জন্মভূমি ডেস্ক : বেইলি রোডে আগুন ট্র্যাজেডির পর নড়েচড়ে বসেছে প্রশাসন। রোববার রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার রেস্তোরাঁয় অভিযান শুরু করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। এ সময় প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন আছে কিনা, জরুরি বহির্গমন সিঁড়ি রয়েছে কিনা, নিরাপদ স্থানে গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহার করছে কিনা, অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র এবং ঝুঁকির বিষয়টি নজরদারি করা হয়। গতকাল রাত ১১টা পর্যন্ত আটক করা হয়েছে বিভিন্ন রেস্তোরাঁর ৪০ কর্মীকে। তাদের মধ্যে কয়েকটি রেস্তোরাঁর ব্যবস্থাপকও রয়েছেন। এ ছাড়া যেসব রেস্তোরাঁয় ছোটখাটো অনিয়ম পাওয়া গেছে, তাদের মুচলেকা রেখে সতর্ক করা হয়েছে।
গুরুতর অনিয়ম ও ঝুঁকিপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে নেওয়া হয়েছে আইনি ব্যবস্থা। তবে অনিয়ম কম পাওয়া গেছে এবং পরবর্তী সময়ে নিয়ম মেনে রেস্তোরাঁ চালাবে– এমন মুচলেকা দেওয়ায় অনেককে সতর্ক করে ছেড়ে দেওয়া হয়। এ ছাড়া প্রথমবারের মতো বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে সতর্ক করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, রেস্তোরাঁয় এ ধরনের অভিযান চালানোর ঘটনা পুলিশের এটাই প্রথম। তাই সতর্কতার সঙ্গে আইন প্রয়োগ করা হচ্ছে। গুরুতর অনিয়ম পেলে মামলা করা হচ্ছে।
ধানমন্ডির ১৯ রেস্তোরাঁ থেকে ১৯ জনকে আটক করা হয়। তারা হলেন– হোয়াইট হল রেস্টুরেন্টের শামীম হোসেন তুহিন, ম্যারিটেজ ঢাকার খুরশিদ আলম, অ্যারিস্টোক্র্যাটের সাব্বির হোসেন, আদি কড়াই গোস্তর খালিদ হোসেন, দি লবি লাউঞ্জের মারুফ হোসেন, ইয়ামচা ডিস্ট্রিটের পুলক বিশ্বাস, ক্যাফে ডোলচের আশিক তালুকদার, ক্যাফে সাওপাওলোর শাহিন সারোয়ার, ক্যাপিটাল লাউঞ্জের রেদুয়ান আহম্মেদ, পার্ক অ্যান্ড স্মার্টের মিজানুর রহমান, খানাজের শরিফুল ইসলাম, ক্যাফে ইউফোরিয়ার আল আমিন, টুইন পার্কের আল আমীন মোস্তফা তালুকদার, স্বদেশীর মেহেদী হাসান, ডিকে-১৩-এর রাসেল পালমা, বোস্টার প্রের আমিনুল ইসলাম রিফাত, চা টাইপের সামিত আলম সিয়াম, ক্রাস স্টেশনের চয়ন হালদার ও বিবিকিউর সুমিত রায়।
ভাটারায় বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার প্রবেশমুখে আবাসিক ভবনের ভেতরে গড়ে ওঠা বিভিন্ন রেস্তোরাঁ থেকে তিনজনকে আটক করা হয়। এ ছাড়া অভিযান হয়েছে গুলশানের বিভিন্ন রেস্তোরাঁয়ও। এদিকে গুলশান এলাকায় ১০টি রেস্তোরাঁয় অভিযান চালানো হলেও কাউকে আটক করা হয়নি। রমনা থানাধীন বেইলি রোড ও আশপাশের ১১টি রেস্তোরাঁয় অভিযান চালিয়ে বেশ কয়েকজনকে আটক করা হয়েছে।
ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন) ড. খন্দকার মহিদ উদ্দিন বলেন, ধারাবাহিকভাবে এই ধরনের অভিযান চলবে। অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় করেই এটি চালানো হবে।
রাজধানীর সড়ক কিংবা ফুটপাতের আশপাশ ছাড়াও বিভিন্ন আবাসিক এলাকায় ব্যাঙের ছাতার মতো হোটেল-রেস্তোরাঁর ব্যবসা পেতে বসেছেন ব্যবসায়ীরা। নিয়মনীতির তোয়াক্কা করছে না এসব প্রতিষ্ঠান। প্রকাশ্যে রাস্তার পাশে চুলা বসিয়ে গ্যাস সিলিন্ডারে রান্না করার দৃশ্য হরহামেশাই চোখে পড়ে। অনেক ক্ষেত্রে চুলার কাছাকাছি মানুষের বসার ব্যবস্থা করা আছে। এ ছাড়া আবাসিক ভবনে বাণিজ্যিক অনুমোদন না থাকলেও বিভিন্ন ফ্লোরে রেস্তোরাঁর ব্যবসা চলছে। নিরাপত্তার বালাই নেই বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানে। যত্রতত্র গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহার করা হচ্ছে। এতে যে কোনো সময় ঘটতে পারে দুর্ঘটনা।
বছরের পর বছর ঝুঁকিপূর্ণ এসব প্রতিষ্ঠান চললেও তেমন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। যখন কোনো দুর্ঘটনায় হতাহতের ঘটনা ঘটে, তখন যেন কানে শব্দ পৌঁছে সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর। গত বৃহস্পতিবার রাতে বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজে অগ্নিকাণ্ডে ৪৬ জন প্রাণ হারান। আহত হন অনেকেই। ওই ভবনের বিভিন্ন ফ্লোরে আটটি রেস্তোরাঁ রয়েছে। হতাহতের বেশির ভাগই এসব রেস্তোরাঁয় খেতে গিয়েছিলেন।
গত শনিবার ডিএমপি সদরদপ্তর থেকে মাঠ পর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তাদের রেস্তোরাঁয় অভিযান চালানোর বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়। অনিয়মে চলছে এবং ঝুঁকিপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এর পরই গতকাল দুপুরের পর থেকে রাজধানীর বিভিন্ন থানা পুলিশ সংশ্লিষ্ট এলাকার রেস্তোরাঁয় অভিযান শুরু করে।
রামপুরা থানার দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা জানান, বনশ্রী এলাকায় অসংখ্য রেস্তোরাঁ গড়ে উঠেছে। নিয়মনীতি না মেনে অনেকে আবাসিক ভবনেই ব্যবসা করছেন। গতকাল সকাল থেকে এসব প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালানো হয়। অন্তত ৩০টি প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন অনিয়ম পাওয়া গেছে। তাদের একটি তালিকা করা হয়েছে। এদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
রেস্তোরাঁপাড়া হিসেবে পরিচিত খিলগাঁওয়েও অভিযান চালায় সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশ। রাত ৮টা পর্যন্ত অন্তত ১৫টি প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালিয়ে ১২ জন আটক করা হয়। খিলগাঁও জোনের সিনিয়র সহকারী পুলিশ কমিশনার আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, অভিযান চলছে। এরই মধ্যে যেসব প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালানো হয়েছে এর একটিরও অনুমোদন নেই। এ ছাড়া সিঁড়িতে গ্যাস সিলিন্ডার রেখে রান্নার কাজ করা হচ্ছে। নির্বাপক যন্ত্র নেই কোনো প্রতিষ্ঠানে। রান্নাঘর থাকলেও সেটি অনিরাপদ। ঝুঁকিপূর্ণভাবে গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহার করা হচ্ছে। আটক ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান তিনি।
রাত ৮টা পর্যন্ত ডেমরা থানা পুলিশ চারটি রেস্তোরাঁয় অভিযান চালায়। এর মধ্যে দুটিতে কোনো অনিয়ম খুঁজে পাওয়া যায়নি। বাকি দুটিতে বাইরে গ্যাস সিলিন্ডার রেখে রান্নাসহ নানা অনিয়ম পাওয়া গেছে। ফলে দু’জনকে আটক করা হয়। ডেমরা থানার ওসি জহিরুল ইসলাম বলেন, আটক দু’জনের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সন্ধ্যার পর উত্তরা এলাকার বিভিন্ন রেস্তোরাঁয় অভিযান চালায় পুলিশ। রাত সাড়ে ৮টায় উত্তরা পশ্চিম থানার ওসি আবুল হাসান বলেন, থানার একাধিক টিম মাঠে রয়েছে।
পুলিশের মাঠ পর্যায়ের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, নিয়ম মেনে হোটেল-রেস্তোরাঁ চালানো হচ্ছে কিনা, সে বিষয়ে আগে সেভাবে পুলিশের তরফ থেকে অভিযান চালানো হয়নি। এ কারণে মাঠ পর্যায়ে পুলিশ সদস্যরা সতর্কতার সঙ্গে কাজ করছেন।
ধানমন্ডির যেসব রেস্তোরাঁয় অভিযান চালানো হয়েছে এর মধ্যে রয়েছে খানাস, ক্যাফে ইউফোরিয়া, পার্ক অ্যান্ড স্মার্ট, বাফেট মানিয়া, বিয়ে বাড়ি, গ্লোরিয়া জিন্স, দিক থার্টিন, মেরিটাস লাউঞ্জ, প্যান প্যাসিফিক, অ্যারিস্টোকেয়া ও রেডক্লিপ।
ধানমন্ডি জোনের এডিসি এহসানুল ফেরদৌস বলেন, অপরাধের ধরন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। যারা গুরুতর অনিয়ম করেছেন, তাদের বিরুদ্ধে মামলা হবে। কারও কারও বিরুদ্ধে ডিএমপি অ্যাক্ট প্রয়োগ করা হচ্ছে।
পুলিশের গুলশান বিভাগের ডিসি রিফাত রহমান শামীম বলেন, রেস্তোরাঁয় অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে চালানো অভিযানে তিন ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। ডিএমপি অ্যাক্টে ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান রয়েছে। ফৌজদারি কার্যবিধির ১৩৩ ধারায় মামলা হবে। এ ছাড়া আলাদা পেনাল কোডে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
এদিকে বেইলি রোডে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় দায়ের করা মামলা রমনা থানা থেকে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগে (সিআইডি) যাচ্ছে। এরই মধ্যে গ্রেপ্তার চারজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ। গ্রিন কোজি কটেজে আগুনের ঘটনায় ভবনটির মালিক প্রতিষ্ঠান আমিন মোহাম্মদ গ্রুপের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। তবে ওই প্রতিষ্ঠানের কারও নাম উল্লেখ করা হয়নি।
এ মামলায় ভবনটির নিচতলার ফাস্টফুড চা চুমুকের কর্ণধার আনোয়ারুল হক (২৯), কাচ্চি ভাই রেস্টুরেন্টের মালিক সোহেল সিরাজ (৩৪) এবং ভবনের ম্যানেজার মুন্সি হামিমুল আলম বিপুলকে (৪০) আসামি করা হয়েছে। এ ছাড়া মামলায় রাজউকের পরিদর্শকদের আসামি করা হয়। তবে সরকারি এ সংস্থার কারও নাম মামলায় সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়নি।