শহিদ জয়, যশোর : ভোরের আলো ফোটার আগেই কাজের সন্ধানে বিক্রি হতে আসেন শ্রমজীবি মানুষেরা।যশোর শহরের লালদীঘি পুকুর পাড়ে ,শত শত শ্রমজীবী মানুষ প্রতিদিন ভোরে কাজের সন্ধানে ভিড় করে।নির্ধারিত স্থানে ভোরের আলো ওঠার সাথে সাথে বিভিন্ন বয়সের পুরুষ ও নারী শ্রমিকেরা উক্ত স্থানে মহাজনদের কাছে বিক্রি হতে আসেন। আর শ্রমজীবী নারী পুরুষ প্রতিদিন সকালে এখানে প্রতিদিন ভিড় করেন একটু কাজ পাওয়ার আশায়। এইজন্য অনেকেই বলে মানুষ বিক্রির হাট। তবে দিন যত যাচ্ছে,তাঁদের জীবনের লড়াই ততই কঠিন হয়ে উঠছে। দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি তাঁদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। স্বল্প আয়ের এই মানুষগুলোর পক্ষে প্রতিদিনের খাবারের খরচ চালানোও যেন আজ এক অসম্ভব সংগ্রামের।
সোমবার এই লালদীঘি পুকুর পাড়ে প্রায় ১০০ জন পুরুষ এবং ৪০ জন নারী শ্রমিক এসেছেন। তাঁদের মধ্যে কাজ পেয়েছেন মাত্র ৪০-৫০ জন। যা ৫০ শতাংশেরও কম। তবে তাঁরা জানান, আগে কাজ পাওয়ার হার ৮০ শতাংশ বা এরও বেশি ছিল। সম্প্রতি সরকার বদল ও বিরাজমান অস্থিরতার কারণে আগের তুলনায় কম কাজ পাচ্ছেন তারা।
কথা হয় ৫৪ বছর বয়সী আব্দুল করিমের সঙ্গে। তাঁর বাড়ি যশোরের কচুয়া ইউনিয়নে। এক হাতে কোদাল আর অন্য হাতে বস্তা নিয়ে প্রতিদিন দাঁড়িয়ে থাকেন কাজের আশায়। আগে মাসে ২০/২২ দিন কাজ পেলেও এখন পান সর্বোচ্চ ১০/১৫ দিন। দৈনিক মজুরি ৭০০ টাকা। বর্তমান বাজারে এই টাকা দিয়ে পর্যাপ্ত খাবার কেনাই সম্ভব হয় না। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বেড়েছে বহুগুণ; চাল, ডাল, তেলসহ সবকিছুর দাম বাড়ায় মাস শেষে পরিবারের জন্য খাবার কিনতেই হিমশিম খাচ্ছেন আব্দুল করিম। তবুও, তিনি আশা ছাড়েন না। প্রতিদিন নিজেকে প্রস্তুত করেন নতুন উদ্যমে।
৪০ বছরের হাসানুল একাই সংসার চালান। মনিরামপুরের রাজগঞ্জ থেকে আসা এই মানুষটি পাঁচ মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে সংসার চালান। একসময় দৈনিক ৭০০/৮০০ টাকা মজুরি পেলেও এখন পাচ্ছেন ৫৫০/৬০০ টাকা। এই সামান্য আয়ে পরিবারের জন্য দিন-রাত খেটে যাচ্ছেন। নিজের কথা ভুলে গিয়ে হাসানুল কেবল ভাবেন, তাঁর পরিবারের মুখে অন্তত একটু খাবার তুলে দেওয়ার কথা। চলমান সংকটে তাঁর এই লড়াই এখন কেবল টিকে থাকার সংগ্রাম হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সাতক্ষীরা তালার ৫৫ বছরের হারু মিয়া দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে দিশেহারা। কোনোমতে ভরণপোষণ জোগাড় করছেন পরিবারের। তিনি বলেন,‘জানি না বাবা, আল্লায় চালাচ্ছেন। নইলে যে কয় টাকা পাই তাতে কোনোভাবেই সংসার চালানো সম্ভব না। এখন তা-ও ছেলেটা রিকসা চালিয়ে একটু সাহায্য করে বলে, তা না হলে আমি একা পারতামই না।’
বাঘারপাড়ার নায়েব আলী,৬০ বছর বয়সেও সংসারের ভার তাঁর কাঁধে। তাঁর দৈনিক ৫৫০ টাকা আয় দিয়ে পরিবার চালানো খুব কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি বলেন,‘জিনিসের দাম বাড়ে,আর আমাদের মজুরি শুধু কমে। তাহলে খেয়েপরে বাঁচব কীভাবে?’ তাঁর মতো একজন বয়স্ক মানুষ প্রতিদিনের এই যুদ্ধে কোনোমতে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন।
অনেক নারী শ্রমিকদের সঙ্গেও দেখা হয় সেখানে। তাঁদেরই একজন আসমা, বয়স ৪০। স্বামী পরিত্যাক্তা, তাই সংসারের পুরো খরচ চালাতে তাঁকে কাজ করতে হয়। মাটি কাটা, ঝাড়ুমোছার মতো কাজ করেন, কখনো রাজমিস্ত্রি সহযোগীর কাজও করেন তিনি। আয় এতটাই সীমিত যে প্রতিদিন পরিবারের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করা তাঁর জন্য একটা দুঃস্বপ্নের মতো। মাত্র ৫০০/৫৫০ টাকায় এত কিছুর জোগান দেওয়া সম্ভব হয় না। তবুও আসমা প্রতিদিন নতুন করে সংগ্রামে নামেন, সন্তানদের মুখে একমুঠো খাবার তুলে দিতে।
এই হাটে দাঁড়িয়ে থাকা প্রতিটি মানুষ দ্রব্যমূল্যের চাপে আজ নুইয়ে পড়েছেন। তাঁদের প্রত্যাশা সামান্য, শুধু একটু খাবারের নিশ্চয়তা। তবে আজকের অর্থনৈতিক সংকটে তাঁদের এই মৌলিক চাহিদাটুকু পূরণ করাও কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবু তাঁদের আশায় বুক বাঁধা—একদিন হয়তো এই সংগ্রামের শেষ হবে, আর তাঁদের জীবনে খাদ্যের জন্য এই কঠিন লড়াই থেকে মুক্তি মিলবে।
দিন যায়, দিন আসে। তবু খেটে খাওয়া শ্রমজীবী এসব মানুষের ভাগ্যের ফের নেই; তাঁদের জীবনে এখনো অন্ধকার। দ্রব্যমূল্যের করালগ্রাসে প্রতিনিয়ত তাঁরা নিষ্পেষিত, লড়াই করছে জীবনের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র চাহিদার জন্য। তাঁদের কণ্ঠে কোনো আর্তনাদ নেই, কিন্তু বোবা ব্যথা যেন হৃদয় বিদীর্ণ করে তুলছে।