
লায়লা পারভীন, যশোর : যশোরের চারটি প্রধান মহাসড়ক এখন ভাঙাচোরা আর গর্তে পরিণত হয়ে মহাদুর্ভোগের অন্য নাম। কোথাও পিচ-খোয়া উঠে গেছে, কোথাও বড় বড় খানা-খন্দে ভরপুর রাস্তা। সামান্য বৃষ্টি হলেই রাস্তা ও গর্তের ফারাক বোঝা যায় না। শুকনো মৌসুমে কাদা মিশ্রিত ধুলোবালি উড়ে তৈরি হয় আরেক বিপত্তি।
এই দুরবস্থার কারণে যশোরের শিল্পনগরী নওয়াপাড়া, বন্দরনগরী বেনাপোল ও সাতক্ষীরার ভোমরা স্থলবন্দরের ব্যবসা-বাণিজ্য মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। সাধারণ মানুষের অভিযোগ, বিগত দেড় দশকে নিম্নমানের কাজ ও বরাদ্দ লুটপাটের ফলেই এই অবস্থা। তবে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ও সড়ক বিভাগ বলছে, মাটির গুণাগুণ খারাপ এবং অতিরিক্ত ভারবাহী যান চলাচলই মূল কারণ।
যশোর–খুলনা মহাসড়ক: নতুন করে পুরোনো কষ্ট
দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অন্যতম ব্যস্ততম সড়ক যশোর–খুলনা মহাসড়কের দৈর্ঘ্য ৬০ কিলোমিটার, এর মধ্যে যশোর অংশ ৩৩.৫ কিলোমিটার। সরকার ২০১৭ সালে সড়কটি সম্প্রসারণ ও পুনর্নির্মাণের প্রকল্প নেয়।
৩২১ কোটি টাকার ওই প্রকল্পের কাজ পায় ‘তমা কনস্ট্রাকশন’ ও ‘মাহবুব ব্রাদার্স’। ২০২০ সালের মধ্যে কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও সময় বাড়িয়ে ২০২২ সালের জুনে শেষ করা হয়। ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৩৪৮ কোটি টাকা। কিন্তু সওজের কাছে হস্তান্তরের মাত্র এক মাসের মধ্যেই সড়ক ভাঙতে শুরু করে।
এক বছরের মধ্যে রূপদিয়া থেকে নওয়াপাড়া পর্যন্ত প্রায় ১৫ কিলোমিটার সড়ক আবার ভেঙে যায়। এখন সেটিরই ১৭২ কোটি টাকার সংস্কারকাজ আবার করছে একই দুই প্রতিষ্ঠান।
ঝিনাইদহ রুটেও একই চিত্র
যশোর–ঝিনাইদহ মহাসড়ক খুলনা ও উত্তরবঙ্গের সংযোগের একমাত্র সড়কপথ। ৪৭ কিলোমিটারের এ মহাসড়কের যশোর অংশে প্রায় ২০ কিলোমিটার এবং ঝিনাইদহ অংশে ২৭ কিলোমিটার জায়গা গর্তে ভরা। যানবাহন চলাচল প্রায় অসম্ভব।
২০২১ সালে ছয় লেনে রূপান্তরের প্রকল্প হাতে নেওয়া হলেও সময়মতো কাজ শেষ হয়নি। প্রথমে ২০২৬ সালের জুন পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানো হয়, পরে চলতি বছরের জুনে আবার ৬ মাস বাড়িয়ে পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয় সংশোধনী প্রস্তাব। এতে জমি অধিগ্রহণ ব্যয় বেড়ে ২ হাজার ৬৫০ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।
নড়াইল ও সাতক্ষীরা রুটেও বিপর্যয়
যশোর–নড়াইল মহাসড়কের হামিদপুর, বাউলিয়া, রোস্তমপুর ও তুলারামপুর এলাকায় রাস্তার অবস্থা নাজুক। ছোট যানবাহন প্রায়ই উল্টে দুর্ঘটনা ঘটছে।
যশোর–সাতক্ষীরা মহাসড়কের নাভারণ থেকে বগআঁচড়া পর্যন্ত সাত কিলোমিটার সড়কেও একই চিত্র। অনেক জায়গায় গর্ত ভরাটে ইট ফেলে সাময়িক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
‘ট্রাকে সার তুলতে গিয়ে আটকে পড়ি দুই দিন’
নওয়াপাড়ার একটি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা আহমেদ রাজু বলেন,
“নওয়াপাড়া থেকে দেশের বিভিন্ন জেলায় সার পাঠানো হয়। রাস্তার অবস্থা এতই খারাপ যে, ট্রাক ঢুকলে দুই–তিন দিনের আগে বের হতে পারে না। এতে সার সরবরাহ ব্যাহত হচ্ছে।”
ট্রাকচালক শিপন হোসেন বলেন,
“গাড়ি নিয়ে চলাচল করা কঠিন। অনেক গাড়ি গর্তে পড়ে এক্সেল ভেঙে আটকে যায়।”
খুলনা–কুষ্টিয়া রুটের পরিবহন চালক আলফাজ হোসেন জানান,
“আগে খুলনা থেকে কুষ্টিয়া যেতে সময় লাগত সাড়ে তিন ঘণ্টা। এখন লাগে ছয় থেকে সাত ঘণ্টা। খরচও উঠে না।”
‘নিয়ম না মেনেই কাজ করেছে ঠিকাদাররা’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় কয়েকজন ঠিকাদার ও এলাকাবাসীর অভিযোগ, সড়ক নির্মাণে ব্যাপক অনিয়ম হয়েছে। পুরোনো ইট-খোয়া ও নোনা ধরা উপকরণ পুনর্ব্যবহার, পর্যাপ্ত ভরাট না করা, নিম্নমানের উপকরণ ব্যবহার—সব মিলিয়ে রাস্তাটি টেকেনি।একজন ঠিকাদার বলেন,“তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী নেতাদের ঘনিষ্ঠ ঠিকাদাররা কাজ পেয়েছিলেন। তাদের বিরুদ্ধে সওজ কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি।”তবে ‘তমা কনস্ট্রাকশন’-এর সাব-ঠিকাদার তরিকুল ইসলাম অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন,“বুয়েট ও সড়ক বিভাগ আমাদের কাজের মান নিয়ে প্রশ্ন তোলেনি। ওভারলোডিংয়ের কারণেই রাস্তা নষ্ট হয়েছে।”
সওজ বলছে, ‘ঢালাই রাস্তা হলে টেকসই হবে’
যশোর সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী গোলাম কিবরিয়া বলেন,“মাটির গুণাগুণ খারাপ এবং ওভারলোড যানবাহনের কারণে দ্রুত নষ্ট হয় রাস্তা। বুয়েটের পরামর্শে ঢালাই রাস্তা নির্মাণের কাজ চলছে। চার কিলোমিটার শেষ, আরও ১০ কিলোমিটার হচ্ছে। সব কাজ শেষ হতে দেড় বছর লাগবে।”তিনি আরও জানান, অন্য সড়কগুলোর সংস্কারকাজও প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।