জন্মভূমি ডেস্ক : গত মে মাসে দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৮৯ শতাংশে। গ্রামে এ হার ৯ দশমিক ৯৯ শতাংশ। এর আগে এপ্রিলে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৭৪ শতাংশ। গত মাসে দেশে খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমলেও পৌনে ১১ শতাংশের ওপরে উঠেছে খাদ্য মূল্যস্ফীতি, যা দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতিকে নিয়ে গেছে ১০ শতাংশের কাছাকাছি। খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব পড়েছে দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতিতে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, মে মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০ দশমিক ৭৬ শতাংশে, যা আগের মাসে ছিল ১০ দশমিক ২২ শতাংশ। গত বছরের মে মাসে তা ছিল ৯ দশমিক ২৪ শতাংশ।
চলতি অর্থবছরের শুরুতে মূল্যস্ফীতিকে ৬ শতাংশের মধ্যে আটকে রাখার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিল সরকার। কিন্তু নানা পদক্ষেপ নিয়েও তা কোনোভাবেই ৯ শতাংশের নিচে নামানো যায়নি। দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে রয়েছে টানা ২৪ মাস ধরে। গত ১২ মাসের গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৭৩ শতাংশ।
এদিকে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে অর্থবছরের শুরু থেকেই একের পর এক পদক্ষেপ নেয় সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত বছরের জুন পর্যন্ত দেশে ব্যাংক ঋণের সর্বোচ্চ সুদহার ছিল ৯ শতাংশ। এর পর ২০২৩-২৪ অর্থবছরের শুরুর মাস জুলাইয়ে সুদহার নির্ধারণে সিক্স মান্থস মুভিং অ্যাভারেজ রেট অব ট্রেজারি বিল বা ‘স্মার্ট’ পদ্ধতি গ্রহণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে সুদহার ক্রমাগত বেড়ে গত এপ্রিলের মধ্যে উন্নীত হয় ১৩ দশমিক ৫৫ শতাংশে। এর পরও মূল্যস্ফীতি না কমায় সুদহার বাজারভিত্তিক করে দেয়া হয়। বর্তমানে তা আরো বেড়ে ১৫ শতাংশের কাছাকাছি পৌঁছলেও নিয়ন্ত্রণে আসেনি মূল্যস্ফীতি।
আবার সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির অংশ হিসেবে টাকা ছাপিয়ে সরকারকে ঋণ প্রদানের নীতি থেকেও সরে এসেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বাজার নিয়ন্ত্রণে কয়েক দফায় নির্দিষ্ট কিছু নিত্যপণ্যের দরও নির্ধারণ করে দেয়া হয়। মজুদদারি নিয়ন্ত্রণে বারবার অভিযানেও নামে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এসব চেষ্টার পরও দেশে মূল্যস্ফীতির হার নিয়ন্ত্রণে আনা যায়নি। চলতি অর্থবছরের মতো আসন্ন বাজেটেও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়ার কথা বলছেন সরকারের নীতিনির্ধারকরা।
তবে সরকারের মুদ্রানীতির প্রভাব বাজারে পড়তে সময় লাগবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। তাদের মতে, মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সার্বিক অর্থনীতির শৃঙ্খলা ও সুশাসন জড়িত। আবার ডলার সংকটে সরকারের খাদ্য আমদানি কমে এসেছে। ফলে খাদ্য মজুদ কমে যাওয়ায় মূল্যস্ফীতিতে প্রভাব পড়ছে। তাই দ্রুত সময়ের মধ্যে খাদ্য আমদানির নীতি গ্রহণের পরামর্শ দিচ্ছেন অর্থনীতিবিদরা।
এ বিষয়ে ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও অর্থনীতিবিদ ড. এ কে এনামুল হক বলেন, ‘বোরো মৌসুমে শিলাবৃষ্টিতে ফসলের ক্ষতি হয়। আবার ডলার সংকটের কারণে সরকার চাল আমদানি করেনি। তাই চালের মজুদ কমে এসেছে। এতদিনে চাল আমদানি করা উচিত ছিল। মজুদ না বাড়ালে মূল্যস্ফীতি ক্রমাগত বাড়তে থাকবে।’
বিবিএসের তথ্যমতে, গত ডিসেম্বরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৫৮ শতাংশ। নভেম্বরে ছিল ১০ দশমিক ৭৬ শতাংশ। পাঁচ মাসের ব্যবধানে গত এপ্রিলে তা আবারো ১০ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। মে মাসে আরো বেড়ে হয় ১০ দশমিক ৭৬ শতাংশ। এ সময় গ্রামাঞ্চলে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ দশমিক ৭৩ আর শহরে ১০ দশমিক ৮৬ শতাংশ।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে মুদ্রানীতি ব্যবহারের মাধ্যমে সুদহার বৃদ্ধির পদক্ষেপ দেরিতে নেয়া হয়েছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) জ্যেষ্ঠ গবেষক ড. তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন, ‘মুদ্রানীতির পদক্ষেপ তাৎক্ষণিক কার্যকর হয় না; সময় লাগে। এর সঙ্গে আবার দেশের সার্বিক অর্থনীতির সুশাসন ও শৃঙ্খলা নিশ্চিত করার বিষয় জড়িত। প্রাতিষ্ঠানিক কিছু দুর্বলতার বিষয় রয়েছে। তাই সরকারের এখন সামাজিক সুরক্ষা খাতে বাজেট বাড়ানোর দিকে নজর দেয়া উচিত।’
এদিকে বাজারে ডিম, মুরগি, পেঁয়াজ, আদা-রসুনসহ বিভিন্ন সবজি ও নিত্যপণ্যের দাম আরো বাড়ছে। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) বাজারদর বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এক মাসের ব্যবধানে পেঁয়াজের দাম কেজিতে বেড়েছে ১০-১৫ টাকা। রসুনের দামও বেড়েছে কেজিতে ২০-৪০ টাকা। ডিমের হালি বিক্রি হচ্ছে ৫০-৫৫ টাকায়, যা এক মাস আগেও পাওয়া যেত ৪০-৪২ টাকায়। দাম বেড়েছে ব্রয়লারেরও।
নিত্যপণ্যের মূল্য সহনীয় রাখতে মধ্যবিত্তদেরও টিসিবির মাধ্যমে পণ্য দেয়ার কথা বলছেন সরকারের নীতিনির্ধারকরা। এ বিষয়ে গত রোববার বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আগামী অর্থবছর থেকে স্থায়ী দোকানের মাধ্যমে টিসিবির পণ্য সাধারণ মানুষের হাতে তুলে দেয়ার চেষ্টা চলছে। পাশাপাশি আগামীতে মধ্যবিত্তদেরও ন্যায্যমূল্যে টিসিবির পণ্য সরবরাহ করার পরিকল্পনা রয়েছে।’
বিবিএস প্রকাশিত তথ্যে দেখা গেছে, দেশের গ্রামাঞ্চলে গত মাসে মূল্যস্ফীতির হার ছিল শহরের তুলনায় বেশি। মে মাসে শহরে সাধারণ মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৭২ আর গ্রামে ৯ দশমিক ৯৯ শতাংশ। এ সময় শহরে খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক শূন্য ৩ আর গ্রামাঞ্চলে ৯ দশমিক ৩১ শতাংশ।
মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী মো. শহীদুজ্জামান সরকার বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকার প্রচলিত ধারার কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছে। মুদ্রানীতিসহ নানা পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। যা যা প্রয়োজন আমরা করব। আমাদের ফসল উৎপাদনও ভালো হয়েছে। সব মিলিয়ে গৃহীত পদক্ষেপের সুফল পাব বলে আশা করছি।’
প্রধান সম্পাদক: লে. কমান্ডার (অব.) রাশেদ ইকবাল, প্রকাশক আসিফ কবীর কর্তৃক জন্মভূমি প্রকাশনী লি: ১১০/২,সাংবাদিক হুমায়ুন কবীর বালু সড়ক, খুলনা থেকে মূদ্রিত ও প্রকাশিত