
সাতক্ষীরা প্রতিনিধি : ছিল ভারত উপমহাদেশের একটি ঐতিহাসিক সাম্রাজ্য । উপমহাদেশের অধিকাংশ অঞ্চলজুড়ে মুঘল সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি ছিল । মুঘল সাম্রাজ্য পারস্যের ভাষা শিল্প ও সংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবিত ছিল । সমসাময়িকরা বাবরের প্রতিষ্ঠিত সাম্রাজ্যকে তিমুরি সাম্রাজ্য বলে উল্লেখ করেছেন যা মুঘলরা নিজেরাও ব্যবহার করত । আইন ই আকবরিতে হিন্দুস্তান নামটি উল্লেখ রয়েছে । পাশ্চাত্যে মুঘল শব্দটি সম্রাট ও বৃহৎ অর্থে সাম্রাজ্য বোঝাতে ব্যবহৃত হত । আরবি এবং ফারসি থেকে মুঘল শব্দটি এসেছে । তবে বাবরের পূর্বপুরুষরা সাবেক মঙ্গোলদের চেয়ে ফারসি সংস্কৃতি দ্বারা বেশি প্রভাবিত ছিলেন । জ্বলপথে প্রথম যুদ্ধে ইবরাহিম লোদির বিরুদ্ধে বাবরের জয়ের মাধ্যমে মুঘল সাম্রাজ্যের সূচনা ঘটে । মুঘল সম্রাটরা ছিলেন মূলত মধ্য এশিয়ার তুর্কি মঙ্গোল বংশোদ্ভূত । এরা চাগতাই খান এবং তৈমুরের মাধ্যমে নিজেদের চেঙ্গিস খানের বংশধর বলে দাবি করতেন । ১৫৫৬ সালে মুঘল সাম্রাজ্যের ধ্রুপদি যুগ শুরু হয় । আকবর এবং তার ছেলে জাহাঙ্গীরের শাসনামলে ভারতে অর্থনৈতিক প্রগতি বহুদূর অগ্রসর হয় । আকবর অনেক হিন্দু রাজপুত রাজ্যের সাথে মিত্রতা করেন । কিছু রাজপুত রাজ্যের উত্তর পশ্চিম ভারতে মুঘলদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ জারি রাখে কিন্তু আকবর তাদের বশীভূত করেন । মুঘল সম্রাটরা মুসলিম থাকলেও জীবনের শেষের দিকে শুধুমাত্র সম্রাট আকবর এবং তার পুত্র সম্রাট জাহাঙ্গীর নতুন ধর্ম দীন ই-ইলাহির অনুসরণ করতেন ।
মুঘল সাম্রাজ্য স্থানীয় সমাজে হস্তক্ষেপ করতেন না তবে তারা প্রশাসনিকভাবে এসববের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করতেন । তারা অনেক বেশি কাঠামোগত ভাবে কেন্দ্রীভূত শাসন প্রতিষ্ঠা করেন । মুঘল শাসনামলে উত্তর ও পশ্চিম ভারতের বিভিন্ন সমাজ গোষ্ঠী যেমন মারাঠা, রাজপুত ও শিখরা সামরিক শক্তি অর্জন করেন ।
শাহজাহানের যুগে মুঘল স্থাপত্য এর স্বর্ণযুগে প্রবেশ করে । তিনি অনেক স্মৃতিসৌধ, মসজিদ, দুর্গ নির্মাণ করেন যার মধ্যে রয়েছে আগ্রার তাজমহল, মোতি মসজিদ, লালকেল্লা, দিল্লি জামে মসজিদ । আওরঙ্গজেবের শাসনামলে মুঘল সাম্রাজ্যের সীমানা সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে যায় । শিবাজী ভোসলের অধীনে মারাঠাদের আক্রমণের ফলে সাম্রাজ্যের অবনতি শুরু । আওরঙ্গজেবের সময় দক্ষিণ ভারত জয়ের মাধ্যমে ৩.২ মিলিয়ন বর্গ কিলোমিটারের বেশি অঞ্চল মুঘল সাম্রাজ্যের অন্তর্গত হয় । ততকালিন সাম্রাজ্যের জনসংখ্যা ছিল ১৫০ মিলিয়নের বেশি যা ততকালীন পৃথিবীর জনসংখ্যার প্রায় এক চতুর্থাংশ এবং জিডিপি ছিল ৯০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি ছিল । ১৮শ শতাব্দীর মধ্যভাগ নাগাদ মারাঠারা মুঘল সেনাবাহিনীর বিপক্ষে সফলতা লাভ করেন এবং দক্ষিণাত্য থেকে বাংলা পর্যন্ত বেশ কিছু মুঘল প্রদেশে বিজয়ী হন । সাম্রাজ্যের প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক প্রক্রিয়ার দুর্বলতার কারণে আভ্যন্তরীণ অসন্তোষ সৃষ্টি করে যার ফলে বিভিন্ন প্রদেশ কার্যত স্বাধীন হয়ে যায় । ১৭৩৯ সালে কারনালের যুদ্ধে নাদির শাহের বাহিনীর কাছে মুঘলদের পরাজয় ঘটে । ততকালিন সময় দিল্লি লুন্ঠিত হয় । পরের শতাব্দীতে মুঘল শক্তি ক্রমান্বয়ে সীমিত হয়ে পড়েন ও শেষ মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহের কর্তৃত্ব শুধু শাহজাহানাবাদ শহরে সীমাবদ্ধ হয়ে যায় । সিপাহী বিদ্রোহের সমর্থনে তিনি একটি ফরমান জারি করেন । সিপাহী বিদ্রোহ ব্যর্থ হলে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তার বিরুদ্ধে রাজদ্রোহীতার অভিযোগ এনে কারাবন্দী করেন । শেষে তিনি রেঙ্গুনে নির্বাসিত হন এবং সেখানেই মারা যান ।
বাবর মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন । তিনি ছিলেন মধ্য এশিয়ার তুর্কি মঙ্গোল বংশোদ্ভূত শাসক । বাবার দিক থেকে তিনি তৈমুর লং এবং মায়ের দিক থেকে চেঙ্গিস খানের বংশধর ছিলেন । মধ্য এশিয়া থেকে বিতাড়িত হয়ে বাবর ভারতে ভাগ্য নির্মাণে নিয়োজিত হন । তিনি নিজেকে কাবুলের শাসক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন এবং আফগানিস্তান থেকে খাইবার পাস হয়ে ভারতে প্রবেশ করেন । জ্বলপথের যুদ্ধে বিজয়ের পর বাবরের সেনাবাহিনী উত্তর ভারতের অধিকাংশ এলাকা জয় করে নেয় । তবে তার শাসন কাজে পাকাকোক্ত হতে অনেক সময় লেগে যায় । অস্থিতিশীলতা তার ছেলে হুমায়ুনের সময়ও ছড়িয়ে পড়েছিল । হুমায়ুন ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ভারত থেকে পারস্য পালিয়ে যায় । হুমায়ুনের সাথে পারস্যের সাফাভিদের কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয় এবং মুঘল সাম্রাজ্যে পারস্যের সাংস্কৃতিক প্রভাব বৃদ্ধি শুরু হয় । পারস্যের সহায়তায় হুমায়ুন মুঘলদের ক্ষমতা পুনরায় প্রতিষ্ঠা করে । এর অল্পসময় পরে দুর্ঘটনায় হুমায়ুনের মৃত্যু হলে তার ছেলে আকবর অপ্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় সিংহাসনে বসেন । আকবরের অভিভাবক বৈরাম খান ভারতে মুঘল সাম্রাজ্যের ভিত্তি মজবুত করতে আকবরকে সহায়তা করেন । যুদ্ধ এবং কূটনীতির মাধ্যমে আকবর সাম্রাজ্যকে সবদিকে ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয় । তিনি ভারতের সামাজিক গোষ্ঠীর সামরিক অভিজাতদের থেকে তার প্রতি অনুগত নতুন অভিজাত শ্রেণী গড়ে তোলেন । তিনি উন্নত সরকার ব্যবস্থা ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নে বহু অবদান রেখেছেন । আকবর ইউরোপীয় বাণিজ্য কোম্পানিগুলোর সাথে বাণিজ্য বৃদ্ধি করেন । বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের পার্থক্য দূর করার জন্য আকবর দীন ই ইলাহি নামক নতুন ধর্ম তৈরি করেন । তবে এই ধর্ম প্রসিদ্ধ হয়নি । আকবরের ছেলে সম্রাট জাহাঙ্গীর সমৃদ্ধির সাথে শাসন করেন । তবে জাহাঙ্গীর আফিমে আসক্ত ছিলেন এবং রাষ্ট্রীয় কাজে অনীহা দেখায় এবং দরবারের বিদ্রোহীদের প্রভাবে পড়ে । তার ছেলে শাহজাহানের শাসনকাল মুঘল দরবারের জাকজমকের জন্য প্রসিদ্ধ । এসময় অনেক বিলাসবহুল ইমারত নির্মিত হয় যার মধ্যে তাজমহল ছিল অন্যতম । এসময় দরবারের রাজস্ব আয়ের চেয়ে রক্ষণাবেক্ষণের খরচ বেশি ছিল । শাহজাহানের অসুস্থতার পর তার বড় ছেলে দারা শিকোহ অভিভাবক হন । সিংহাসন নিয়ে শাহজাহানের ছেলেদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বীতায় অন্যান্যদের পরাজিত করে শেষপর্যন্ত আওরঙ্গজেব জয়ী হন । দারা শিকোহকে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয় । আওরঙ্গজেব শাহজাহানকে শাসনের অযোগ্য ঘোষণা করে বন্দী করেন । আওরঙ্গজেবের সময় মুঘল সাম্রাজ্যের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব অনেক বৃদ্ধি পায় । তিনি প্রায় সমগ্র দক্ষিণ এশিয়া মুঘল সাম্রাজ্যের সরাসরি অধীনে নিয়ে আসেন । ১৭০৭ সালে তার মৃত্যুর পর সাম্রাজ্যের অনেক অংশ বিদ্রোহ করতে শুরু করে । আওরঙ্গজেবের ছেলে প্রথম বাহাদুর শাহ প্রশাসন সংস্কার করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন । তবে ১৭১২ সালে তার মৃত্যুর পর মুঘল সাম্রাজ্য বিশৃঙ্খল অবস্থায় পড়ে । ১৭১৯ সালে চারজন সম্রাট পরপর শাসন করেন । একটি সময় মুহাম্মদ শাহের শাসনামলে সাম্রাজ্য ভেঙে পড়তে শুরু করে । মধ্য ভারতের অধিকাংশ মারাঠা সাম্রাজ্যের হাতে চলে যায় ।
নাদির শাহ দিল্লি আক্রমণ করেন এবং এতে মুঘল শক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে । সাম্রাজ্যে অনেক স্বাধীন রাজ্যের উদ্ভব হয় । তবে মুঘল সম্রাটকে সর্বোচ্চ শাসক হিসেবে বিবেচিত করা হত । সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলম মুঘল কর্তৃত্ব পুনপ্রতিষ্ঠার জন্য প্রচেষ্টা চালান । কিন্তু তাকে বাইরের শক্তির উপর নির্ভর করতে হয় । এদের মধ্যে ছিলেন আফগানিস্তানের আমির আহমেদ শাহ আবদালি । ১৭৬১ সালে আবদালির নেতৃত্বাধীন আফগান এবং মারাঠা সাম্রাজ্যের মধ্যে পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধ সংঘটিত হয় । ১৭৭১ সালে মারাঠারা আফগানদের কাছ থেকে দিল্লি পুনর্দখল করে নেয় এবং ১৭৮৪ সালে তারা আনুষ্ঠানিকভাবে দিল্লিতে সম্রাটের রক্ষক হয়ে উঠেন । তৃতীয় ইঙ্গ মারাঠা যুদ্ধের আগ পর্যন্ত এই অবস্থা বজায় রাখেন বা তা ছিল । তারপর ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি মুঘল রাজবংশের রক্ষক হন । সিপাহী বিদ্রোহের ব্যর্থতার পর শেষ মুঘল সম্রাটকে ক্ষমতাচ্যুত করে নির্বাসনে পাঠান । এরপর ইংল্যান্ডের রাণী ভিক্টোরিয়াকে ভারত সম্রাজ্ঞী ঘোষণা করা হয় । ইতিহাসবিদদের মতে মুঘল সাম্রাজের পতনের বেশ কিছু কারণ আছে । অর্থনৈতিক দিক থেকে সাম্রাজ্যে প্রধান অফিসার আমিরদের বেতন দিতে প্রয়োজনীয় তেমন রাজস্ব ছিল না । আঞ্চলিক শাসকদের উপর সম্রাট নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন । সেনাবাহিনীকে অধিক মাত্রায় আগ্রাসী মারাঠাদের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিনব্যপী চলমান যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে হয় ফলে তারা মনোবল হারিয়ে ফেলেন । ফররুখসিয়ারের মৃত্যুর পর স্থানীয় শাসকরা ক্ষমতা নিতে শুরু করেন । ইতিহাসবিদরা বেশ কয়েকভাবে পতনকে ব্যাখ্যা করেছেন । মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যায় দেখা যায় উচ্চশ্রেণীর মধ্যে অসাধুতা অত্যধিক বিলাসিতা এবং সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি শাসকদের বাহ্যিক হুমকির ব্যাপারে অপ্রস্তুত করে তোলে । একটী মার্ক্সবাদি মতানুযায়ী ধনীদের হাতে কৃষকদের নিপীড়নের কারণে শাসনের প্রতি জনসমর্থন কমে যায় । আরেকটি মতানুযায়ী হিন্দু ধনী সম্প্রদায় মুঘল সাম্রাজ্যের বদলে মারাঠা ও ব্রিটিশদের অর্থসহায়তা প্রদান করে । ধর্মীয় দিক থেকে বিচারে বলা হয় হিন্দু রাজপুতরা মুসলিম শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন । তবে চূড়ান্ত মত হিসেবে অন্যান্য পন্ডিতরা বলেন যে সাম্রাজ্যের অত্যধিক সমৃদ্ধি প্রদেশগুলোকে অধিক মাত্রায় স্বাধীনতা অর্জনে উৎসাহ যোগায় এবং রাজ দরবারকে দুর্বল করে তোলে ।
কক্সবাংলা ডটকম(৮ নভেম্বর) :: কৃষকরা একদিকে যেমন মাটির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ একইভাবে ঘনিষ্ঠ উৎপাদন প্রক্রিয়ার সঙ্গে। দক্ষিণ এশিয়ার মতো কৃষিপ্রধান অঞ্চলে কৃষিকে কেন্দ্র করে গঠিত হয় জীবনাচার ও অর্থনীতি। ফলে মোগল সাম্রাজ্যের গতি প্রকৃতি বুঝতে সে সময়ের কৃষি ও কৃষকের অবস্থা পর্যালোচনা করা জরুরি।
সতেরো শতকে ভারতীয় উপমহাদেশের গ্রামগুলো কয়েক ভাগে বিভক্ত ছিল। আবার গ্রামীণ কৃষক সমাজও বিভক্ত ছিল কয়েক ভাগে। ইতিহাসবেত্তারা মোগল আমলের গ্রামীণ সমাজকে তিনটি আলাদা ভাগে ভাগ করেছেন। যারা উঁচু স্তরের কৃষক ছিলেন, তাদের ‘মালিক-ই-জমিন’ কিংবা ভূমির মালিক হিসেবে ডাকা হতো; যারা ভূমির প্রকৃত মালিক হিসেবে বিবেচিত হতেন।
দ্বিতীয় শ্রেণীর যারা ছিলেন তাদের বলা হতো ‘পাহি’ বা ‘উপারি’, যারা ছিলেন বইরে থেকে আসা। তারা গ্রামে গ্রামে কৃষিকাজের খোঁজ করতেন, কাজ পেলে সেখানে তারা কাজ করতেন। কাজের খোঁজে ভিন্ন ভিন্ন গ্রামে তারা যেতেন। তৃতীয় শ্রেণীর ব্যক্তিরা মালিক-ই-জমিন বা ভূমির মালিকদের থেকে শস্যের ভাগ বিনিময়ের দ্বারা জমি নিতেন।
এছাড়া ভূমিহীন কিছু কৃষক ছিলেন। তাদের অনেকেই চর্মকার, কুমার ও ধোপা ছিলেন। এ শ্রেণীর মানুষ কৃষকদের বিভিন্ন প্রয়োজনীয় কাজ করে দিতেন এবং শস্য ফলানোর পর কৃষক মজুরি হিসেবে কিছু শস্য তাদের প্রদান করতেন।
সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলে ফ্রান্সিসকো পেলসার্ট নামে একজন ওলন্দাজ পর্যবেক্ষক মন্তব্য করেছিলেন, ‘সাধারণ মানুষ এতটাই দারিদ্র্যের মধ্যে বাস করে যে তাদের জীবনের ছবি বা নিখুঁত বিবরণ দিলে বলতে হয় এ জীবন শুধু এক তীব্র অভাব ও নিদারুণ দুঃখের বাসভূমি।’ কৃষকরা ছিলেন এ জনগোষ্ঠীর মধ্যে অন্যতম। কৃষকদের সাধারণ ভোগ্য ও ব্যবহৃত জিনিসপত্রের বিবরণ দিতে গেলে আমাদের চোখে ভেসে উঠবে এমন কিছু মানুষের বেঁচে থাকার সংগ্রাম, যারা টিকে থাকার জন্য সর্বনিম্ন প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র জোগাড় করতে সক্ষম হতেন।
কৃষকদের খাদ্যাভ্যাস কেমন ছিল তা খুঁজতে গেলে তাদের খাদ্যতালিকা আমাদের পরিষ্কার দিকনির্দেশনা দিতে পারে। বাংলা, ওড়িশা, সিন্ধু ও কাশ্মীরের প্রধান শস্য ছিল চাল। স্বভাবতই ধারণা করা যায়, এসব অঞ্চলে চালই সাধারণ মানুষের প্রধান খাদ্য। গুজরাটের বেলায় ছিল জোয়ার ও বাজরা। কিন্তু চাষীদের উৎপন্ন ফসলের মধ্যে সবচেয়ে নিচু মানের ফসলই নিজেদের পরিবারের জন্য রাখতে হতো।
কাশ্মীরে সাধারণ মানুষের খাদ্য ছিল মোটা চালের ভাত এবং বিহারের কৃষকরা বাধ্য হতেন মটরশুঁটির দানার মতো খেসারি খেতে। ফলে তাদের মধ্যে নিত্য অসুখবিসুখ লেগে থাকত। সবচেয়ে ভালো গম উৎপন্ন হতো আগ্রা ও দিল্লি অঞ্চলে। কিন্তু এ গম তাদের পেটে জুটত না। সাধারণ মানুষের খাদ্যতালিকায় তাদের উৎপন্ন গম থাকত না, বরং তাদের খেতে হতো চাল ও ডাল। বিশেষ করে আগ্রার শ্রমিকদের বর্ণনা প্রসঙ্গে ইতিহাসবিদরা বলেন, তাদের একঘেয়ে দৈনিক খাদ্যের মধ্যে অল্প একটু খিচুড়ি ছাড়া আর কিছু ছিল না।
এটি তৈরি হয় কাঁচা ডালের সঙ্গে চাল মিশিয়ে। সন্ধ্যায় মাখন দিয়ে খাওয়া হয়। দিনের বেলা তারা অল্প শুকনো ডাল বা অন্য শস্য চিবোয়, যা তাদের ধারণা অনুযায়ী তাদের রোগা পেটের পক্ষে যথেষ্ট ছিল। খাদ্যশস্যের সঙ্গে গ্রামের চাষীরা খেতেন সাধারণত অল্প কিছু সবজি ও আনাজ। বাংলা, ওড়িশা, সিন্ধু বা কাশ্মীরের বেশির ভাগ লোক পাশাপাশি মাছ খেত। ধর্মীয় বাধানিষেধ (গো-হত্যা ও শুয়োর পালনের বিরুদ্ধে) ও দারিদ্র্যের দরুন চাষীরা মাংস খেতে পারতেন না বললেই চলে।
তবে মোগল আমলে মাথাপিছু ঘি উৎপাদন বেশি ছিল। আগ্রা অঞ্চলে, বাংলা ও পশ্চিম ভারতে প্রধান খাদ্যের সঙ্গে সবসময় ঘি থাকত। আসামের লোকের সঙ্গে আবার ঘির কোনো সম্পর্কই ছিল না। বস্তুটিকে তারা প্রচণ্ড ঘৃণার চোখে দেখত। কাশ্মীরের মানুষে পানি দিয়েই রান্না করত। আখরোট, তেল ও ঘি ছিল তাদের কাছে বড়লোকি ব্যাপার। তাভারনিয়ে বলেছেন, ‘ছোটো ছোটো গ্রামেও তরল মিষ্টিজাতীয় জিনিস পর্যাপ্ত পরিমাণে পাওয়া যেতো।’
এ থেকে এটা পরিষ্কার হয়, গ্রামগুলোয় মিষ্টির চাহিদা হিসেবে গুড় খাওয়ার রেওয়াজ ছিল। আবার লবণ খাওয়া নিয়ে ইতিহাসবিদ মোরল্যান্ড দেখিয়েছেন, বাংলায় নুন ছিল খুবই দুষ্প্রাপ্য ও দুর্মূল্য। বাংলার কোনো কোনো অংশে এবং আসামে মানুষ বাধ্য হয়ে ব্যবহার করত কলাগাছের গোড়া পুড়িয়ে এক ধরনের উৎকট বস্তু; এর মধ্যে অবশ্য কিছু পরিমাণ নুন পাওয়া যেত। গোলমরিচ কিংবা কাঁচালঙ্কা এখন যেকোনো পরিবারেই রান্নার জন্য ব্যবহার হয়, কিন্তু সে সময়ের মানুষ এর সঠিক ব্যবহার সম্পর্কে জানত না। পাশাপাশি অন্যান্য মসলা (জিরা, ধনে, আদা) কৃষকদের নাগালে ছিল।
কৃষকরা সাধারণত কী ধরনের কাপড় পরিধান করতেন সে সম্পর্কে অল্পস্বল্প জানা গেলেও কোনো রকম লজ্জাস্থান নিবারণ করার জন্য কৃষকের কাছে সামান্য পরিমাণ কাপড়চোপড় থাকত। পায়ে দেয়ার মতো তাদের কোনো জুতা বা স্যান্ডেল থাকত না। ফলে খালি পায়ে তারা চলাফেরা করতেন। মোগল আমলে হিন্দুস্তানে অর্থাৎ ‘বেরা থেকে বিহার’ পর্যন্ত এলাকায় কৃষকদের পরিধেয় বস্তু নিয়ে মোগল সম্রাট বাবুর মন্তব্য করেছেন, চাষী ও গরিব লোকেরা সম্পূর্ণ খালি পায়ে থাকে আর লঙ্গুটা দিয়ে লজ্জা নিবারণ করে। লঙ্গুটা নাভির নিচে বাঁধা দুই বিঘত পরিমাণ ঝোলা কাপড়। এ ঝোলা কাপড়ের গ্রন্থির নিচ থেকে আরেক টুকরো কাপড় দুই ঊরুর মাঝখান দিয়ে শক্ত করে বেঁধে রাখা হয়।
মেয়েরাও লুঙ্গ নামে একধরনের কাপড় পরে, যার অর্ধেক কোমরে জড়ানো থাকে এবং বাকিটা মাথার ওপর তুলে দেয়া হয়। অন্যভাবে বলা যায়, পুরুষদের সবচেয়ে ছোটো ধুতি ও মেয়েদের একটি শাড়িই ছিল যথেষ্ট এবং তারা আর কিছুই পরত না। একইভাবে পরবর্তী শতকে আগ্রার এক ইংরেজ কুঠিয়াল মন্তব্য করেছেন, সাধারণ লোক এত গরিব যে তাদের বেশির ভাগই লিনেন কাপড় দিয়ে শরীরের গোপন অঙ্গ ঢাকা ছাড়া প্রায় নগ্ন হয়েই থাকে।
বেনারস সম্বন্ধে একই কথা বলতে গিয়ে ফিচ যোগ করেছেন, শীতকালে পশমের বদলে মানুষের পরিচ্ছদ ছিল আমাদের তোষক ও তুলো ভরা টুপির মতো একধরনের সুতি কাঁথার ঢোলা পোশাক। বাংলার মানুষ এর চেয়েও কম কাপড় পরিধান করত বলে মন্তব্য করেছেন আবুল ফজল। বিভিন্ন গ্রন্থে এটা উল্লেখ রয়েছে যে কাশ্মীরে সুতার কাপড় একেবারেই পরা হতো না; পুরুষ ও নারী উভয়ই ‘পাত্তু’ নামে গোড়ালি পর্যন্ত নেমে আসা একটি পশমের পোশাক না ধুয়ে তিন-চার বছর পরত। পুরোপুরি ছিঁড়ে না যাওয়া পর্যন্ত এটি গায়েই থাকত।
গুজরাটের মেয়েদের জামাকাপড় ছিল কাঁধের ওপর বেল্টের মতো ঢিলা করে বাঁধা ও ছোট ব্রিচেসের ধরনের পায়ের মাঝে জড়ানো একটি লুঙ্গি আর একটি ছোট কাঁচুলি। তাদের জামাকপড় বলতে এ দুটোই এবং সবসময় তারা জুতো-মোজা ছাড়াই চলাফেরা করত। তুলা উৎপাদনকারী বিশাল মোগল দক্ষিণাঞ্চল সম্বন্ধে কোনো নির্দিষ্ট তথ্য না থাকলেও অবস্থা সম্ভবত সেখানেও ছিল একই রকম। আবার দক্ষিণ দিকে অর্থাৎ গোলকুণ্ডা ও দক্ষিণ ভারতের কাছাকাছি জামাকাপড়ের স্বল্পতা খুব বেশি করে চোখে পড়ত। কৃষকদের বাসস্থান নিয়ে পাওয়া তথ্যগুলোর ওপর দ্রুত চোখ বুলিয়ে নেয়া যায়।
দেখা যায়, ভারতের বেশির ভাগ অঞ্চলের মতো বাংলার সাধারণ কুঁড়েঘরকে বলা হয়েছে খুবই ছোট ও খড় দিয়ে ছাওয়া। কাঠ, বাঁশ ও খড় দিয়ে কুঁড়েঘরই কৃষকদের কুঁড়েঘর। মাটি খুঁড়ে কাদার ভিতের ওপর দড়ি দিয়ে একসঙ্গে বাঁশ বেঁধে এগুলো তৈরি হতো। ওড়িশায় দেয়াল তৈরি হতো নলখাগড়া দিয়ে। বিহারে বেশির ভাগ বাড়িরই চাল ছিল টালির। দোআবে চাষীদের কুঁড়েগুলো কোনো রকমে খড়ে ছাওয়া ও মাটির দেয়াল দিয়ে ঘেরা বলে বর্ণনা করা হয়েছে। বলা হয়েছে, সিন্ধু নদীর তীরে গ্রামগুলোয় ছিল কাঠ ও খড়ের বাড়ি।
আজমীর প্রদেশে কৃষকরা তাঁবুর ধাঁচে তৈরি বাঁশের কুঁড়েতে বাস করতেন। সিরোঞ্জের (মালব) কাছাকাছি কৃষকরা বাস করতেন ছোট গোল কুঁড়ে ও ঝুপড়িতে। গুজরাটের বাড়িগুলোয় ছিল টালির চাল এবং প্রায়ই সেগুলো ইট ও চুন দিয়ে তৈরি হতো। আবার, খান্দেশ ও বিহারে কুঁড়েগুলোর দেয়াল ছিল মাটির ও খড়ে ছাওয়া। সে সময়ে কুঁড়েগুলো কোনো রকম স্থাপত্যকৌশল ছাড়াই সবচেয়ে সহজলভ্য জিনিস দিয়েই তৈরি হয়। এ থেকে বলা যায়, ব্যবহৃত উপাদান, জলবায়ু ও মাটিই এখনকার সব রকমের আঞ্চলিক বৈচিত্র্যের জন্য দায়ী।
কৃষকদের কুঁড়েঘর কিংবা ঝুপড়িতে তেমন কোনো আসবাব বা কোনো জিনিসপত্র ছিল না। পানি রাখার পাত্র, রান্না করার জন্য পাত্র ও স্বামী-স্ত্রীর দুটো বিছানা ছাড়া অন্য কোনো আসবাব ছিল না। অন্য একজন ইতিহাসবিদের বর্ণনা থেকে এ তথ্যও পাওয়া যায়, গৃহস্থালির সংক্ষিপ্ত তালিকার সঙ্গে রুটি সেঁকার জন্য একটি ছোট লোহার চুল্লিও ছিল।
দুর্ভিক্ষে পীড়িত বাস্তুহারা মানুষ ছবি: হিস্ট্রি ম্যাপস
চার বছর হলো আমরা একটা অতিমারী পার করে এসেছি। কভিড-১৯ পুরো বিশ্বেই তার থাবা বিস্তার করেছে। উন্নয়নশীল দেশগুলো এর জন্য গুনেছে চরম মূল্য। তবে কভিডের প্রতিক্রিয়া এখনো বুঝে ওঠেনি বিশ্ব।
চার বছর হলো আমরা একটা অতিমারী পার করে এসেছি। কভিড-১৯ পুরো বিশ্বেই তার থাবা বিস্তার করেছে। উন্নয়নশীল দেশগুলো এর জন্য গুনেছে চরম মূল্য। তবে কভিডের প্রতিক্রিয়া এখনো বুঝে ওঠেনি বিশ্ব। নানা রকম প্রাক্কলন আর গবেষণার আড়ালে পড়ে গেছে প্রাত্যহিক জীবনের বদলে যাওয়া। বাস্তবিক, মহামারী/অতিমারী সবসময়ই প্রাত্যহিক জীবনকে বদলে দেয়। সমস্যা হলো ২০২০ সালের অতিমারী নিয়ে মানুষের চিন্তা ছিল মৃত্যু ও দুর্ভিক্ষকেন্দ্রিক। কেননা বরাবরই মহামারী ও অতিমারী নিয়ে আসে এ দুটি বিষয়। মোগল আমলও দেখেছে তা-ই। একাধিক মহামারী ও দুর্ভিক্ষ ওই সময় মানুষকে প্রভাবিত করেছিল। সে কারণে শাসন থেকে শুরু করে প্রাত্যহিক জীবনেও পড়েছিল প্রভাব।
লোদি বংশের শাসককে পরাজিত করে ভারতে শুরু হয়েছিল মোগল শাসন। দিল্লি থেকেই সূচনা। বাবরের হাত ধরে। বাবর তার রোজনামচায় সেকালের রোগশোক, মহামারীর কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি প্রথমেই বলেছেন ম্যালেরিয়ার কথা। বাবর যখন দিল্লিতে মোগল শাসনের সূচনা করেন এবং এরপর রাজ্য বাড়াতে থাকেন সে সময় ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাব ছিল বেশি। অনেক সময়ই মানুষ সন্ধ্যার পর ঘর থেকে বের হতে চাইত না। কাছাকাছি সময়ে সিন্ধে প্লেগের প্রাদুর্ভাব হয়েছিল। মূলত ১৫৪৮ খ্রিস্টাব্দে এ মহামারী ছড়িয়ে পড়ে। প্রচুর মানুষ মারা গিয়েছিল। এদিকে ১৫৭৪-৭৫ সালে গুজরাটেও প্লেগ দেখা দেয়। মূলত সে সময় বিশ্বজুড়ে প্লেগের আধিপত্য ছিল বেশি। আকবর ও জাহাঙ্গীরের শাসনামলেও দেখা দেয় প্লেগ।
মহামারী ছড়িয়ে পড়া ও তার কারণে ঘটা অন্যান্য নাগরিক সংকট সাধারণত মূলধারার ইতিহাস এড়িয়ে যায়। যেমন আকবরের শাসনামলের শেষ দিকে যখন প্লেগ দেখা দিচ্ছে তখন তিনি কাশ্মীর অভিযানের কথা চিন্তা করছেন। মূলধারার ইতিহাসে আছে তার কাশ্মীর অভিযানের পরিকল্পনা। কিন্তু প্লেগ নিয়ে তেমন কিছু নেই। ফাদার মনসারেত (আন্তোনিও মনসারেত) অবশ্য এ নিয়ে লিখেছেন। তিনি জানান, এ সময় লোকজন রীতিমতো তাদের বসত তুলে পালাচ্ছিল। কিন্তু কে কোথায় পালাবে তার কোনো ঠিক ছিল না। পুরো বিষয়টি তখন বিশৃঙ্খল হয়েছিল। বাদশাহ আকবর এসব নিয়ে ভাবেননি ব্যাপারটা এমনও নয়। তিনি তার বাদশাহির মানুষকে রক্ষার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু অতিমারী তাকে পুরোপুরি সফল হতে দেয়নি। আকবরের আমলে প্লেগে বহু মানুষ মারা যায়।
বাদশাহ জাহাঙ্গীর নিজেই লিখেছেন তার আমলে প্লেগের প্রাদুর্ভাবের কথা। ১৬১৬ খ্রিস্টাব্দে শুরু হয়ে এ মাহামারী চলেছিল প্রায় চার বছর। মূলত ১৬১৬ সালের শীতে শুরু হয় এবং গ্রীষ্মে প্রাদুর্ভাব কমেছিল। কিন্তু তারপর নিয়মিত বিরতিতে ফিরে আসে প্লেগ। অবস্থা এতটাই ভয়াবহ অনেকেই চর্মকার, কুমার ও ধোপা ছিলেন। এ শ্রেণীর মানুষ কৃষকদের বিভিন্ন প্রয়োজনীয় কাজ করে দিতেন এবং শস্য ফলানোর পর কৃষক মজুরি হিসেবে কিছু শস্য তাদের প্রদান করতেন।
সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলে ফ্রান্সিসকো পেলসার্ট নামে একজন ওলন্দাজ পর্যবেক্ষক মন্তব্য করেছিলেন, ‘সাধারণ মানুষ এতটাই দারিদ্র্যের মধ্যে বাস করে যে তাদের জীবনের ছবি বা নিখুঁত বিবরণ দিলে বলতে হয় এ জীবন শুধু এক তীব্র অভাব ও নিদারুণ দুঃখের বাসভূমি।’ কৃষকরা ছিলেন এ জনগোষ্ঠীর মধ্যে অন্যতম। কৃষকদের সাধারণ ভোগ্য ও ব্যবহৃত জিনিসপত্রের বিবরণ দিতে গেলে আমাদের চোখে ভেসে উঠবে এমন কিছু মানুষের বেঁচে থাকার সংগ্রাম, যারা টিকে থাকার জন্য সর্বনিম্ন প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র জোগাড় করতে সক্ষম হতেন।
কৃষকদের খাদ্যাভ্যাস কেমন ছিল তা খুঁজতে গেলে তাদের খাদ্যতালিকা আমাদের পরিষ্কার দিকনির্দেশনা দিতে পারে। বাংলা, ওড়িশা, সিন্ধু ও কাশ্মীরের প্রধান শস্য ছিল চাল। স্বভাবতই ধারণা করা যায়, এসব অঞ্চলে চালই সাধারণ মানুষের প্রধান খাদ্য। গুজরাটের বেলায় ছিল জোয়ার ও বাজরা। কিন্তু চাষীদের উৎপন্ন ফসলের মধ্যে সবচেয়ে নিচু মানের ফসলই নিজেদের পরিবারের জন্য রাখতে হতো।
কাশ্মীরে সাধারণ মানুষের খাদ্য ছিল মোটা চালের ভাত এবং বিহারের কৃষকরা বাধ্য হতেন মটরশুঁটির দানার মতো খেসারি খেতে। ফলে তাদের মধ্যে নিত্য অসুখবিসুখ লেগে থাকত। সবচেয়ে ভালো গম উৎপন্ন হতো আগ্রা ও দিল্লি অঞ্চলে। কিন্তু এ গম তাদের পেটে জুটত না। সাধারণ মানুষের খাদ্যতালিকায় তাদের উৎপন্ন গম থাকত না, বরং তাদের খেতে হতো চাল ও ডাল। বিশেষ করে আগ্রার শ্রমিকদের বর্ণনা প্রসঙ্গে ইতিহাসবিদরা বলেন, তাদের একঘেয়ে দৈনিক খাদ্যের মধ্যে অল্প একটু খিচুড়ি ছাড়া আর কিছু ছিল না।
এটি তৈরি হয় কাঁচা ডালের সঙ্গে চাল মিশিয়ে। সন্ধ্যায় মাখন দিয়ে খাওয়া হয়। দিনের বেলা তারা অল্প শুকনো ডাল বা অন্য শস্য চিবোয়, যা তাদের ধারণা অনুযায়ী তাদের রোগা পেটের পক্ষে যথেষ্ট ছিল। খাদ্যশস্যের সঙ্গে গ্রামের চাষীরা খেতেন সাধারণত অল্প কিছু সবজি ও আনাজ। বাংলা, ওড়িশা, সিন্ধু বা কাশ্মীরের বেশির ভাগ লোক পাশাপাশি মাছ খেত। ধর্মীয় বাধানিষেধ (গো-হত্যা ও শুয়োর পালনের বিরুদ্ধে) ও দারিদ্র্যের দরুন চাষীরা মাংস খেতে পারতেন না বললেই চলে।
তবে মোগল আমলে মাথাপিছু ঘি উৎপাদন বেশি ছিল। আগ্রা অঞ্চলে, বাংলা ও পশ্চিম ভারতে প্রধান খাদ্যের সঙ্গে সবসময় ঘি থাকত। আসামের লোকের সঙ্গে আবার ঘির কোনো সম্পর্কই ছিল না। বস্তুটিকে তারা প্রচণ্ড ঘৃণার চোখে দেখত। কাশ্মীরের মানুষে পানি দিয়েই রান্না করত। আখরোট, তেল ও ঘি ছিল তাদের কাছে বড়লোকি ব্যাপার। তাভারনিয়ে বলেছেন, ‘ছোটো ছোটো গ্রামেও তরল মিষ্টিজাতীয় জিনিস পর্যাপ্ত পরিমাণে পাওয়া যেতো।’
এ থেকে এটা পরিষ্কার হয়, গ্রামগুলোয় মিষ্টির চাহিদা হিসেবে গুড় খাওয়ার রেওয়াজ ছিল। আবার লবণ খাওয়া নিয়ে ইতিহাসবিদ মোরল্যান্ড দেখিয়েছেন, বাংলায় নুন ছিল খুবই দুষ্প্রাপ্য ও দুর্মূল্য। বাংলার কোনো কোনো অংশে এবং আসামে মানুষ বাধ্য হয়ে ব্যবহার করত কলাগাছের গোড়া পুড়িয়ে এক ধরনের উৎকট বস্তু; এর মধ্যে অবশ্য কিছু পরিমাণ নুন পাওয়া যেত। গোলমরিচ কিংবা কাঁচালঙ্কা এখন যেকোনো পরিবারেই রান্নার জন্য ব্যবহার হয়, কিন্তু সে সময়ের মানুষ এর সঠিক ব্যবহার সম্পর্কে জানত না। পাশাপাশি অন্যান্য মসলা (জিরা, ধনে, আদা) কৃষকদের নাগালে ছিল।
কৃষকরা সাধারণত কী ধরনের কাপড় পরিধান করতেন সে সম্পর্কে অল্পস্বল্প জানা গেলেও কোনো রকম লজ্জাস্থান নিবারণ করার জন্য কৃষকের কাছে সামান্য পরিমাণ কাপড়চোপড় থাকত। পায়ে দেয়ার মতো তাদের কোনো জুতা বা স্যান্ডেল থাকত না। ফলে খালি পায়ে তারা চলাফেরা করতেন। মোগল আমলে হিন্দুস্তানে অর্থাৎ ‘বেরা থেকে বিহার’ পর্যন্ত এলাকায় কৃষকদের পরিধেয় বস্তু নিয়ে মোগল সম্রাট বাবুর মন্তব্য করেছেন, চাষী ও গরিব লোকেরা সম্পূর্ণ খালি পায়ে থাকে আর লঙ্গুটা দিয়ে লজ্জা নিবারণ করে। লঙ্গুটা নাভির নিচে বাঁধা দুই বিঘত পরিমাণ ঝোলা কাপড়। এ ঝোলা কাপড়ের গ্রন্থির নিচ থেকে আরেক টুকরো কাপড় দুই ঊরুর মাঝখান দিয়ে শক্ত করে বেঁধে রাখা হয়।
মেয়েরাও লুঙ্গ নামে একধরনের কাপড় পরে, যার অর্ধেক কোমরে জড়ানো থাকে এবং বাকিটা মাথার ওপর তুলে দেয়া হয়। অন্যভাবে বলা যায়, পুরুষদের সবচেয়ে ছোটো ধুতি ও মেয়েদের একটি শাড়িই ছিল যথেষ্ট এবং তারা আর কিছুই পরত না।
প্রধান সম্পাদক: লে. কমান্ডার (অব.) রাশেদ ইকবাল, প্রকাশক আসিফ কবীর কর্তৃক জন্মভূমি প্রকাশনী লি: ১১০/২,সাংবাদিক হুমায়ুন কবীর বালু সড়ক, খুলনা থেকে মূদ্রিত ও প্রকাশিত