মাদারীপুর অফিস : মাদারীপুর জেলার সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হচ্ছে অবৈধ ড্রেজার দিয়ে বিভিন্ন নদ-নদী থেকে বালু উত্তোলন। প্রশাসন থেকে ক্রমাগত অভিযান পরিচালনা করে এবং বালুখেকোদের জেল-জরিমানা করেও থামানো যাচ্ছে না বালু উত্তোলনের দৌরাত্ব। বালু উত্তোলনের কারণে যাদের ফসলি জমি বিলীন হচ্ছে, ঘরবাড়ি নদীগর্ভে চলে গেছে এবং যাচ্ছে, সেইসব ক্ষতিগ্রস্থ সাধারণ মানুষের প্রশ্ন; অবৈধভাবে যারা বালু উত্তোলন করছে, তারা কি প্রশাসনের চেয়েও শক্তিশালী? জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহমান পদ্মা নদীর অংশ, আড়িয়ালখাঁর সদর, রাজৈর, শিবচরের বিস্তীর্ণ ফসলি বাওড়, উৎরাইল, কুমার, নিম্মকুমার, ময়নাকাটা, পালরদি, পিতম্বর বিল, বিলপদ্মাসহ ছোট-বড় নদ-নদীতে দিনেরাতে চলছে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন। বালু উত্তোলন করে বাল্কহেড লোড করে এসব বালু দূর-দূরান্তে নিয়ে বিক্রি করে রাতারাতি কোটিপতি হচ্ছে।
অভিযোগ পাওয়া গেছে, অবৈধ ড্রেজারের কবল থেকে বাদ পড়ছে না বাওড়ের ফসলি জমিও। গত কয়েক বছর ধরে শিবচরের দত্তপাড়া, বাহাদুরপুর, বন্দরখোলা ও পাঁচ্চর ইউনিয়নের বিস্তীর্ণ বাওড়ের ফসলি জমি থেকে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্থরা বাঁধা দিতে গেলে তাদের উপর চড়াও হয় বালুখেকোরা। প্রশাসনের কাছে আবেদন করেও কোন প্রতিকার পাচ্ছে না ভূক্তভোগিরা। দিন দিন আরো বেপরোয়া হয়ে উঠছে তারা। সারা জেলায় শতাধিক ড্রেজার বালু উত্তোলনের কাজে সক্রিয় রয়েছে। পদ্মাসেতুর কাঁঠালবাড়ী ইউনিয়নের কাউলিপাড়া নতুন একটি চ্যানেলে ড্রেজার মেশিন বসিয়ে বালু তোলা হচ্ছে। এই ড্রেজারগুলো নারায়ণগঞ্জ, বরিশাল, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনাসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে ভাড়ায় এনে নদীতে বালু উত্তোলন করা হয়। অভিযানে শ্রমিকেরা আটক হলেও ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে মূল হোতারা। প্রশাসন কয়েক দফায় পদ্মা নদীসহ বিভিন্ন নদ-নদীতে অভিযান চালিয়ে ড্রেজার জব্দ, জড়িতদের আটক এবং জরিমানা করলেও থেমে নেই অবৈধভাবে বালু উত্তোলন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ড্রেজার দিয়ে উত্তোলনকৃত বালু বাল্কহেড দিয়ে বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে খুচরা ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করা হয় এ সকল বালু। রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে বিক্রি হয় এই বালু এবং মাটি। নতুন জেগে ওঠা চর ফসল উৎপাদনের উপযোগী হলেও বালুখেকোদের কবলে পড়ে নিশ্চিহ্ন হচ্ছে ফসলি জমি। অভিযোগ রয়েছে, চরে চাষ করা ফসলসহ জমির মাটি কেটে বিক্রি করে থাকে স্থানীয় প্রভাবশালী মহল। এ বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে জেলা প্রশাসকসহ বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত অভিযোগ দিলেও তেমন কোনো প্রতিকার হয়নি বলেও জানা গেছে, প্রশাসন অভিযান চালালে কিছুদিন বন্ধ থাকে। তবে সুযোগ পেলেই ড্রেজার চালায়।
এলাকাবাসীর অভিযোগে জানা গেছে, শিবচর উপজেলার দত্তপাড়া ও পাঁচ্চর ইউনিয়নের সাদিপুর হতে বটতলা বাহাদুরপুর পর্যন্ত দত্তপাড়ার ৬,৭,৮ এবং ৯নং ওয়ার্ডের ২২ চর বাচামারা ফসলি বাওড়ে গত ৩ বছর ধরে অসাধু ও প্রভাবশালী ব্যক্তিরা যত্রতত্র ড্রেজার বসিয়ে দিন রাত বালু উত্তোলন করছে। এছাড়াও বন্দরখোলা বাওড়, নিম্নভূমির জলাশয়ে এবং চরবাচামারা স্লুইসগেটের উত্তরপাশে মোল্লাবাড়ি ও গিয়াস তালুকদারের বাড়ির পাশে বিভিন্ন স্থানে অবৈধভাবে প্রশাসনের অনুমতি ছাড়াই বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। এতে একদিকে যেমন পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে, অন্যদিকে ফসলি জমি কমে যাচ্ছে। পাশাপাশি আশপাশের মানুষের ঘরবাড়ি পড়েছে হুমকির মুখে। এসব বাওড় এলাকা থেকে ড্রেজার দিয়ে বালু তুলে সাহায্যে পাইপের মাধ্যমে কয়েক কিলোমিটার দূরে নিয়ে মানুষের বাড়ির পাশে খানাখন্দ ভরাট করছে, বড় বড় পুকুর ও নতুন নতুন বাড়িঘর তৈরির জন্য ১০-১৫ লাখ টাকা চুক্তিতে বালু বিক্রি করা হচ্ছে। এলাকার ভূক্তভোগিরা অবৈধভাবে বালু উত্তোলন বন্ধে গত বছর এবং চলতি বছর ১৯জানুয়ারি শিবচর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে লিখিত আবেদন করেও কোন প্রতিকার না পেয়ে গত ২ ফেব্রুয়ারি মাদারীপুর জেলা প্রশাসকের নিকট একটি লিখিত আবেদন করেন। এদিকে ৪ ফেব্রুয়ারি শিবচর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র সমাজের পক্ষে জেলা প্রশাসকের নিকট বালু উত্তোলন বন্ধে একটি লিখিত আবেদন করা হয়। পরে জেলা প্রশাসকের নির্দেশে শিবচর উপজেলা প্রশাসন ও পুলিশ যৌথ অভিযানে নামে।
বন্দরখোলা ফসলি বাওড় থেকে বালু উত্তোলনে ক্ষতিগ্রস্থ মো: সামসুল হক মিয়া বলেন, ‘প্রশাসন ইচ্ছে করলে কঠোরভাবে অবৈধ ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলন পুরোপুরি বন্ধ করে মানুষের ফসলি জমি ও ঘরবাড়ি রক্ষা করতে পারে। মাঝে মধ্যে দুই একটি অভিযান চালিয়ে কিছু মানুষকে আটক করে অর্থদন্ড করে ছেড়ে দেয়। এতে তাদের সাহস আরো বেড়ে যায় এবং বালুদস্যুরা জরিমানা দিয়ে দুই-একদিন বন্ধ রেখে পূণরায় পুরোদমে দিনরাত বালু উত্তোলন শুরু করে। আমাদের প্রশ্ন তাহলে কি অবৈধ বালু উত্তোলনকারিরা প্রশাসনের চেয়েও শক্তিশালী?’
শিবচর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. রতন শেখ পিপিএম বলেন, ‘সম্প্রতি শিবচর থানার পুলিশ এবং শিবচর উপজেলার সহকারি কমিশনার (ভূমি) ও (এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট) বাহাদুরপুর বালুমহলে যৌথ অভিযান চালিয়ে ৪জনকে আটক করি। পরে সহকারি কমিশনার (ভূমি) ও (এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট) শাইখা সুলতানা ভ্রাম্যমান আদালতের মাধ্যমে ৪জনের মধ্যে ২জনকে ১লাখ ৮০হাজার টাকা জরিমানা করে একজনকে ৭দিনের সাজা দিয়েছেন।’
ভ্রাম্যমান আদালতের বিচারক শিবচর উপজেলার সহকারি কমিশনার (ভূমি) (এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট) শাইখা সুলতানা বলেন, ‘আটকৃত ৪ জনের মধ্যে একজন ১ লাখ টাকা, একজনকে ৮০ হাজার টাকা জরিমানা ও ৭ দিনের জেল দেয়া হয়েছে। বাকী ২জনকে শ্রমিক বিবেচনায় ছেড়ে দেয়া হয়েছে। অভিযোগ পেলে আমরা আবারও অভিযানে নামবো।’
মাদারীপুরে জেল-জরিমানার পরও থামছে না অবৈধ বালু উত্তোলন

Leave a comment