
এম এন আলী শিপলু : অনেক জেলের মাছ ধরার এচিত্র দেখে মনে হতে পারে এটি মাছ ধরার কোন উৎসব। কিন্তু আসলে তা নয়। এ চিত্র ঘূর্ণিঝড় রেমালের আঘাতে বাঁধ ভেঙ্গে খুলনার পাইকগাছার লতা এলাকায় ভেসে যাওয়া কয়েকশ' ঘের থেকে বেরিয়ে যাওয়া চিংড়ি ও অন্যান্য মাছ সংগ্রহের চেষ্টায় লিপ্ত কয়েকশ' মৎস্য চাষিদের। ঘূর্ণিঝড় রেমালে খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৪০ হাজার ৫১৫টি মৎস্য ঘের, ৮ হাজার ১০০ পুকুর ও ৪ হাজার ৫৫৬টি কাঁকড়ার খামার। যাতে ২৩ কোটি ৬৫ লাখ টাকার চিংড়িসহ ৭২২ কোটি ১৭ লাখ টাকার মাছ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে চলতি বছর চিংড়ি উৎপাদন অর্ধেকে নেমে আসার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। যার বড় প্রভাব পড়তে পারে রফতানিতেও। মূলত: দক্ষিণাঞ্চলের তিন জেলায় চিংড়ি চাষ হয়। মৎস্য বিভাগের হিসেব অনুযায়ী ঘূর্ণিঝড় রেমালের আঘাতে খুলনায় ৯ হাজার ১১৫টি, বাগেরহাটে ২ হাজার ৭০০ এবং সাতক্ষীরায় ৩ হাজার ৯০০ ঘের একবারেই তলিয়ে গেছে। প্রাথমিক ক্ষতি দাঁড়িয়েছে ৩৩২ কোটি টাকা। এদিকে চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানি খাতের আয় কমেছে ২০.৩৭ শতাংশ। প্রথম ছয় মাসে হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানি করে আয় হয়েছে ১৪ কোটি ৫৯ লাখ ডলার। এর আগের অর্থবছরের একই সময়ে রপ্তানি করে আয় হয়েছিল ১৮ কোটি ৩২ লাখ ডলার; অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে আয় কমেছে ২০ ভাগের বেশি।রপ্তানিকারকরা বলছেন, হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানির অন্যতম বড় বাজার ইউরোপে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার কারণে চিংড়ি রপ্তানি কমেছে। তবে, এমন পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে চিংড়ির মূল্য সংযোজিত পণ্য তৈরির পরামর্শ দিয়েছে মৎস্য বিভাগ। তারা বলছেন, হিমায়িত চিংড়ি থেকে বহুমুখী পণ্য উৎপাদন করা গেলে বৈদেশিক মুদ্রা আয় বাড়বে। এগিয়ে থাকা যাবে প্রতিযোগিতাতেও।
খুলনা মৎস্য পরিদর্শন ও মান নিয়ন্ত্রণ কার্যালয়ের কোয়ালিটি কন্ট্রোল অফিসার লিপটন সরদার জানান, চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানি হয়েছে প্রায় ৯ হাজার ৭১ মেট্রিক টন। যেটা গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে ছিল ১৩ হাজার ২৭১ মেট্রিক টন; অর্থাৎ পরিমাণের দিকে থেকে প্রায় ৩ হাজার মেট্রিক টন রপ্তানি কম হয়েছে। টাকার অঙ্কে প্রথম ছয় মাসে রপ্তানির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ২১ কোটি টাকা। চিংড়ি খাতে এই মন্দা দশা চলছে গত কয়েক বছর ধরে।
পাইকগাছা উপজেলার সোলাদানা এলাকার ঘের ব্যবসায়ী আমিনুর সরদার জানান, তার ঘেরে ১২ থেকে ১৫ লাখ টাকার চিংড়ি মাছ ছিল, যা ঝড়-বৃষ্টিতে ভেসে গেছে। পাইকগাছার সব ঘের ও পুকুর পানিতে একাকার হয়ে গেছে। তিনি এখন সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েছেন।
সোলাদানা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) মেম্বার শেখ আবুল কালাম আজাদ বলেন, সোলাদানার এই বিলের সব ঘের পানিতে ভেসে গেছে। ফলে চাষিরা মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়েছেন। এ ক্ষতি অপূরণীয়। এই যে দেখছেন ব্যাপক লোকজন জাল দিয়ে মাছ ধরছে। ঘের ভেসে যাওয়ায় এখানে স্থানীয় লোকজন মাছ ধরতে ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন।
বিভাগীয় পোনা ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও পাইকগাছা উপজেলার পুরস্কারপ্রাপ্ত ঘের ব্যবসায়ী গোলাম কিবরিয়া রিপন বলেন, ঘূর্ণিঝড় রিমালের আঘাতে চিংড়িচাষিরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। এ অঞ্চলের ৮০ শতাংশ ঘেরই ভেসে গেছে। পানি নেমে যাওয়ার পর কোনও ঘেরেই মাছ পাওয়া যায়নি।
বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্টার্স এ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক এম এ হাসান পান্না বলেন, এমনিতে দেশে মাছের উচ্চ মূল্য তারওপর রেমালের কারণে রপ্তানিযোগ্য চিংড়ির সংকটে বাধাগ্রস্ত হবে এ খাত থেকে বৈদেশিক মুদ্রা আয়।
বিভাগীয় মৎস্য কর্মকর্তা মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, খুলনা বাগেরহাট ও সাতক্ষীরায় রিমালের আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৮১টি ইউনিয়নের ৫৩ হাজার ১৭১টি পুকুর, ঘের ও কাঁকড়া খামার। যার আয়তন ৩৫ হাজার ৫৫৫ হেক্টর। এতে মোট ক্ষতি হয়েছে ৭২২ কোটি ১৭ লাখ টাকা। এর মধ্যে ১৫ হাজার ৫৭৮ মেট্রিক টান মাছে ক্ষতি ২৪৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা, ৭ হাজার ৬৩০ মেট্রিক টন চিংড়ি মাছে ক্ষতি ৩২৩ কোটি ৬৫ লাখ টাকা, ১ হাজার ১৭১ লাখ পোনায় ক্ষতি ৮৫ কোটি ৫৭ লাখ টাকা, ১৭২ মে টান কাঁকড়ায় ক্ষতি ২০ কোটি ৩৯ লাখ টাকা, ৫৮০ লাখ পিএলে ক্ষতি ১৪ কোটি ২৬ লাখ টাকা, ২০টি নৌকায় ক্ষতি ২০ লাখ টাকা ও অবকাঠামোগত ক্ষতি ৩০ কোটি ৬১ লাখ টাকা।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা জয়দেব পাল বলেন, মৎস্য অধিদপ্তর বলছে ক্ষতি পুষিয়ে নিতে ও চিংড়ি উৎপাদন অব্যাহত রাখতে চাষিদের তালিকা করে প্রণোদনা দেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরায় ১লাখ ২৫ হাজার টন চিংড়ি উৎপাদন হয়েছিলো। যেখান থেকে রপ্তানিযোগ্য চিংড়ি রফতানি করে ২ হাজার ৪১২ কোটি টাকা আসে দেশে।
প্রধান সম্পাদক: লে. কমান্ডার (অব.) রাশেদ ইকবাল, প্রকাশক আসিফ কবীর কর্তৃক জন্মভূমি প্রকাশনী লি: ১১০/২,সাংবাদিক হুমায়ুন কবীর বালু সড়ক, খুলনা থেকে মূদ্রিত ও প্রকাশিত