জন্মভূমি ডেস্ক : নিম্ন আয়ের মানুষের কাছে আমিষের সহজলভ্য উৎস পাঙাশ। চাহিদা থাকায় একসময় মাছটির উৎপাদন বৃদ্ধি পায় খুব দ্রুতই। তবে চাহিদা থাকলেও কয়েক বছর ধরে মাছটি চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন মৎস্যচাষীরা। খাবারের উচ্চ মূল্যের কারণে লোকসান গোনায় তারা এখন অন্য মাছ চাষে ঝুঁকেছেন। এ কারণে সার্বিকভাবে মৎস্য উৎপাদন বাড়লেও গত ছয় বছরে প্রায় ২০ শতাংশ কমেছে পাঙাশের উৎপাদন। পাশাপাশি চাহিদা অনুযায়ী জোগান কমায় কয়েক বছরের ব্যবধানে মাছটির দাম বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ।
মৎস্য খাতসংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পাঙাশ মাছের জন্য বেশি প্রয়োজন হয় প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবার। গত তিন বছরে মৎস্য খাদ্যের বিভিন্ন উপকরণের দাম প্রায় দুই-তিন গুণ বেড়েছে। পাশাপাশি পাঙাশের নতুন জাত না আসায় উৎপাদনশীলতাও কিছুটা কমেছে। আবার সাম্প্রতিক সময়ে কম বৃষ্টিপাতের কারণে সেচ ও বিভিন্ন উপকরণের মূল্যবৃদ্ধির কারণে বেড়েছে উৎপাদন খরচ। এ কারণে পাঙাশ চাষ করে খুব বেশি লাভ করতে পারছেন না মৎস্যজীবীরা।
খুলনা বিভাগে সবচেয়ে বেশি মাছ উৎপাদন হয় যশোরে। জেলাটিতে ক্রমেই কমছে পাঙাশের উৎপাদন। ২০২০-২১ অর্থবছরে যশোরে এ মাছের উৎপাদন হয়েছিল ১১ হাজার ৬৩৬ টন। গত অর্থবছরে তা কমে ৯ হাজার টন উৎপাদন হয়েছে। মূলত মৎস্য খাদ্যের দাম বেড়ে যাওয়া এবং সে তুলনায় মাছের দাম না পাওয়ায় চাষীরা পাঙাশ মাছ ছেড়ে অন্য মাছ চাষে ঝুঁকছেন।
মণিরামপুরের ঘের ব্যবসায়ী শহিদুল ইসলাম মিলন বলেন, ‘আমরা জলাশয় লিজ নিয়ে মাছের আবাদ করে থাকি। আগে যে জমির ২০ হাজার টাকা লিজমানি ছিল, এখন সেখানে ৪০ হাজার টাকা দিতে হচ্ছে। তারপর সাম্প্রতিক সময়ে বৃষ্টিপাত কমে যাওয়ায় ঘেরে সেচ দিতে হয়। এতে বাড়তি খরচ যুক্ত হচ্ছে। আবার মাছের সব ধরনের খাবারের দামও বেড়েছে। আগে এলসির খৈল ৭০ কেজির বস্তা কিনতাম ১ হাজার ৫০০ টাকায়, এখন ৩ হাজার ২০০ টাকা। ১৫ টাকা কেজির ভুট্টা এখন ৩০ টাকা। ফিডের বস্তা ছিল ১ হাজার ২০০ টাকা, বর্তমানে কিনছি ১ হাজার ৮০০ টাকায়। যে কারণে আমাদের মাছ উৎপাদন খরচ বেড়েছে ব্যাপক হারে। দুই বছর ধরে পাঙাশ মাছ চাষ ছেড়ে দিয়েছি। কারণ ওই মাছের দাম বাজারে ভালো পাওয়া যায় না। পাঁচ বছর আগে পাঙাশের পোনা ভারতে যেত, তখন দামও ভালো পাওয়া যেত। বর্তমানে তা বন্ধ থাকায় দেশের বাজারে দাম মিলছে না।’
মৎস্য অধিদপ্তরের হিসাবে, দেশে ২০১৫-১৬ অর্থবছর পাঙাশ মাছের উৎপাদন হয়েছিল ৫ লাখ ৫ হাজার টন, যা মোট মাছ উৎপাদনের ১৩ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ। এর পরের অর্থবছর তা কিছুটা বেড়ে দাঁড়ায় ৫ লাখ ১০ হাজার টনে। ওই আর্থিক হিসাব বছর মোট মাছ উৎপাদনের ১২ দশমিক ৩৩ শতাংশ ছিল পাঙাশ। তবে এর পর থেকেই উৎপাদন কমতে থাকে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৪ লাখ ৫৩ হাজার টন, ২০২১-২২ অর্থবছরে ৪ লাখ ৬ হাজার টন উৎপাদন হয়। এমনকি সার্বিকভাবে দেশে মাছের উৎপাদন বাড়লেও পাঙাশের হার কমেছে। এর মধ্যে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে মোট মাছ উৎপাদনে পাঙাশের অবদান ছিল মাত্র ১০ দশমিক ৬০ শতাংশ, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৮ দশমিক ৯৯ এবং ২০২১-২২ অর্থবছরে এ হার ছিল ৮ দশমিক ৫৩ শতাংশ।
চাহিদার বিপরীতে উৎপাদন কমে যাওয়ায় ক্রমেই বাড়তে শুরু করে পাঙাশের দাম। ২০২২ সালের শুরুর দিকে মাছটির প্রতি কেজির দাম ছিল ১২০-১৫০ টাকা। মৎস্য খাদ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় সে বছরের আগস্টে পাঙাশের দাম বেড়ে হয় ১৮০-২০০ টাকা কেজিপ্রতি। বর্তমানে রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে আকারভেদে পাঙাশ বিক্রি হচ্ছে ২০০-২৫০ টাকায়। কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের হিসাবেও গত এক বছরের ব্যবধানে গরিবের মাছখ্যাত পাঙাশের দাম বেড়েছে ২৫ শতাংশ।
যশোরের মণিরামপুর উপজেলার রাজগঞ্জ বাজারের আড়তদার কপোতাক্ষ ফিশের মালিক মফিজুর রহমান জানান, পাইকারিতে পাঙাশ মাছ বিক্রি হচ্ছে ৭০০ টাকা মণ। এতে লাভ হচ্ছে না। সে তুলনায় অন্য মাছের লাভ আসে অনেক বেশি। এজন্য ধীরে ধীরে পাঙাশ মাছ চাষও কমে যাচ্ছে।
চাহিদার তুলনায় গত তিন বছর জেলায় ৪ লাখ ৯৭ হাজার ৭৯৫ টন মাছ বেশি উৎপাদন হয়েছে বলে জানান যশোর জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ফিরোজ আহমেদ। তিনি বলেন, ‘প্রতি বছরই জেলাটিতে মাছ উৎপাদন বাড়ছে। তবে পাঙাশের উৎপাদন কিছুটা কমেছে। মাছের উপকরণের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে উৎপাদন খরচ বেড়েছে।’
উত্তরের জেলা বগুড়ায় একসময় পাঙাশ চাষে বিপ্লব ঘটলেও তা এখন ক্রমেই কমে এসেছে। খাদ্যের মূল্যবৃদ্ধি, শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধি, বিদ্যুৎ বিলসহ অন্যান্য খরচ বাড়ায় পাঙাশ চাষে আগ্রহ হারাচ্ছেন চাষীরা। জেলা মৎস্য বিভাগের মতে, গত কয়েক বছরে ওই অঞ্চলে পাঙাশের উৎপাদন কমেছে প্রায় ২০ শতাংশ।
জেলার আদমদীঘি উপজেলার ক্ষুদ্র মৎস্য ব্যবসায়ী সমিতির মাছচাষীরা জানান, তাদের উৎপাদিত পাঙাশ মাছ ও পোনা দুটোই বিক্রি হয়। এ মাছ বগুড়া, ঢাকা, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, রংপুর, মিঠাপুকুর, নীলফামারী, নওগাঁ, রাজশাহী, বগুড়া, টাঙ্গাইলসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় যায়। তবে এ মাছের খাবার ভুট্টার গুঁড়া, সরিষার খৈল, ছোট মাছের গুঁড়া, গমের গুঁড়া, চালের গুঁড়ার দাম অনেক বেড়ে গেছে। শ্রমিকের দিন হাজিরা ছিল ৩০০-৪০০ টাকা, এখন তা ৭০০ টাকা। সব মিলিয়ে খরচ বেড়ে যাওয়ায় বিগত দিনের চেয়ে পাঙাশ মাছ চাষ অনেকে কমিয়ে দিয়েছেন। এর পরিবর্তে অনেকেই দেশীয় প্রজাতির কৈ, মাগুর, শিং, পাবদা, রুই, কাতলা, মৃগেলসহ অন্যান্য মাছ চাষ করছেন বেশি।
বগুড়া জেলা মৎস্য কর্মকর্তা কালিপদ রায় জানান, জেলায় ৫৯ হাজারের বেশি পুকুর রয়েছে। একসময় বগুড়ায় পাঙাশ মাছ চাষে বিপ্লব ঘটে যায়। পাঙাশ মাছের উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি ও বাজারে কম দাম এবং ভোক্তাপর্যায়ে আগ্রহ কমে যাওয়ায় এ মাছ এখন কম উৎপাদন হচ্ছে। ২০১৫-১৬ অর্থবছর মোট মাছ উৎপাদনে পাঙাশের অবদান ছিল ৪৫ শতাংশ। গত অর্থবছর তা ২০ শতাংশে নেমে এসেছে।
মৎস্য গবেষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের নদী কেন্দ্র, চাঁদপুরে ১৯৯০ সালে কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে প্রথম থাই পাঙাশের পোনা উৎপাদন করা হয়। পরবর্তী সময়ে পুকুরে চাষ শুরু হয়। অল্প সময়ে দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়ায় ১০-১৫ বছরের মধ্যে সারা দেশে মাছটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। দীর্ঘদিন ধরে একই জাত চাষাবাদ করার কারণে এর উৎপাদনশীলতাও কিছুটা কমে এসেছে। এতে একদিকে খাদ্যের অতিরিক্ত মূল্য এবং অন্যদিকে উৎপাদনশীলতা কমে যাওয়ায় মৎস্যজীবীরা পাঙাশ চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএফআরআই) মহাপরিচালক ড. মো. জুলফিকার আলী বলেন, ‘মাছের খাদ্যের দাম এখন অনেক বেশি। পাঙাশের উৎপাদন কমার দুটো কারণ রয়েছে। একদিকে মৎস্য খাদ্যের দাম অনেক বেড়েছে। সে হিসেবে মাছের দাম বাড়েনি। আবার দীর্ঘদিন ধরে একটি মাছের জাত চাষ হলে তার উৎপাদনশীলতা কমে যায় এটা স্বাভাবিক। নতুন জাত আসেনি। পাঙাশসহ বিভিন্ন মাছের জাত নিয়ে আমাদের গবেষণা চলছে। আমরা অনেকগুলো বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতি চাষাবাদের আওতায় নিয়ে আসতে পেরেছি।’
শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ বায়োলজি অ্যান্ড জেনেটিকস বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. কাজী আহসান হাবীব বলেন, ‘পাঙাশ মাছ নিম্ন আয়ের মানুষের কাছে সহজলভ্য ছিল। কারণ এর দাম কম ছিল। যখন থাই পাঙাশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে তখন সবাই পাঙাশ চাষে আগ্রহী হয়ে ওঠে। কিন্তু একপর্যায়ে দাম কমে যায়। পাঙাশের জন্য প্রচুর প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবার প্রয়োজন হয়। এখন খাবারের দাম বেড়ে যাওয়ায় চাষীরা লাভ করতে পারছেন না। যেমন কয়েক বছর আগেও পাবদা মাছের অনেক দাম ছিল। কিন্তু এখন সবাই পাবদা মাছ চাষ করছেন। এ কারণে কম দামে বাজারে কিনতে পাওয়া যাচ্ছে। অনেক চাষী মূলত পাঙাশের পরিবর্তে এখন শিং, কৈ, মাগুর, পাবদা, গুলশা এসব মাছ চাষ করছেন।’
প্রধান সম্পাদক: লে. কমান্ডার (অব.) রাশেদ ইকবাল, প্রকাশক আসিফ কবীর কর্তৃক জন্মভূমি প্রকাশনী লি: ১১০/২,সাংবাদিক হুমায়ুন কবীর বালু সড়ক, খুলনা থেকে মূদ্রিত ও প্রকাশিত