফ ছিলেন মূলত জাতীয় পার্টির এক সময়ের ছাত্র সমাজের সভাপতি। এরপর জীবিকার তাগিদে চলে জান প্রবাসে। দীর্ঘ প্রায় ১৫ বছর প্রবাসে থাকার পরে তিনি দেশে আসেন। পরে স্থানীয় আওয়ামীলীগ নেতাদের সাথে লবিং করেন। মাদারীপুরে আওয়ামী লীগের মূলত দুইটি গ্রুপে বিভক্ত। একটি সাবেক নৌ-মন্ত্রী শাজাহান খান, অপরটি মাদারীপুর ৩ আসনের সাবেক এমপি আ.ফ.ম বাহাউদ্দিন নাসিম। তিনি এই দুই পক্ষের সাথেই লবিং রেখে চলতেন। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে এই দুই পক্ষের নেতাদের তার খরচে পোস্টার, ব্যানার করে দিতেন। আর এই সুযোগটাই তিনি কাজে লাগিয়ে জমি কেনা-বেচার ব্যবসা করতেন। কোন জমির উপর চোখ পড়লে সেই জমি বাগিয়ে নেয়ার চেষ্টা করতেন মন্টু শরীফ। আপসে নয়তো ঝামেলা সৃষ্টি করে। এলাকায় একক আধিপত্য সৃষ্টি করে ঝামেলা করতেন নিরীহ মানুষের উপর। শুধু মাদারীপুরেই নয়, আধিপত্য দেখিয়ে অন্য জেলায়ও তার জমি কেনাবেচার ব্যবসা রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানা গেছে, মন্টু শরীফ যদি জমি কিনেন ২ শতাংশ, তিনি ভুয়া দলিল বানিয়ে দাবী করেন ৪ শতাংশ। তার কাজে কেউ বাঁধা দিতে আসলেই তাদের উপর হুমকি ও হামলা করেন। এই ভয়েই কেউ কিছু বলতো না। ভুক্তভোগীরা নিরুপায় হয়ে থানায় অভিযোগ দিলেও কোন ব্যাবস্থা নেয়নি পুলিশ। এছাড়া তার বিরুদ্ধে আদালতে মামলা দিলেও ন্যায় বিচার পায়নি ভুক্তভোগীরা। ফলে মামলা ঝুলে থাকে মাসের পর মাস। আর এই সুযোগেই তিনি ওসব জমি দখল করে নিতেন।
এমনই এক ভূক্তভোগি পরিবারের সদস্য মঞ্জুর হোসেন। তিনি বলেন, ‘অনেক দিন ধরে আমার পৈত্রিক সম্পত্তির ১৫ শতাংশ জমি অবৈধভাবে দখল করে মন্টু শরীফের নামে সাইনবোর্ড লাগিয়ে রেখেছে। আমার বাবার মৃত্যুর পরে ওয়ারিশসূত্রে এই জমির মালিক আমরা। অথচ আমরা জমির কাছে গেলে মন্টু শরীফ ও তার সন্ত্রাসী বাহিনী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আমাদের মারতে আসে। বিভিন্ন সময়ে প্রাণনাশের হুমকি-ধামকি দেয়। আমরা ভয়ে আর জমির কাছে যাই না। অথচ এই জমি নিয়ে আদালতে একটি মামলা চলছে। মামলাটি নিষ্পত্তি না হওয়ায় পর্যন্ত তিনি ঐ যায়গায় তার নামে সাইনবোর্ড ব্যবহার করে কিভাবে সেটা আমার বোধগম্য নয়।’
তিনি আরো বলেন, ‘আল্লাহ্ আছেন সত্যি। স্বৈরাচার সরকারের পতন হয়েছে। সদর উপজেলার মস্তফাপুর ইউনিয়নের শহীদ তাওহীদ সন্নামাত হত্যা মামলার আসামী হওয়ায় বর্তমানে তিনি এলাকা ছেড়ে পালিয়েছেন। এবার হয়ত আমরা আইনের সঠিক বিচার পাবো।’
আরেক ভূক্তভোগি ওহাব মিয়া বলেন, ‘হঠাৎ একদিন মন্টু শরীফ ও তার সন্ত্রাসী বাহিনী নিয়ে আমার বাড়ির বাউন্ডারির দেয়াল ভাঙ্গছে। আমি বাঁধা দিতে গেলে তাঁরা বলেন এখান দিয়ে নতুন রাস্তা হবে, তাই ভেঙ্গে দিচ্ছি। অথচ আমার জমি আমাকেই না জানিয়ে তিনি ভাঙচুর করছেন। এরপর পুলিশ এসে কাজ বন্ধ করে দিয়ে চলে যায়। কিন্তু আমাকেও হুমকি দেয়া হয়। তবে সরকার পতনের পর আর এখানে আসেনি।’
এক ভূক্তভোগি নাম প্রকাশ না করা শর্তে বলেন, মন্টু শরীফ এলাকার ভুমিদস্যু হিসেবেই পরিচিত। তার নাম বললে এক কথায় ভূমিদস্যু হিসেবেই ধরা হয়। তার কারণে নিরহ মানুষ ব্যাপক হয়রানির স্বীকার হয়।দীর্ঘদিন আইনের ফাঁক-ফুকর দিয়ে বের হয়ে গেছে। তবে এবার ছাত্র-জনতার সরকারী বিষয়টি কঠোর নজরদারীতে আনবে বলে মনে করি। তিনি আরও বলেন, তার বিষয়ে যদি গোয়েন্দা সংস্থা অথবা প্রশাসন তদন্ত করে তাহলে শতভাগ এর সত্যতা পাবে।
এসব অভিযোগের বিষয় তার মাদারীপুর পৌর শহরের কলেজ রোড এলাকায় গিয়েও পাওয়া যায়নি। তিনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নিহত সদর উপজেলারর সুচিয়াভাঙ্গা এলাকার শহীদ তাওহীধ সন্নামাত হত্যা মামলার আসামী হওয়ায় এলাকা থেকে গা-ঢাকা দিয়েছে। তার সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। তবে মাদারীপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ভাস্কার সাহা বলেন, ‘যদি তার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট মামলায় ওয়ারেন্ট থাকে, তাহলে দ্রুতই গ্রেফতার করা হবে। তাছাড়া জায়গা-জমি নিয়ে আদালতে মামলা থাকলে কোর্টের ওয়ারেন্ট লাগবে। থানায় অভিযোগ দিলে ব্যবস্থা নেয়া হবে। আর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নিহত তাওহীদ সন্নামাত হত্যা মামলায় মন্টু শরীফকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।’
মাদারীপুরে ক্ষমতার দাপটে ভূমিদখলই ছিল যার নেশা
Leave a comment