
যশোর প্রতিনিধি : যশোরের ছয়টি সংসদীয় আসনকে ঘিরে নির্বাচনী মাঠে উত্তাপ বাড়ছে। জেলার ২৪ লাখের বেশি ভোটারকে সামনে রেখে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর প্রচার-প্রচারণা জোরদার হলেও বিএনপি নিজেদের ভেতরেই বড় সংকটে পড়েছে। ছয়টির মধ্যে চারটি আসনে ঘোষিত প্রার্থী পরিবর্তনের দাবিতে মনোনয়নবঞ্চিত নেতা-কর্মীদের ক্ষোভ প্রকাশ্য হয়ে উঠেছে। চিঠি, অভিযোগ,সংবাদ সম্মেলন সব মিলিয়ে অভ্যন্তরীণ টানাপোড়েনই এখন বিএনপির আলোচনার কেন্দ্র।
অন্যদিকে আওয়ামী লীগ মাঠে সক্রিয় না থাকায় দীর্ঘদিন পর জেলার বেশির ভাগ আসনেই মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে উঠছে বিএনপি–জামায়াতের মধ্যে। নবীন ভোটারদের আগ্রহ, স্থানীয় ইস্যু ও রাজনৈতিক সমীকরণে যশোরের রাজনীতি এখন নতুন মোড় নিচ্ছে।
শার্শা উপজেলাকে কেন্দ্র করে গঠিত যশোর-১ আসনে বিএনপির টিকিট পেয়েছেন সাবেক সাংসদ মফিকুল হাসান তৃপ্তি। তিনি প্রচারণায় ব্যস্ত। কিন্তু উপজেলা মনোনয়ন প্রত্যাশী ছিলেন বিএনপির সভাপতি আবুল হাসান জহির, সাধারণ সম্পাদক নূরুজ্জামান লিটন ও সাবেক সভাপতি খায়রুজ্জামান মধু। মনোনয়ন বঞ্চিত হওয়ায় উপজেলার ৮৯ নেতা তারেক রহমানের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়ে প্রার্থী পরিবর্তন চান। অভিযোগে তৃপ্তির অতীত রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে।
এ আসনে জামায়াত কেন্দ্রীয় নেতা মাওলানা আজীজুর রহমানকে মনোনয়ন দিয়েছে। একক প্রার্থী হওয়ায় শুরু থেকে জোর প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি ও তার কর্মী সমর্থকরা।
এ আসনে মোট ভোটার ৩ লাখ ৭ হাজার ৮৯৫জন। বিএনপি বিরোধীতা মেটাতে সক্ষম হলে এ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা পূর্ণ নির্বাচন হবে।
ঝিকরগাছা–চৌগাছা নিয়ে গঠিত যশোর-২ আসনে বিএনপির মনোনয়ন পেয়েছেন সাবিরা সুলতানা। তিনি প্রয়াত বিএনপি নেতা নাজমুল ইসলামের স্ত্রী। এ আসনেও বিএনপির তিন মনোনয়ন প্রত্যাশী প্রার্থী পুনর্বিবেচনার দাবিতে আন্দোলনরত। দুই উপজেলার ৫২ নেতা অভিযোগ করছেন, ‘সহানুভূতির ভিত্তিতে’ তাকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। যে কারণে তারা প্রার্থী পরিবর্তনের দাবি জানিয়ে তারেক রহমানকে চিঠি দিয়েছেন।
এ আসনে শক্তিশালী প্রার্থী জামায়াতের ডা. মোসলেহ উদ্দীন ফরিদ। লন্ডন প্রবাসী এ চিকিৎসক নতুন মুখ হলেও জামায়াতের রাজনৈতিক অবস্থানের কারণে স্থানীয়ভাবে ‘হেভিওয়েট’ প্রার্থী বনে গেছেন। তাছাড়া প্রার্থী ঘোষনার পর তার কাজকর্ম ভোটারদের নজর কেড়েছে। ৪ লাখ ৭৮ হাজার ৭২৩ ভোটারে এ আসনে সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছেন তিনি।
জেলার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আসন যশোর-৩—এখানে বিএনপির একক প্রার্থী অনিন্দ্য ইসলাম অমিত। বিএনপির ভেতরে কোনো বিরোধ নেই; অমিতকে ঘিরে স্থানীয় নেতাকর্মীরা একজোট। তাছাড়া তার পারিবারিক রাজনৈতিক ঐতিহ্য তার জন্য বাড়তি সুবিধা করে দিয়েছে। পাশাপাশি ফ্যাসিস্ট বিরোধী আন্দোলনে দলীয় নেতাকর্মীদের আগলে রাখা, ন্যায়সঙ্গত আন্দোলন কর্মসূচিতে রাজপথে থাকা তার ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা তৈরি করেছে।
খুলনা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে তৃণমূলকে উজ্জ্বীবিত করে রেখেছেন তিনি। তরুণদের কাছে গ্রহণযোগ্য প্রার্থী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। ফলে তার পক্ষে একটি গণজোয়ার তৈরি হয়েছে।
৬ লাখ ৪১ হাজার ৬৬৮ ভোটারের এ আসনে জামায়াত মনোনয়ন দিয়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিপি আবদুল কাদেরকে। যশোরের ভোটারদের কাছে তুলনামূলক নতুন হলেও দলের সমর্থন রয়েছে তার সঙ্গে।
যশোর-৪ আসনে বিএনপির প্রার্থী কেন্দ্রীয় কৃষকদলের সহ-সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার টি.এস. আইয়ুব। এ আসনে মনোনয়ন প্রত্যাশী ছিলেন অভয়নগর বিএনপি সভাপতি ফারাজী মতিয়ার রহমান। তিনি ও তার অনুসারীরা প্রার্থী বদলের দাবি তুলেছেন। যুবদল নেতা নূরে আলম সিদ্দিকী সোহাগও আলাদা অবস্থানে রয়েছেন—ফলে বিএনপির অভ্যন্তরীণ সংকট তীব্র। তারপরও ৫ লাখ ২০ হাজার ৬৯০ ভোটারের এ আসনে বিএনপির অবস্থান শক্তিশালী।
অপরদিকে এ আসনে জামায়াতের প্রার্থী জেলা আমীর অধ্যাপক গোলাম রসুল। তিনি এলাকায় সংগঠনের ভিত্তি ধরে প্রচার চালাচ্ছেন।
যশোর-৫ আসনে দ্বিতীয় ধাপে নিজ দলীয় প্রার্থী ঘোষণা করেছে বিএনপি। মণিরামপুর উপজেলা নিয়ে গঠিত এ আসনে এর আগে চারদলীয় জোটের প্রার্থী ছিলো মুফতি ওয়াক্কাস। তার ছেলে মুফতি আব্দুর রশিদ বিন ওয়াক্কাসকে জোটগত প্রার্থী করা হতে পারে বলে গুঞ্জন ছিল। তবে এ আসনে ছাড়তে অনড় ছিলেন স্থানীয় বিএনপি নেতারা। মনোনয়ন পেতে অব্যাহতভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন উপজেলা বিএনপির সভাপতি অ্যাডভোকেট শহীদ ইকবাল, সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান মিন্টু, প্রয়াত বিএনপি নেতা আবু মুসার ছেলে ইউনিয়ন বিএনপির নেতা কামরুজ্জামান শাহীন। সবশেষ উপজেলা বিএনপির সভাপতি প্রার্থী শহীদ ইকবালকে প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করায় স্থানীয় বিএনপি নেতারা একজোট হয়েছেন। তারা বিজয় নিশ্চিত করতে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করছেন বলে জানিয়েছেন।
৪ লাখ ১০ হাজার ৭৮৬ ভোটারের এ আসনে জামায়াতের প্রার্থী অ্যাডভোকেট গাজী এনামুল হক প্রচারণায় সক্রিয়। তিনি ইতিমধ্যেই শক্তিশালী প্রার্থী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। বিশেষ করে সনাতন সম্প্রদায়ের লোকজন এবার তার পক্ষে ঝুঁকেছে। তবে বিএনপি শক্তিশালী প্রার্থী দেওয়ায় এ আসনে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে।
এদিকে যশোর-৬ কেশবপুর আসনে বিএনপির প্রার্থী ছাত্রদলের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি কাজী রওনকুল ইসলাম শ্রাবণ। তার গোটা পরিবার আওয়ামী রাজনীতির সাথে জড়িত। যে কারণে আলোচনা, সমালোচনায় ধুয়েই উত্তাপ কেশবপুরের নির্বাচনী মাঠ। এ আসনে বিএনপির দীর্ঘদিনের কান্ডারি বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য আবুল হোসেন আজাদ। তার পক্ষের লোকজন প্রার্থী পুনর্বিবেচনার ইস্যুতে মাঠে রয়েছেন। উপজেলা পর্যায়ের অন্তত ১০০ নেতা তারেক রহমানকে চিঠি দিয়ে প্রার্থী বদলের দাবি করেছেন।
অপরদিকে ২ লাখ ২৬হাজার ৫৭১ ভোটারের এ আসনে জামায়াতের প্রার্থী অধ্যাপক মোক্তার আলী। এলাকায় শিক্ষাবান্ধব ভাবমূর্তির কারণে পরিচিত। আওয়ামী লীগের আমলেও তিনি তৃণমূলে নিরবে নিভৃতে কাজ করেছেন। এ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা মূলক নির্বাচন হবে বলে মনে করছেন ভোটার ও নির্বাচন বিশ্লেষকরা।
মোদ্দা কথা যশোর-৩ ছাড়া অন্য সব আসনেই বিএনপি ব্যাপক অভ্যন্তরীণ কোন্দলের মুখে। মনোনয়নবঞ্চিত নেতারা একাধিক সভা-সমাবেশে প্রার্থীদের নিয়ে প্রকাশ্যে মন্তব্য করছেন। এতে সাধারণ কর্মীদের মধ্যেও বিভাজন তৈরি হচ্ছে। ফলে নির্বাচনের ফল নিয়ে শীর্ষ নেতাদের উদ্বেগ বাড়ছে। অপরদিকে নির্ভার জামায়াতের প্রার্থীরা।
জেলা বিএনপির সভাপতি অ্যাডভোকেট সৈয়দ সাবেরুল হক সাবু বলেন, ক্ষোভ-হতাশা স্বাভাবিক। তবে চূড়ান্ত মনোনয়ন ঘোষণার পর সবাই ধানের শীষের পক্ষে কাজ করবেন। এবং সব আসনেই শেষ হাসি হাসবে বিএনপির প্রার্থীরা।
এদিকে জামায়াত ইসলামীর জেলা আমীর অধ্যাপক গোলাম রসুলের বলেন, আমরা শুধু অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন চাই। দলীয় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মাঠে আছি। সুষ্ঠু নির্বাচন হলে আমরা একাধিক আসনে জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী
জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম রাকিব জানান, জেলায় নতুন করে ১ লাখ ৪৭ হাজারের বেশি নতুন ভোটার যুক্ত হয়েছে। বর্তমানে যশোরে মোট ভোটার ২৪ লাখ ৮৬ হাজার ৩৩৩ জন। আগামী নির্বাচনে জেলার ৮ উপজেলার ৮২৪টি কেন্দ্রে ভোটগ্রহণের লক্ষ্যে প্রস্তুতি চলছে।
প্রধান সম্পাদক: লে. কমান্ডার (অব.) রাশেদ ইকবাল, প্রকাশক আসিফ কবীর কর্তৃক জন্মভূমি প্রকাশনী লি: ১১০/২,সাংবাদিক হুমায়ুন কবীর বালু সড়ক, খুলনা থেকে মূদ্রিত ও প্রকাশিত