গাজী জাহিদুর রহমান, তালা : মৌসুমী বন্যার কারণে দীর্ঘ দুইমাস ধরে পানিতে ডুবে থাকা তালা উপজেলা ও সাতক্ষীরা সদরের বেতনাপাড়ের শতাধিক গ্রামের লক্ষাধিক মানুষের দুর্ভোগ চরম আকারে ঠেকেছে। এরমধ্যে গত ২দিনের বৃষ্টিপাত ও বৈরী আবহাওয়ায় সেই দুর্ভোগ আরও বেড়ে গেছে। দীর্ঘদিন ধরে এসব ডুবন্ত এলাকার মানুষ সরকারি বেসরকারি এনজিও কিংবা অন্য কোন সংগঠনের পক্ষ থেকে এখনো পর্যš তেমন কোন ত্রাণ সামগ্রী পায়নি বলে জানিয়েছেন। এসব পানিবন্দি মানুষের নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য এখনো পর্যন্ত সরকারিভাবে কোনো আশ্রয়ন কেন্দ্রও খোলা হয়নি বলে অভিযোগ তুলেছেন এসব দুর্গত এলাকার মানুষ। এসব মানুষের মধ্যে তীব্র খাদ্য সংকটসহ পানিবাহিত বিভিন্ন রোগবালাইয়ের প্রকোপ বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে তালার নগরঘাটা, সদরের ধুলিহর, ব্রহ্মরাজপুরসহ ফিংড়ী ইউনিয়নসহ কুল্যা, বুধহাটা হয়ে আশাশুনি পর্যন্ত বেতনাপাড়ের শতাধিক গ্রামের লক্ষাধিক মানুষ দুর্বিসহ মানবেতর জীবনযাপন করছেন। এসব এলাকার মানুষের খাদ্য সংকটের পাশাপাশি, গো-খাদ্যের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। পানিবন্দি এসব মানুষ অনাহারে, অর্ধাহারে থাকায় খাবারের জন্য হাহাকার পড়ে গেছে। বসত ঘর, রান্না ঘর, বাড়ির উঠান, ফসলের ক্ষেত, মৎস্য ঘের, কবরস্থানসহ সবকিছু পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় এসব এলাকায় জরুরি ভিত্তিতে রান্না করা খাবার, শুকনো খাবার এবং জরুরি ঔষধ সামগ্রী প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা। সরকারিভাবে এখনো পর্যন্ত কোনো আশ্রয় কেন্দ্র না খোলায় এবং ত্রাণ সামগ্রী না দেওয়ায় পানিবন্দি মানুষের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে। এখনো পর্যন্ত কোন জনপ্রতিনিধিও তাদের খোঁজ খবর না নেওয়ায় তারা হতাশ হয়ে পড়েছেন। গণমাধ্যম কর্মীদের দেখে বালুইগাছা গ্রামের আব্দুল মাজেদ, আব্দুল্যাহ, মহব্বত আলী, ইসলামসহ একাধিক ব্যক্তি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ভোট এলে গরীবের বন্ধু, সমাজসেবক, জনদরদী লোকের আনাগোনায় এসব জনপদ মুখরিত থাকলেও তারা এখন কোথায়? এসব এলাকায় স্যানিটেশন ব্যবস্থা একেবারেই ভেঙে পড়েছে।
সরেজমিনে তালার নগরঘাটা ও সাতক্ষীরার ধুলিহর, ব্রহ্মরাজপুর ও ফিংড়ি ইউনিয়নের পাশাপাশি বেতনাপাড়ের মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা দুর্বিসহ হয়ে উঠেছে। ইতোমধ্যে মানুষের বসত বাড়িসহ গ্রামের পর গ্রাম পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ায় অনেকেই প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ও গবাদিপশু নিয়ে বাড়িঘর ছেড়ে অন্যত্রে আশ্রয় নিচ্ছেন। এসব এলাকায় মাটির তৈরি ঘরগুলো পানির চাপে মাটিতে মিশে যাচ্ছে। কোন মানুষ মারা গেলে দাফন কাফনসহ কবরস্থ করার জন্য তীব্র বিড়ম্বনার শিকার হতে হচ্ছে। গত একযুগ ধরে বেতনা ও মরিচ্চাপ নদীর নাব্যতা হারিয়ে নদীর তলদেশ উঁচু হয়ে যাওয়ায় এজনপদে বিগত একযুগ ধরে জলাবদ্ধতার কারণে যে পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা কল্পনাতীত। সম্প্রতি অতি ভারীবর্ষণের ফলে সাতক্ষীরা সদরের বেতনাপাড়ের শতাধিক গ্রামে স্থায়ী জলাবদ্ধতা যেন ‘মরার পর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত ২দিন ধরে বৃষ্টির কারণে নগরঘাটা ইউনিয়ন থেকে শুরু করে ধুলিহর ইউনিয়নের স্থায়ী জলাবদ্ধতায় দামারপোতা, বাগডাঙ্গা, বড়দল, জিয়ালা, গোবিন্দপুর, নাথপাড়া, কাজিরবাসা, তালতলা, বালুইগাছা, ধুলিহর সানাপাড়া, জাহানাবাজ, কোমরপুর, দরবাস্তিয়া এবং ভালুকা চাঁদপুর গ্রামের অধিকাংশ জায়গায় ভয়াবহ রূপ ধারন করেছে। এছাড়া ফিংড়ী ইউনিয়নের ফয়জুল্যাপুর, বালিথা, শিমুলবাড়ীয়া, এল্লারচর, ফিংড়ী, গাভা, ব্যাংদহা, জোড়দিয়া, গোবরদাড়ী, সুলতানপুর, মজলিসপুর, হাবাসপুর ও কুলতিয়াসহ ব্রহ্মরাজপুর ইউনিয়নের মাছখোলা, নুনগোলা, রামচন্দ্রপুর, চেলারডাঙ্গা, বড়খামার, মেল্লেকপাড়া, উমরাপাড়া বাঁধনডাঙ্গাসহ অনৈক গ্রাম স্থায়ীভাবে ডুবে আছে। অতীতে এসমস্ত এলাকায় কৃষকদের উৎপাদিত ফসলে এলাকার হাটবাজারগুলোতে মাছ সবজিসহ নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যে ভরপুর থাকতো। মনে হতো ‘ধন ধান্যে পুষ্পে ভরা, আমাদের এই বসুন্ধরা’। আজ এসব শুধুই কল্পনা। ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন স্থায়ীভাবে সৃষ্ঠ জলাবদ্ধ এসব এলাকার মানুষের মধ্যে মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়েছে বিভিন্ন পানিবাহিত রোগবালাই। রাস্তাঘাট, স্কুল-কলেজসহ বিভিন্ন সরকারি স্থাপনা ডুবে যাওয়ায় ব্যাপক ক্ষতি পরিলক্ষিত হচ্ছে।
মানুষের খাবারের পাশাপাশি এসব এলাকায় গোঁ-খাদ্যেরও তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। জলাবদ্ধ এলাকার বাড়িঘর, রাস্তাঘাট সব পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় জনদুর্ভোগ অসহনীয় মাত্রায় পৌঁছেছে বেতনা নদীপাড়ের মানুষ।
এলাকার বেশ কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও রাস্তাঘাট পানিতে ডুবে যাওয়ার কারণে স্কুলের কোমলমতি শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া চরম ব্যাহত হচ্ছে বলে জানান একাধিক শিক্ষক ও অভিভাবক। প্রতিবছর জলাবদ্ধতার কারণে ধুলিহর ইউনিয়নের বালুইগাছা গ্রামের পালপাড়ায় মৃৎশিল্প হাড়ি, পাতিল, কলস, টালিসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র তৈরির মাটি ও কারখানা পানিতে ডুবে যাওয়ায় ঐতিহ্যবাহী এ শিল্প আজ বিলুপ্তি হওয়ার উপক্রম। এসব পানি বন্ধী মানুষেরা অবিলম্বে সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসকসহ সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড-২ এর নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ মনিরুল ইসলাম জানান, টানা বৃষ্টিপাতের কারণে বেতনা নদীর জোয়ারের পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় বেঁড়িবাধের দু’টি স্থানে ভেঙে যায়। যা জন্য বাঁশ ও জিও ব্যাগসহ অন্যান্য সরঞ্জামাদি দিয়ে মেরামত করা হয়েছে।
তালা উপজেলা নির্বাহী অফিসার শেখ মোঃ রাসেল জানান, বেতনা নদীর বাধ ভেঙ্গে নগরঘাটা ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামে পানি ঢুকে এলাকা প্লাবিত হয়। ইতিমধ্যে খালের নেটপাটা অপসারণ করা হয়েছে। এলাকা থেকে পানি সরতে শুরু করেছে। অনেক পরিবারকে খাদ্য সরবরাহ করা হয়েছে।
মৌসুমী বন্যায় বেতনাপাড়ের মানুষের দুর্ভোগ চরমে!
Leave a comment